অদৃশ্য বলে বেপরোয়া পিআইসি

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে
প্রভাবশালীদের মদদে ঘুরেফিরে অযোগ্য ও অকৃষিজীবী ধূর্ত লোকদেরকে কোন না কোনভাবে বাঁধের কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। এরা অর্থ লোপাট ছাড়া হাওর রক্ষায় বা কৃষকের স্বার্থ রক্ষা থেমন কোন ভূমিকা রাখছে না। বরঞ্চ এদের নানা কাজে কৃষকরা অতীষ্ঠ। গত ৭ ফেব্রুয়ারি হালি হাওরের ৩৩ নম্বর পিআইসি সভাপতি মো. জুলহাস তালুকদারের অনৈতিক কর্মকান্ডে বিরক্ত হয়ে দুর্গাপুর গ্রামের কৃষকেরা ইউএনও বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ওই পিআইসি দুর্গাপুর মৌজার গোচারণ ভূমি কেটে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করছে। যে জায়গাটি দুর্গাপুরের কৃষকদের গরু ছড়ানোর একমাত্র জায়গা। বৈশাখ মাসে ফসল তোলা ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহৃত হয় এ জায়গাটি। সেই বস্তি জায়গা কেটে ভূমি পরিবর্তনের মাধ্যমে বোরো জমি রূপান্তরের চেষ্টা করা হচ্ছে। পরে তা দখল করে বোরো আবাদের পাঁয়তারা করছে অভিযুক্ত ব্যক্তি। এতে বাধা প্রদান করলে দুর্গাপুর গ্রামের কৃষকদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ হুমকি-ধমকি দিচ্ছে পিআইসি জুলহাস তালুকদার।
এর আগে ও পরে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইউএনও বরাবরে আরও দুইটি অভিযোগ দায়ের করে মামুদপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মমিন ও দুর্গাপুর গ্রামের পাওনা বঞ্চিত শ্রমিকেরা। অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিগত বছরে বাঁধের কাজ করা শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করাসহ কয়েকটি মামলায় অভিযুক্ত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে ওই পিআইসি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠনেরও দাবি জানানো হয়। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না কর্ত ব্যক্তিরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিষয়টি এ প্রতিবেদকের জেনে লাভ নেই বলে জানিয়েছেন জুলহাস তালুকদার।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, গত ফসল তোলা মৌসুমে হালি হাওরের আছানপুর অংশের ১৭ নম্বর পিআইসিভূক্ত বাঁধটি ভাঙ্গার বড় কারণ ছিল পিআইসির গাফিলতি। সেবার ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের অভ্যন্তরে গর্ত চুয়ে পানি হাওরে প্রবেশ করলেও গর্ত বন্ধে কৃষকের আগাম সতর্কবার্তা টলাতে পারেনি কাউকে। উপরন্তু নিজের অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে কৃষকদের শাসানোর কথা উঠেছে ওই পিআইসির বিরুদ্ধে।
বাঁধ ভাঙ্গার আগে হাওর পার ধাপিয়ে বেড়ালেও বাঁধ ভেঙ্গে হাওর তলিয়ে গেলে গা ঢাকা দেয় সংশ্লিষ্ট পিআইসি। পরে অবশ্য জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির নিষিদ্ধ ঘোষিত কালো তালিকায় নাম ওঠে তার।
তবে চলতি বছর নিষিদ্ধ ওই পিআইসি সভাপতি মুহিবুর রহমান স্বনামে যুক্ত না থাকলেও তার নিকটাত্মীয়ের নাম দিয়ে ঠিকই প্রকল্প ভাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত বছরের ১৭ নম্বর পিআইসি এবার হয়েছে ৩০ নম্বর। এই পিআইসির সভাপতি ছদরুল আমিন মুহিবুর রহমানের সম্পর্কিত ভাতিজা বলে জানিয়েছেন মুহিবুর রহমান নিজেই। তবে এই বাঁধের কাজ এবার ভালোভাবে হয়েছে এবং কাজও শেষ করা হয়েছে বলে দাবি করেন মুহিবুর রহমান।
এভাবে বছরের পর বছর বিতর্কিত লোকদের বাঁধের কাজে জড়িয়ে হাওরের সর্বনাশ ডেকে আনা হচ্ছে। হাওর সুরক্ষায় সরকারের বরাদ্দকৃত টাকায় কারা, কার স্বার্থে এমনটা করছে প্রশ্ন হাওরপাড়ের কৃষকদের।
হাওর ঘুরে দেখা যায়, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণে ধ্বংস হচ্ছে কোন কোন হাওরপাড়ের বস্তি কান্দা। বছরের পর বছর এ রকম কান্দা কাটায় একদিকে যেমন হাওরের সৌন্দর্য বিলীন হচ্ছে অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি বিনষ্ট করা হচ্ছে গোচারণ ভূমি। হাওরের অনেক কান্দা ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে ডোবা নালায় পরিণত হয়েছে। ধ্বংসকৃত এই স্থানগুলোতে একসময় কৃষকেরা গরু চড়াতো। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের আশকারায় তাদের অনুগত একশ্রেণির পিআইসি নামধারী লোকেরা কৃষকদের মতামত অগ্রাহ্য করে হাওরের বিপদ ডেকে আনছে। এদের রুখে দিয়ে হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি হাওর সচেতন কৃষকদের।
সাচনা গ্রামের কৃষক আকবর হোসেন জানিয়েছেন, মানুষের বাঁচার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সুস্থ প্রকৃতি দরকার। হাওরপাড়ের কান্দা কেটে ধ্বংস করায় গরু-বাছুর পালন, কৃষি কাজ এবং হাওরের বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ ও পাখপাখালি চরম হুমকিতে পড়ছে। আগামী কয়েক বছর পর হাওরে অবশিষ্ট বলতে কিছু থাকবে না। এই হাওর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সকলকে জেগে উঠতে হবে। নইলে হাওর রক্ষা সম্ভব হবে না।
দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক ও সাবেক ইউপি সদস্য মিহির লাল রায় বলেন, আমরার গ্রামের জায়গা থাইক্যা মাটি কাইট্যা নিছে। এইখানে গ্রামের গরু-বাছুর রাখা হয়। মাটি কাটতে বাধা দেওয়া হইছিল, বাধা মানছে না। আরও হুমকি-ধমকি দেয়। পরে অভিযোগ দেওয়া হইছে।
সর্বদলীয় সম্প্রীতির উদ্যোগ সুনামগঞ্জের সমন্বয়কারী ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিসবাহ উদ্দীন বলেন, বাঁধের কাজ হয় কৃষকের স্বার্থে। কৃষকের ভালো-মন্দ সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। বাঁধের কাজ করতে গিয়ে যদি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কৃষকদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয় তাহলে বিষয়টি যুক্তিসঙ্গত হবে না। বাঁধের কাজে যে বা যারা অযৌক্তিক কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি দরকার।
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, বাঁধের কাজ নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী ও কৃষকরা কথা বলতে চাইলে অনেক পিআইসি আছে যারা দুর্ব্যবহার করে। তারা মূলত অন্তরালের পৃষ্ঠপোষক অর্থাৎ একটা বিশেষ গোষ্ঠীর পেশিশক্তির বলে মারমুখী হয়ে উঠে। কৃষকের ভাগ্য নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদেরকে বয়কট করতে হবে।
হুমকি-ধমকির বিষয়টি অস্বীকার করে ৩৩ নম্বর পিআইসি সভাপতি মো. জুলহাস তালুকদার রাগান্বিত সুরে বলেন, ‘ড্রেসিং মেসিং কইরা শেষ। দূরবা লাগাইমু খয়দিন পরে। অন্যখাইন্দে মাডির কামই হইছে না। মাডির কাম রইছে বহুতজনের, কয়জনের নাম কইমু। আমার কাজ শেষ, আপনারা আমারে আইয়া জিগাইন।’
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘দুর্গাপুরের অংশত থাইক্যা মাডি আনছি, এইখানও আমার তালুকদারী আছে, এইডা আপনার বুইঝ্যা লাভ নাই। আমি খারাপ মানুষ না। ভালা মানুষ দেইখ্যাই কাজ পাইছি। কাজ তুইল্যাওলাইছি।’
কেন্দ্রীয় হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, আমার ধারণা প্রশাসন থেকে পিআইসিদের শেল্টার দেওয়া হচ্ছে। আর রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া তো আছেই। দুই কারণে পিআইসিরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। এগুলো দমাতে না পারলে হাওরের ক্ষতি হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত দেব বলেন, ৩৩ নম্বর পিআইসির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। শুধু ৩৩ নম্বর পিআইসিভুক্ত জায়গাই নয়, অনেক জায়গায়েই বাধা এসেছে। তবে আমরা বাঁধ মেরামতকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি। হুমকি-ধমকির যে ব্যাপার সেটা অন্য বিষয় নিয়ে হতে পারে। আমরা দেখছি বাঁধ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না। তারপরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। আর গত বছরের ১৭ নম্বর পিআইসি মুহিবুর রহমানকে এবার রাখা হয় নি। তার ভাই থাকতে পারে।