কুমার সৌরভ
শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এর জন্য মনোনীত হয়েছেন সুনামগঞ্জের সুসন্তান ধ্রুব এষ। সাহিত্যিকদের জন্য বাংলা একাডেমীর পুরস্কার লাভ এক বিশেষ আনন্দের কারণ। সাহিত্যক্ষেত্রে বাংলা একাডেমী পুরস্কারকে সর্বোচ্চ মানের বিবেচনা করা হয়। যদিও এই পুরস্কার নিয়ে অভিযোগেরও অন্ত নেই। তবে সারা দেশের সকল শিল্প-সাহিত্যানুরাগী নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, এবার ধ্রুব এষকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করার সিদ্ধান্তটি ছিল যথার্থ, অবিতর্কিত, অপরিহার্য এবং প্রাসঙ্গিক। দীর্ঘদিন ধরে ধ্রুব তুলি ও কলম দিয়ে শিল্প-সাহিত্য সাধনার জগতে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছেন তা এই জাতির মননশীলতাকে অনেক উপরে নিয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। নিরবে সুদীর্ঘ কালের পরিক্রমায় ধ্রুব নিজের সাহিত্য সা¤্রাজ্য তৈরি করেছেন। এই সাম্রাজ্য নির্মাণে তিনি অনেকের নিকট থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পরিণত হয়ে গেছে স্বাধীন সার্বভৌম ধ্রুবরাজ্য হিসাবেই। স্বাতন্ত্র্যবোধ দ্বারা বলিষ্ট, চেতনায় গরীয়ান, ভাবনায় মৌলিক। নিঃসন্দেহে বাংলা একাডেমী তাঁর ওই নিবেদনকে স্বীকৃতি দানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজের মাহত্ম্যকে উদ্ভাসিত করল।
শিশুসাহিত্যে ধ্রুব এষকে এবার পুরস্কৃত করা হচ্ছে। ধ্রুব পুরস্কারের জন্য বিবেচনাযোগ্য অসাধারণ কাজ করেছেন আরও বহু ক্ষেত্রে। প্রচ্ছদশিল্পে তিনি রীতিমতো বিপ্লব ঘটানোর মতো কাজ করে চলেছেন। উভয় বাংলায় এজন্য তাঁকে বিশেষ সম্মানের সাথে দেখা হয়ে থাকে। প্রচ্ছদশিল্পের গতানুগতিক ও সনাতনী ধারাকে ভেঙে দিয়ে তিনি নতুন এক আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছেন। একটি বইয়ের নাতিদীর্ঘ শরীরে রঙ ও তুলির ব্যবহারে তিনি এমন এক সা¤্রাজ্যের বিস্তার ঘটান যা সংশ্লিষ্ট রচনাকে বাঙময় করার পাশাপাশি ভিন্ন আরেক বার্তা পরিবেশন করা হয় পাঠকদের কাছে। এই বার্তা প্রদানের বিষয়টি প্রচ্ছদশিল্পীর একান্তই নিজস্ব স্টাইল। শিল্পী রঙের আঁচরের নীচে লুকিয়ে রাখেন এমন এক কল্পলোকের আখ্যান যা মানবমনের চিরকালীন আকাক্সক্ষার সাথে সম্পর্কিত। বলাবাহুল্য ওই আকাক্সক্ষা হলো বিশ্বজনীন মঙ্গলচিন্তা ও সৌন্দর্যপ্রীতি থেকে উৎসারিত। তিনি ইতোমধ্যে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকায় সংখ্যাগত দিক থেকে একক শিল্পী হিসাবে রেকর্ড করে ফেলেছেন। এই ধারায় তিনি দেশসেরা স্বীকৃতির দাবি রাখেন। শিশুসাহিত্যের সাথে তিনি দুই হাতে লিখে চলেছেন প্রচুর গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। ওই জগতেও তিনি রঙ-তুলির চিত্রশিল্পীর মতোই প্রচ- কল্পনাবিলাসী। তাঁর গল্প উপন্যাসগুলো যেমন সমাজের কথা বলে, আমাদের চেনা জগতের কাহিনীর বয়ান করে তেমনি সমকালীন ভাবনার বাইরে গিয়ে আরও কিছু কথা বলার চেষ্টা করে। তিনি এমন এক রহস্যজগতের ধূ¤্রজাল তৈরি করেন যেখানে প্রবেশ করা যায় নিজের ইচ্ছায় বেরোতে হয় লেখক যখন যবনিকা রেখা টানেন তখন। তাঁর গদ্য রচনার আঙ্গিকটিও একান্তই নিজস্ব, যা তাঁর স্বোপার্জিত সত্ত্বাও বটে। গদ্য রচনায় তিনি স্বতন্ত্র এক ভাষিক কৌশলের আশ্রয় নেন যা একদিকে চলমান বাস্তবতা থেকে উদ্গত অন্যদিকে রসবোধসঞ্জাত। কাহিনীর ভিতর টেনে নেয়ার এক অদ্ভুত মাদকতা লক্ষ করা যায় তাঁর গল্প-উপন্যাসে। এই জায়গায়ও তিনি সম্মানীয় হবেন অবশ্যই।
নিমগ্ন নির্জনতাকে পছন্দ করেন ধ্রুব। প্রাতিষ্ঠানিকতা কিংবা প্রচলিত মেকি লৌকিকতার উর্দ্ধে গিয়ে তিনি রচনা করেছেন নিজের এক ভিন্ন জগৎ। যেখানে মানবিক বোধসম্পন্নরাই কেবল জায়গা করে নিতে পারেন। নিজের গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতোই রহস্যমানব যেন তিনি। যিনি পূর্ণিমা¯œাত গহীন প্রান্তরে থেকেও নিজেকে সুচতুর কৌশলে রাখতে পারেন জ্যোৎ¯œালোকের অন্তরালে। ওই অন্তরাল থেকে তিনি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে দেখেন সমাজ, মানুষ, পরিপার্শ্ব ও সামাজিক বিধি-কানুন প্রভৃতির লীলাখেলা। তিনি চরিত্রগুলোকে দিয়ে বলিয়ে দেন নিজের ভাবনার কথা। যা সর্বদা শ্রভ্রসমুজ্জ্বল থাকে সর্বজনীন শুভবোধ দ্বারা। তিনি নিজেকে সংগোপন রাখেন সত্য কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি শিকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। বরং প্রচ- রকমের শিকড়মুখী এই শিল্পী। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাসে তাই বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে তাঁর চেনা সুনামগঞ্জ ও মানুষদের কথা। আসে সমাজ ও মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব এবং নাগরিক আনন্দ-হতাশা-রাগ ও ক্ষোভের পরিমিত প্রকাশ। চরিত্রের একেবারে ভিতরে গিয়ে তার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যকে নিংড়ে বের করে আনেন তিনি। আমরা অবাকবিষ্ময়ে ভাবি, কই প্রতিদিন দেখেও তো আমরা এমন রূপের সন্ধান পাইনি। এই তীব্র অন্তর্ভেদী শক্তিই তাঁকে অন্যদের চাইতে আলাদা করেছে।
আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন সব্যসাচী শিল্পী-সাহিত্যিক ধ্রুব। আজ যে সম্মানের পালক আপনার অস্তিত্বের স্পর্শ পেল তা আমাদেরও মহিমান্বিত করেছে। আমরাও সমান গৌরবান্বিত আপনার এই অর্জনে।
- বাঁধের কাজে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ/ একে তো নাচুনি বুড়ি তাতে পড়েছে ঢোলের বাড়ি
- এজাহারভুক্ত ১০ আসামীর জামিন