আবেগী আর্জন্টিনা

এনাম আহমদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আর্জেন্টনা। একটি ব্যতিক্রমী নাম। বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর একেবারে অন্যপ্রান্তের একটি দেশ। পৃথিবীর দুই শতাধিক দেশের মধ্যে হয়তো এই নামই জানা হতো না অনেকের। দেশটি অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক দিয়ে ততোটা সমৃদ্ধ নয়। কিন্তু আমাদের দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা এই দেশটির নাম জানে! কারণ হলো ফুটবল ফুটবল ফুটবল! এটি পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স। এখানে আদি প্রস্তর যুগের মানব বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। আর্জেন্টনা ১৮১০ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দখলদার দেশ ছিল স্পেন। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি।
আর্জেন্টিনা ফুটবল খেলা শুরু করে ১৮৬৭ সালে তবে প্রথম জাতীয় দল গঠন করে ১৯০১ সালে। প্রীতি ম্যাচ খেলে উরুগুয়ের সঙ্গে। প্রথমদিকের প্রীতি ম্যাচগুলো শুধু দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো। ১ম বিশ্বযুদ্ধের কারণে তখন ইউরোপ যাত্রা অত্যন্ত বিপদজনক ছিল।
আর্জেন্টিনা ১৯৩৪ সালে ২য় বিশ্বকাপেই রানার্সআপ হয়ে বিশ্ব ফুটবলে শক্তিমত্তা জানান দেয়! পরবর্তীতে তিনটি বিশ্বকাপ নানা কারণে বর্জন করে। মাঝে দুটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। কিন্তু এই সময়কালে আর্জেন্টিনা ৭বার কোপা আমেরিকা জয় করে! যদি আর্জেন্টিনা ঐ বিশ্বকাপ গুলোতে অংশ নিতো, তবে শিরোপার সংখ্যা অনেক বেশী হতো। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছে মোট দুইবার, ফাইনালে খেলেছে ৫বার। কোপা আমেরিকা কাপ জিতেছে রেকর্ড ১৫ বার, ফাইনাল খেলেছে ২৭ বার।
দিয়েগো ম্যারাডোনা, ফুটবলের বরপুত্র। ফুটবলের সৌভাগ্য যে, ম্যারাডোনার নামক অপেক্ষাকৃত খর্বাকৃতির এক বালক ফুটবল খেলতে নেমেছিল। তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯৭৭ সালে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিষেক হয় ম্যারাডোনার। ৮৬ সালের বিশ্বকাপটি ছিলো পরো ম্যারাডোনাময়। তার একক কৃতিত্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি ৫টি গোল করেন এবং বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার লাভ করেন। মূলত এ বছরই ম্যারাডোনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার কোটি কোটি সমর্খকের সৃষ্টি হয়। ১৯৯০ সালে ম্যারাডোনা ইনজুরি নিয়ে খেলেও দলকে ফাইনালে পৌঁছে দেন। তার জুটি ছিলো ক্যানিজিয়ার সঙ্গে। কিন্তু ফাইনালের আগেই ক্যানিজিয়াকে ষড়যন্ত্রমূলক হলুদ কার্ড দেখিয়ে ফাইনালে নিষিদ্ধ করা হয়। ফাইনালে বিতর্কিত পেনাল্টি দিয়ে আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করা হয়। এতেও বাংলাদেশের আর্জেন্টিনার সমর্থকরা অত্যন্ত আহত হন এবং তাদের সমর্থন আরো দৃঢ় হয়। কারণ এদেশের মানুষ সব সময় মজলুমের পক্ষে।
বিপ্লবী চে-গুয়েভারার জন্ম আর্জেন্টিনায়, রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী।’ রবীন্দ্রনাথের এই বিদেশিনীও ছিলেন একজন আর্জেন্টাইন। বস্তুত আর্জেন্টিনা হচ্ছে দ্রোহ ও প্রেমের অপূর্ব সংমিশ্রন! আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড দ্বীপ ছিনিয়ে নেয় বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদীবা। এতে ক্ষুব্ধ হয় বিবেক সম্পন্ন মানুষ। আবার কয়েকটি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিজয় ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে ঠেকায় ‘হলুদ’ সাম্রাজ্যবাদীরা। এতে আর্জন্টিনা শিরোপা বঞ্চিত হলেও জনসমর্থন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।
আর্জেন্টিনার আরও কিছু অসাধারণ দিক হলো ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের মধ্যে তাদের দুইজন রয়েছেন। ২য় জন হলেন লিওনেল মেসি। মেসি লা-লিগা জিতেছেন ১০বার, চ্যাম্পিয়ান্স লীগ জিতেছেন ৪বার। ১৯১৪ সালের বিশ্বকাপে পেয়েছেন গোল্ডেন বুট! সর্বমোট আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতেছেন ৩৩টি। করেছেন ৭০০’র বেশি গোল। ফিফা বিশ্বকাপ ছাড়া জিতেছেন সকল ট্রফি! এবার কী পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্র এই খেলোয়াড়ের হাতে ট্রফিটি শোভা পাবে না! অনেক তারকা খেলোয়াড় খেলবেন এবারের বিশ্বকাপে। কিন্তু মেসি হচ্ছেন ‘’তারকাদের তারকা’। গত ৩৬ বছরের মতো এরারো আর্জেন্টিনা ফেবারিট। বিশ্বকাপ ট্রফিটা এবার মেসি হাতে গেলে ট্রফিটিই সম্মানিত হবে। সর্বহারা আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে এটিই একমাত্র চাওয়া। (চলবে)

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।