মু.আবদুর রহীম
একথা সর্বজনবিদিত যে, সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। দালানের ভিত্তি যদি দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ হয় তবে তার দেয়াল, ছাদ ও কারুকার্য সবই বৃথা। কারণ সামান্য ঝড়ে, বৃষ্টি বাদলায় বা ভূমিকম্পে সে অতি সহজেই ভেঙে পড়তে পারে। ঠিক তেমনিভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ত্রুটির কারণে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাটাই বিপর্যস্ত ও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
আমাদের বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নি¤œলিখিত বিষয়গুলো আশু মনোযোগের দাবি রাখে।
(১) পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অবহেলা।
(২) শিক্ষক পদের মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধার স্বল্প আকর্ষণীয়তা।
(৩) ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা ব্যবস্থা।
(৪) বিদ্যালয় ভবন ও শিক্ষকবৃন্দকে শিক্ষা বহির্ভূত কাজে ব্যবহার।
(৫) শিক্ষার্থীদের অননুমোদিত প্রতিযোগিতা ও মেধাক্ষয় নিবারণে ব্যর্থতা।
(৬) শিক্ষক শিক্ষিকাদের আবাসন সমস্যা।
বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
(১) আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্য সাহিত্য পুস্তকে আগে ‘কুরআনের বানী’, ‘হাদীসের বানী’, ‘নবীর শিক্ষা’ ইত্যাদির উপর কবিতা থাকত। এখনকার সাহিত্য পুস্তকে থাকে ‘হাট্টিমা টিম টিম’ অথবা ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়া ডোম সাজে’ ইতাদি। ধর্মীয় বিষয় থাকে খুবই কম। সাহিত্য মানুষের জন্য। সাহিত্য মানব জীবনের কথাই বলে। মানুষের জীবনের প্রধান চালিকা শক্তি ধর্ম। আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভাল কাজ ও মন্দ কাজের জন্য পরকালে জবাবদিহিতার ধারণা মানুষকে ভাল কাজ করতে উৎসাহিত ও মন্দ কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে। আমাদের নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কেবলমাত্র ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবেই সমাজে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা আজ মিথ্যাবাদিতা, চৌর্যবৃত্তি, প্রতারণা সহ নানা প্রকারের অন্যায় অনাচারে দেশ ও জাতির গায়ে দুরপনেয় কলঙ্ককালিমা লেপন করেছেন। তাই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখী সুন্দর জীবনের স্বার্থে আমাদের আজকের শিশুদের পাঠ্য সাহিত্য পুস্তকে প্রচুর সংখ্যায় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষামূলক পাঠ অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
(২) শিক্ষকই শিক্ষাব্যবস্থার মূল কারিগর। যোগ্য শিক্ষক ছাড়া যে কোন শিক্ষা পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর সামনে জীবন্ত আদর্শ। সমাজের সবচেয়ে মেধাবী, দক্ষ, চরিত্রবান ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণই হবেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পাওয়ার যোগ্য। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা সমূহের শিক্ষক নিয়োগে এই ধরনের উপযুক্ত লোক আকৃষ্ট হওয়ার মত ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন ক্ষেলের উন্নয়ন বাঞ্ছনীয়। সফল শিক্ষাদানের যোগ্যতায় সাথে সাথে শিক্ষকের সংখ্যাও গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায় অনেক বিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক আছেন কিন্তু শিক্ষার্থীর সংখ্যানুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা কম। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে এ বিষয়টি উপক্ষেনণীয় নয়।
(৩) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে ভাষায়, বাক্যে, বানানে ও ছাপার মধ্যে কোন দুর্বোধ্যতা, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তির অবকাশ না থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, প্রশ্নপত্রে নানা রকমের ভুলের ছড়াছড়ি থাকে। এগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শিক্ষককে কচি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিষয়ক লালন পালনে মা-বাবার মত নিরাপদ আশ্রয় স্বরূপ হতে হবে। অপরিচিত জনের উপস্থিতি তাদের মনে ভয়ের উদ্রেক করে। সমাপনী পরীক্ষার সময় দেখা যায় কচি শিক্ষার্থীদের হলে নিজের স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকার স্থলে অপরিচিত নতুন শিক্ষকরা উপস্থিত হন। এতে শিশু শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভড়কে যাওয়া ও বিব্রত বোধ করা স্বাভাবিক। একারনে অন্তত: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেলায় এ ব্যবস্থা বর্জনীয় বলে মনে করি। পিতৃমাতৃসম শিক্ষক শিক্ষিকাদের সন্দেহ করে তাঁদেরকে সত্যি সত্যি সন্দেহভাজন করে তোলা কোন বিচারেই যুক্তিযুক্ত নয়। তাদেরকে নিজ নিজ ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষায় কক্ষ পরীক্ষক নিযুক্ত করে বিশ্বস্ত ও সমদর্শী হওয়ায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শরৎচন্দ্র ঠিকই বলেছেন,‘মানুষকে অবিশ্বাস করে লাভবান হওয়ার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকাও ভাল।’
এ প্রসঙ্গে কিছু কথা না বলে পারছি না। আমরা অতি আধুনিক হয়ে কিছু অভিনব শব্দ মুখস্ত করে ফেলেছি। এ গুলোর মধ্যে স্বজনপ্রীতির স্থান বেশ উপরে। স্বজন প্রীতি নাকি দূষণীয়। আসলে স্বজনের প্রতি ভালবাসা তো মনুষ্যত্বেরই পরিচায়ক। তাই সুস্থ সুন্দর মানুষ হতে হলে স্বজনকে ভালবাসতেই (বা প্রীতি করতেই) হবে। আমাদের ধর্মও বলে, স্বজনকে ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ। প্রকৃতপক্ষে যারা স্বজন প্রীতি দূষণীয় বলেন তারাও স্বজনপ্রীতির দ্বারা অবিচার বা পক্ষপাতিত্ব বুঝাতে চান। কিন্তু কেন? আমরা উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবো কেন? তথাকথিত ‘স্বজনপ্রীতি’ আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভেবে দেখা যাক। আমি শিক্ষক। আমার স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষা আমি নিতে পারবো না, কারণ স্বজনপ্রীতি হতে পারে। আমি শিশুর মা। আমার শিশুকে আমি লালন পালন করতে পারবো না, কারণ স্বজনপ্রীতি হতে পারে। তাই আমার সন্তানকে লালন পালন করবে ও বাড়ীর শিমুর মা আর ও বাড়ীর শিশুকে লালন পালন করবো আমি। তা হলে স্বজন প্রীতির সম্ভাবনা থাকবে না। বিষয়টা কেমন মনে হয়? আমরা কি মানুষের স্তরে থাকি?
(৪) বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারী ও সরকার অনুমোদিত সামাজিক কাজে বিশেষ করে বন্যা পীড়িতদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ও কোন ব্যাংকের কর্মচারী অথবা স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী নিযুক্তির পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিন্তার বিষয় এসব কারণে কচি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া, শিক্ষক শিক্ষিকাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে পোলিং প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ভোটার তালিকা তৈরির কর্মী হিসেবে রোগ প্রতিরোধ টিকাদান কর্মী ও সহযোগি হিসেবে এবং আদমশুমারীর কর্মী হিসেবে প্রায় অপরিহার্য রূপে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ যেন ‘গরীবের বউ সকলের ভাবী’। এসব কাজেও বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কচি শিক্ষার্থীরা এভাবে বছরের পর বছর তাদের নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আর নিরপরাধ শিক্ষক শিক্ষিকাগণকে বিদ্যালয়ের নি¤œপাশের হারের জন্য কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও জাতীয় সার্বজনীন শিক্ষার স্বার্থে এ ব্যপারে বিকল্প চিন্তা ভাবনা করা এখনকার সময়ের দাবি।
(৫) সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েক বছর ধরে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কিছু সংখ্যক শিক্ষানুরাগী সম্পদশালী ব্যক্তি স্কুল শিক্ষার্থীদেরকে অধিকতর যোগ্যতা অর্জনে উৎসাহী করার উদ্দেশ্যে নিজেদের অথবা তাঁদের কোন লোকগত আত্মীয়ের নামে ট্রাস্ট গঠন করে বৃত্তি প্রদানের ধারা চালু করেছেন। তাঁদের এ ধরনের কার্যক্রমে আমরাও অনুপ্রাণিত হয়ে অংশগ্রহণ করেছি। শিক্ষার্থীরা এবং তাঁদের অভিভাবকগণও এতে স্বত:স্ফূর্ত সাড়া প্রদান করেছেন। প্রথম প্রথম স্বল্প সংখ্যক উদ্যোক্তা এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। ইদানীং উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছি। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা অনেকগুলো বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এতে যেন তাদের মূল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। কোন কোন সচেতন অভিভাবকের কাছে মনে হচ্ছে এ যেন চারা গাছে অতিরিক্ত পানি দিয়ে মেরে ফেলার মত অথবা অতি উৎসাহী মায়ের শিশুর ঘুম খেলাধুলা বন্ধ করে পড়াতে গিয়ে তার স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করার মত হয় যাচ্ছে। কেউ কেউ বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখছেন। বিদ্যালয় হচ্ছে মানসিক চিকিৎসালয়। ছাত্ররা হচ্ছে রোগী। বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ হচ্ছেন তাদের চিকিৎসক। শিক্ষক ও চিকিৎসকগণ এক ভাবে প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন, অন্যদিকে অশিক্ষক চিকিৎসকগণ অন্যভাবে প্রেসক্রিপশন লিখছেন। এতে বিভিন্ন চিকিৎসকের বিভিন্নমুখী চিকিৎসায় ছাত্ররূপ রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমি আমার নিজের শিক্ষক জীবনে দেখেছি
Ñদশম শ্রেনীর এক ছাত্রকে উড় শব্দটি পড়তে বলায় সে পড়লো ‘ডো’। আমি বললামÑএটা তোমাকে কে শিখিয়েছেন? সে বললÑ কেন স্যার? আমাকে অমুক স্যার (গৃহ শিক্ষক) শিখিয়েছেন। জিও যদি গো হয় তবে ডিও ডো হবে না কেন? ঊ্যস, আমি আর কী করি, আমি হতভম্ব। ঐ ছাত্রটিকে ‘ডু’ উচ্চারণ শেখাতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। এ প্রসঙ্গে আমার একটি গল্প মনে পড়েছে। এক গানের ছাত্র কোন এক গানের শিক্ষকের কাছে গিয়ে বললোÑ ওস্তাদ, গান শিখতে আমার কতদিন লাগবে? ওস্তাদ বললেনÑতিন বছর। ছাত্র বললোÑ আমি দুই বছর ওমুক ওস্তাদের কাছে গান শিখেছি, আমার কি এক বছরে হবে না? ওস্তাদ বললে- ওরে বাবারে, তোমার ত পাঁচ বছর লাগবে। ছাত্র বললÑ কেন ওস্তাদ? ওস্তাদ বললেনÑতোমার দুই বছরের ভুল শিক্ষা ছাড়াতে আমার লাগবে দুই বছর। তারপর আমার তিন বছর আছেই। এবার বুঝ হ সাধু যে জানো সন্ধান।
সরকারের শিক্ষা বিভাগ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন কি?
বর্তমান অবস্থায় আমার মনে হয়, শ্রদ্ধেয় বৃত্তি পরীক্ষা সংগঠকগণ বৃত্তি প্রদানের জন্য কোন আলাদা পরীক্ষা না নিয়ে প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিদ্যালয়ে সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কর্তৃক সত্যায়িত নম্বরের ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
(৬) শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু শিক্ষার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের আবাসন সমস্যার সমাধান জরুরী। কিন্তু বলাই বাহুল্য বর্তমান সরকারের শিক্ষাখাতে এত টাকা নেই যে তাদের জন্য বিদ্যালয় সংলগ্ন কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করবেন। অথচ শিক্ষক শিক্ষিকাকে বাসস্থানের জন্য অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একারণে অনেক শিক্ষক শিক্ষিকার কাছ থেকে উপযুক্ত শিক্ষাসেবাও পাওয়া যাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা বটে। আমরা মনে করি, যতদিন বিদ্যালয় সংলগ্ন কোয়ার্টার না হচ্ছে ততদিন শিক্ষক শিক্ষিকাদেরকে নিজ নিজ বাড়ীর কাছাকাছি কোন বিদ্যালয়ে নিযুক্তি দানের ব্যবস্থা করে আপাতত: এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে আমরা কিছু অসংলগ্ন ও আংশিক চিন্তা ভাবনা তুলে ধরলাম। আমি মনে করি বিজ্ঞ পাঠক পাঠিকাগণ আমার আলোচনার ত্রুটি বিচ্যুতি নিজেদের অন্তরের সহানুভূতি দিয়ে সংশোধন করে নেবেন।
লেখক: প্রবীণ শিক্ষক ও লেখক।
- ‘দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর’ মানুষের কথা বলে
- হায়দার আলীর স্বপ্ন