উন্নয়নে পিছিয়ে জামালগঞ্জ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
‘যেকোন সরকারের চেয়ে এ সরকারের আমলে উন্নয়ন হয়েছে এটা অনস্বীকার্য। তারপরও আক্ষেপ আছে। সাচনা বাজার থেকে জামালগঞ্জের ফেরি পারাপারের দুর্ভোগ এখনও মিটেনি। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার অনেক সড়কই ভাঙ্গাচূরা। বলতে গেলে টেকসই দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন হয় নি জামালগঞ্জে।’ কথাগুলো বলেন, উপজেলা খেলাঘর আসরের সভাপতি আলী আক্কাছ মুরাদ।
বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে দেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। দেশের অন্যান্য জেলা-উপজেলায় যেভাবে উন্নয়ন কাজ হয়েছে, সে তুলনায় জামালগঞ্জ ঢের পিছিয়ে আছে। এখানে দেখার মতো কোন উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন না হওয়ার আক্ষেপ আছে মানুষের মাঝে। যদিও জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা উড়াল সেতু নির্মাণের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া শিক্ষা, যোগাযোগ, কৃষি, বিদ্যুৎসহ নানা ক্ষেত্রে জামালগঞ্জে যা উন্নয়ন হয়েছে, তাও টানা চৌদ্দ বছর ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বলছেন সচেতন মানুষেরা।
এই সরকারের সময়কালে দেশের অন্যান্য এলাকার মত উন্নয়ন হয় নি জামালগঞ্জে। কবে হবে তা নিয়ে সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে গিয়ে হচ্ছে-হবে কিংবা প্রক্রিয়াধীন আছে এমন বক্তব্যে আটকে আছে জামালগঞ্জের সম্ভাব্য টেকসই উন্নয়ন। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্বস্তি আছে। দিন দিন এ অস্বস্তির মাত্রা আরও ঘনীভূত হচ্ছে ধারণা সচেতন মানুষের।
বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, আ.লীগের ক্ষমতার চৌদ্দ বছরে দেশব্যাপী যে উন্নয়ন হয়েছে জামালগঞ্জ তা থেকে ঢের পিছিয়ে আছে। ক্ষমতার দীর্ঘ সময়কালে এ উপজেলায় উল্লেখ করার মতো বৃহৎ কোন উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হয় নি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে আ.লীগ ক্ষমতায় আসলে এখানকার মানুষ আশান্বিত হয়। জেলা সদরের সাথে নির্ভীক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, আভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন রোধ, নদী ও খাল খননসহ পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয় মানুষের। কিন্তু এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতাকালে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলছেন এলাকাবাসী। তবে সম্ভাব্য সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা উড়াল সেতু নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন হলে এ এলাকার মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটা অন্যরকম হতে পারে জানিয়েছেন কেউ কেউ।
জামালগঞ্জ-সাচনা বাজার সেতুর প্রতীক্ষা : সুরমার দুই পার মিলিয়ে জামালগঞ্জ উপজেলার বিস্তৃতি। পূর্বপারে ভাটির বন্দরখ্যাত সাচনা বাজার। পশ্চিম পার জামালগঞ্জে সব সরকারি দপ্তর, উপজেলা পরিষদ, হাসপাতাল, ব্যাংক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উভয় পারের দুই লক্ষাধিক মানুষকে জরুরী প্রয়োজনে প্রতিনিয়তই খেয়া পার হতে হয়। তাতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় ছাত্রছাত্রী, জরুরী রোগী, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, যাত্রীসহ সাধারণ মানুষকে। দ্বিখ-িত উপজেলার ছয় ইউনিয়নের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে প্রধানমন্ত্রীর পূর্বপ্রতিশ্রুতি ছিল। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর তাহিরপুরের এক জনসভায় শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জের উন্নয়ন প্রুতিশ্রুতির সাথে জামালগঞ্জ-সাচনা বাজার সেতুর বিষয়টি যুক্ত করেছিলেন। প্রতিশ্রুতির এক যুগেও সেতু নির্মাণের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। আদৌ হবে কী না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
নয়মৌজার দুঃখ তেরানগর সেতু : উপজেলার ভীমখালী ও ফেনারবাঁক ইউনিয়নের সংযোগস্থল তেরানগর গ্রামসংলগ্ন দৌলতা নদীর উপর দ-ায়মান সেতুটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। শুকনো মৌসুমে তেরানগর সেতু দিয়ে পাগনা হাওর পারের দিরাইয়ের ভাটিপাড়া ও রফিনগর এবং জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ও ভীমখালী ইউনিয়নের অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ যাতায়াত করে। জনগুরুত্বপূর্ণ এ পথে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নির্মিত সরু সেতুটি এখন পথের কাঁটা। নি¤œমানের কাজে ধারণক্ষমতাশূন্য সেতুটিকে প্রায় দশ বছর আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করে উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তারপরও পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করছে। সেতু পার হতে গিয়ে দুইজনের মৃত্যু, গবাদি পশুসহ শতাধিক মানুষ আহতের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। চরম ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি পুনঃনির্মাণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কোন দায় নেই। মাঝে মধ্যে দায়সারা গোচের কাজ করে সেতুটিকে কোনরকম চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা করা হয়। এতে যাতায়াতকারী নয়মৌজাখ্যাত বৃহৎ এলাকার প্রায় শতভাগ ভোট ক্ষমতাসীন দলের বাক্সে পড়লেও দীর্ঘ ক্ষমতাকালে কারও সুদৃষ্টি পড়েনি এই এলাকায়। এ অবস্থায় স্থানীয়দের মাঝে চরম অসন্তোষ দানা বাধছে।
অভ্যন্তরীণ সড়কেও ভঙ্গুর অবস্থা : জামালগঞ্জের অভ্যন্তরীণ সড়কে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। গ্রামীণ সড়কের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রায় বেশির ভাগ সড়কই খানাখন্দে ভরপুর। সাচনা বাজার থেকে দুর্লভপুরমুখী সড়ক, সাচনা বাজার-বেহেলী সড়ক থেকে রহিমাপুর অনন্তপুর সড়ক, জামালগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নয়াহালট সড়ক, জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জের প্রধান সড়ক থেকে লালবাজার-কারেন্টেরবাজার সড়কসহ উপজেলা সদরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এমন অনেক সড়ক আছে যেগুলো টেকসই উন্নয়নের বাইরে রয়ে গেছে। যদিও সড়কগুলো অতীতে কমবেশি পাকাকরণ হয়েছে তবে অপ্রশস্ত ও নি¤œমানের কাজের কারণে এখন চলাচল অনুপযোগি হয়ে পড়েছে সড়ক। জনগুরুত্বপূর্ণ এসব সড়কে চলতে গিয়ে ছোটখাটো দুর্ঘটনাসহ মারাত্বক ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে, প্রথিতযশা রাজনীতিক প্রয়াত কমরেড বরুণ রায়ের জন্মস্থান বেহেলী থেকে সাচনা বাজার পর্যন্ত রাস্তাটি এখনও আবুড়া হয়নি। উপজেলা সদর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের বেহেলী বাজার ও বেহেলী গ্রামের মধ্যবর্তী বৌলাই নদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবিও উপেক্ষিত। কবে নাগাদ এসব কাজ বাস্তবায়ন হবে তাও জানেন না স্থানীয়রা। এ নিয়ে প্রচ- আক্ষেপে পুড়ছে সাধারণ মানুষ।
নদী ভাঙ্গনে বিলীন জনপদ : সুরমার আগ্রাসী তা-বে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা জামালগঞ্জের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের। বাপ-দাদার পুরোনো ভিট বেশ আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অনেকের। নদীর ভয়ংকর আগ্রাসনে ধসে পড়েছে অনেক সাজানো বাড়ি। এ থেকে বাদ যায়নি মসজিদ, স্কুল ও রাস্তাঘাট। নদীর কড়াল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসেছে অসংখ্য পরিবার। যুগ যুগ ধরে আগ্রাসী নদীর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন জামালগঞ্জের নূরপুর, সোনাপুর, চাঁনপুর, মমিনপুর, গজারিয়া, উজান লালপুর বাজার, রামপুর ও আমানীপুর (বর্মণ পাড়া) সহ উপজেলার ১০-১৫টি গ্রামের মানুষ। দিন দিন সংশ্লিষ্টরা শুধু আশ্বাস-প্রশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতিতে দেশ এগিয়ে গেলেও ভাঙ্গন রোধে এগিয়ে আসেনি কেউ। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে ভাঙ্গন কবলিত মানুষের।
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, সত্যিকার অর্থেই উন্নয়নবঞ্চিত আমরা। নৌকার বদলে মানুষ হয়তো এখন গাড়িতে চড়ে শহরে যাচ্ছে। কিন্তু ভাটির বন্দর সাচনা বাজারে এখনও একটি পাবলিক টয়লেট হয়নি। একটু বৃষ্টি হলে ড্রেনের অভাবে কাদা জমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে গোটা সাচনা বাজার। বাজারে আসা মানুষের দুর্ভোগ দেখলে উন্নয়ন তৃপ্তির বদলে অতৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম কলমদর বলেন, মুখে মুখে অনেক উন্নয়নই দেখানো যাবে। তবে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর মতো কিছু হয়নি। গ্রাম হবে শহর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাটা অন্তর দিয়ে অনুধাবন করি। বিগত চৌদ্দ বছরে দেশ ডিজিটাল হয়েছে। ডিস এন্টিনা সংযুক্ত চ্যানেল দেখছে মানুষ। কিন্তু জামালগঞ্জ-সাচনা বাজারের ফেরি পারাপারের দুঃখ মোচন হয় নি। তাহলে কী উন্নয়ন হলো জামালগঞ্জের।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, দেশব্যাপী রেকর্ড উন্নয়ন হলেও জামালগঞ্জের চিত্র ভিন্ন। দুই এমপির আন্তরিকতার অভাবে নৌকার ভোট ব্যাংক হিসাবে পরিচিত হিন্দু অধ্যুষিত নয়মৌজার যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটেনি। যার সাক্ষি তেরানগর পরিত্যক্ত সেতু। শুধু তাই না, জামালগঞ্জের উপকণ্ঠে ইকবাল মার্কেটের সামন থেকে শাহপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত সড়কসহ অনেক রাস্তায়ই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. শামীমা আক্তার খানম বলেন, চৌদ্দ বছর আগে কী ছিল, আ.লীগের আমলে কী হয়েছে, জামালগঞ্জের মানুষ তা জানে। করোনা মহামারী আর ইউক্রেন সঙ্কটে উন্নত দেশগুলোই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের উন্নয়ন কাজ চলমান আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে জামালগঞ্জের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের উড়াল সেতু হচ্ছে। জামালগঞ্জ-সাচনা বাজার সেতু ও তেরানগর সেতু প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে। করোনা ও ইউক্রেন সঙ্কট না থাকলে এগুলো হয়ে যেত।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বললেন, সাচনা বাজার ও জামালগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ সড়ক, হাওরে সাব-মার্সিবল রাস্তাসহ অনেক রাস্তাই হয়েছে, এগুলো কী আগে ছিল? আ.লীগের আমলে রেকর্ড উন্নয়ন হয়েছে। বিরোধি পার্টি যারা আছে তারা এগুলো দেখবে না। উড়াল সেতুর কাজও হবে। সাচনা বাজার-জামালগঞ্জ সেতু কিছুদিনের মধ্যে টেন্ডারে যাবে। তেরানগর সেতুরও টেন্ডার হবে। আর ভরতপুর ব্রিজের কাজটা রোডস এন্ড হাইওয়ের বাধার কারণে আপাতত হচ্ছে না।