বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ থেকে
সোনালী ফলন বুকে নিয়ে এতদিন দায়বদ্ধতার জালে আবদ্ধ ছিল বিস্তীর্ণ হাওর। খেয়ালী প্রকৃতির আনুকূল্যতা স্বীকার করে হাওর সেই দায়মুক্তির কাজটা বেশ ভালোভাবে সেরে নিয়েছে। এ বছর হাওরের বুক থেকে সোনালী ফলন ও খড় (গোখাদ্য) কুড়িয়ে কৃষক ঘরে ফিরেছে ভরা হাতে। বোরোর বাম্পার মৌসুম খাটিয়ে হাওর এখন সম্পূর্ণ ফলনমুক্ত। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের উৎসব শেষে বিশাল হাওরের উন্মুক্ত ডেরা গরু-বাছুরের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
পরিত্যক্ত ন্যাড়ায় ধূসর হওয়া হাওর এখন বর্ষার ভাসান জলে ভেসে চলার ক্ষণ গুণছে। তবে একফসলী হাওর দু’হাত ভরে দিয়ে গেলেও হাওরের কাছে কৃষকের আবদান যেন ফুরায় না। নদীতে পানির চাপ কম থাকলে মাছখেকোদের ফসলরক্ষা বাঁধ কাটার সুযোগ না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন হাওরাঞ্চলের মানুষেরা। সেই পর্যন্ত ডেমি ধান সংগ্রহ ও গরু-বাছুর ঘুরেফিরে খাওয়ার সুবাদে গোখাদ্য সাশ্রয় হবে, এমন মন্তব্য হাওরপাড়ের মানুষের।
কৃষকসহ হাওর সচেতন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, বৈশাখী দাওয়া শেষে হাওর একদম সুনসান হয়ে পড়ে। তাতে পানি এলে হাওরের বুকে অন্যরকম ব্যস্ততা কাজ করে। তবে হাওর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগে একটু সময় পেলে হাওর তীরবর্তী মানুষের দুই রকম উপকার হয়। এ সময়টায় গরু-বাছুর বাধাহীনভাবে চলেফিরে খেতে পারে। তাতে কৃষকের জমানো খড়ের একটা অংশ অবশিষ্ট থাকে। সে খড় দিয়ে পরবর্তী শুকনো মৌসুমের মাসদুয়েক চলে কৃষকের।
এছাড়া হাওর জাগনা থাকলে পরিত্যক্ত ধান গাছে নতুনভাবে ডেমি গজায়। তাতে অল্পদিনেই ধান জন্মে এবং কাটারও উপযুক্ত হয়। ডেমি ফলন প্রথম উৎপাদনের ধারেকাছে না থাকলেও কিয়ারপ্রতি যা হয়, তা দিয়ে কৃষিশ্রমিকসহ কৃষিজমিহীন গরীব মেহনতি মানুষের খোরাকি সহায়তা মিলে। এতে করে ডেমি ও গরু চড়ানো দুইয়ে মিলে সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের প্রায় লক্ষাধিক পরিবার বাড়তি সুবিধা ভোগ করবে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। তার বিপরীতে মাছখেকো গুটিকয়েক ব্যক্তির বাঁধ কাটা সম্পর্কিত অপচেষ্টা রোধের দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিনে বোরো আবাদ হয়েছে। জেলার প্রায় ৪ লাখ চাষী পরিবার এই জমি আবাদ করেছে। হাওরাঞ্চলখ্যাত সুনামগঞ্জে ছোট-বড় ১৪২টি হাওর রয়েছে। এ হাওরগুলোতে বিগত কয়েক বছর ফলন তুলতে বৈশাখ পার হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রায় সপ্তাহ দুয়েক সময় লেগেছে। তবে এ বছর কৃষি অধিদপ্তরের জোর তদারকি, যান্ত্রিক সহায়তা ও কৃষকের দিনরাত পরিশ্রমের ফলে বৈশাখ মাসের ভেতরেই প্রায় সব হাওরে ধান কর্তন সুন্দরভাবেই শেষ হয়েছে।
হাওরাঞ্চলে প্রায় বছরেই ধান কাটা শেষ করতে না করতেই পানি চলে আসে। কিন্তু বোরোর সদ্য গত হওয়া মৌসুমটা সবদিক থেকেই ব্যতিক্রম ছিল। চলতি বছর একটু আগেভাগেই ধান কাটা শেষ হলেও নদীতে পানি আসার তাড়া নেই। ঋতুকাল অনুযায়ী বর্ষা আসতে এখনও পুরো জ্যৈষ্ঠ মাস বাকি। এ সুযোগে ডেমি সংগ্রহ থেকে শুরু করে গরু-বাছুরের খাবার সুবিধা জানিয়ে অনেকে বলতে চাইছেন নদীতে পানির অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না হলে বাঁধ কেটে হাওর তলানোর দরকার নেই। এতে জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরপাড়ের মামুদনগর গ্রামের কৃষক সাদিকুর রহমান জানিয়েছেন, কৃষকের কাটা-দাওয়া শেষ। হাওরও পুরোপুরি খালি। গোটা হাওর এখন গোচারণ ভূমি। ধান কেটে নেওয়ার পর তাতে আরেক দফা নয়া ফলন হয়। দিন আনে দিন খায়, অর্থাৎ দিনমজুর শ্রেণির লোকেরা ওই ডেমি ফলন কাটে। তাতে হাওরপাড়ের কমপক্ষে ৩০ ভাগ লোকের খাদ্য সংস্থান হয়। হাওর শুকনা থাকলে এই উপকারটুকু হবে মানুষের।
জামালগঞ্জের হালি হাওরপাড়ের ক্ষুদ্র কৃষক রাধিকা রঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘পানি দেরিতে আইলে হাওরে ডেমি হইব। গরীব-দুঃখী যারা আছে তারা খোরাকের লাগি ডেমি ধান খাডে (কর্তন করে)। আমিও ডেমি কাটমু। কিয়ারপ্রতি ৩-৪ মণ, ভালা হইলে ৬-৭ মণও হয়। এই সময়ে গরু-বাছুরও ঘাস খাইয়া তাজা হয়। খেড়েরও আয় হয়।’
এ ছাড়া তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভাইস্যা মাসে (বর্ষাকালীন সময়) ঢেউ থাইক্যা বাঁচতে বাড়ি-ঘরের চতুর্দিকে আড় দেওয়ার লাগি হাওর থাইক্যা ছাইল্যা বন খাইট্যা (কর্তন করে) আনি। হাওর জাগনা থাকলে সবদিক দিয়াই ভালা। কিন্তু একটা সমস্যা- গাঙে একটু পানি হইলে মাছ মারার লাগি বাঁন কাইট্যা দেয়। এইডা যাতে না করতে পারে, হখলের খেয়াল রাখা দরকার।’
হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, হাওরে এখন ডেমি ধান হবে। গরু ঘাস খাবে। এতে কৃষকের মাঝে দরিদ্র্য যে শ্রেণিটা আছে তার বেশ উপকার হবে। আবার সময়মতো হাওরে পানি না ঢুকলে মাছের চলাচলও বাধাগ্রস্ত হবে। দুটো দিকই বিবেচ্য বিষয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে কৃষকের সাথে মতবিনিময় করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জেলা কৃষক সমিতির আহ্বায়ক চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, প্রকৃতির নিয়মে পানি আসলে হাওর এমনি এমনিই তলিয়ে যাবে। হাওর দেরিতে ডুবলে কৃষক থেকে শুরু করে যারা জমিজমা তেমন করে না তাদের লাভ হয়। ডেমি ধান কেটে বছরের খাদ্য খোরাকি পেয়ে যায় তারা। গরুবাছুর ছোটা খেয়ে রিষ্টপুষ্ট হয়। খড়ের দিক থেকে কৃষকের অনেক আয় হয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বাঁধ ভাঙ্গতে এত তোড়জোড় কেন? বাঁধ কেটে দিলে কাটা স্থানে প্রতি বছর বড় ধরনের খোড়ের সৃষ্টি হয়। আবার সেই খোড় বাঁধতে গিয়ে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত হাওরের বস্তি কান্দা কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে কী জীববৈচিত্র্য ঠিক থাকছে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানিয়েছেন, ধান কাটার পর মুড়ি ফসল অর্থাৎ ডেমি ধান উৎপাদনে সময় লাগে প্রায় দুই মাস। সেই সময় তো আর পাওয়া যায় না। এর আগেই পানি এসে যায়। আর যদি ডেমি ফলন হয় তাহলে বিঘাপ্রতি এক থেকে দেড় মণ হতে পারে। একটু বাড়তি ফলন পেতে হলে ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। তবে এরকম পরামর্শ দেওয়া হয় না। কারণ সুনামগঞ্জে এ রকম সুযোগ সৃষ্টি হয় নি। ২০২১ সালে নাকি ডেমি ধান হয়েছিল। তবে কী পরিমাণ হতে পাওে, এর কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
তিনি আরও জানিয়েছেন, হাওরে পানি না আসলে গোখাদ্য এবং ডেমি ধান হওয়ার সুযোগ আছে। এতে বাঁধ কাটা না কাটার বিষয়টি যেহেতু এসেছে সেহেতু আগামী সমন্বয় সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখা জরুরী বলে জানিয়েছেন তিনি।
- শিক্ষকদের মদপানে সহযোগিত/া চাকুরী গেল পাহারাদারের
- বেহাল টাউন হল