স্বপন কুমার দেব
১৯৪৭ সালে অখন্ড ভারত বিভক্ত হয়। বৃটিশ শাসক ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। পরদিন ১৫ই আগস্ট ঘোষিত হয় ভারত বা ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা। এই বিভক্তি ও স্বাধীনতার পেছনে ধর্ম এক বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্না, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, সি.আর দাস প্রমুখের নাম ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অনেকেই শুনেছেন এবং তাদের সম্পর্কে জেনেছেন। সেই তুলনায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ অনেকটাই আড়ালে রয়ে গেছেন। যেহেতু ভারত বিভক্তি ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে ধর্মের এবং জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের একটি বড়সড় ভূমিকা ছিল সেই হেতু মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিতে ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আলোকপাত করা এবং মৌলানা আবুল কালাম সাহেবের রাজনৈতিক ভূমিকা এবং একই সঙ্গে জিন্নার কার্যক্রম ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা জানতে ও জানাতে চেষ্টা করাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। গান্ধীজির চোখে এই লেখায় কেবল ধর্মের কথা বলা হলেও প্রাসঙ্গিকভাবে অন্যান্য বিষয়ে গান্ধীসহ অনেকের নামই আসবে। মূলত: বিভিন্ন গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে তথ্য নির্ভর করার প্রচেষ্টা করেছি। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার কোন সুযোগ আমার ছিল না। কারণ আমার জন্ম ১৯৪৭ সনের আগস্ট মাসের কিছুটা পরবর্তী সময়ে। এই লেখাতে প্রকৃতপক্ষে আমার নিজস্ব কোন মত বা অভিমত স্থান পায়নি।
(১) মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিতে ধর্ম: মহাত্মা গান্ধীর সারা জীবনটাই এক ধরনের পরীক্ষামূলক। সত্যকে নিয়ে পরীক্ষা, অহিংসা নিয়ে পরীক্ষা এবং সর্বশেষ ব্রহ্মচর্য নিয়ে পরীক্ষা। অহিংসা নিয়ে পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের ভিতর থেকে বিদ্বেষ-বিষ নির্মূল হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য। আর ব্রহ্মচর্য সাধনার লক্ষ্য ছিল নিজের ভেতর থেকে রাগ, অনুরাগ ও আসক্তির বীজ সমূলে উৎপটিত হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা। এই রাগ-দ্বেষই হচ্ছে ইন্দ্রিয় সর্বস্ব জীবনের মূল বন্ধন। মহাত্মা গান্ধী বিচার বিশ্লেষণ করে উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বরকে কোনদিনই কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়, কারণ ঈশ্বর ইন্দ্রিয়াতীত। ঈশ্বরকে অনুভব করা যায় যদি আমরা নিজেদেরকে ইন্দ্রিয়স্তর থেকে গুটিয়ে আনতে পারি। গান্ধীজির মতে, বিশ্বাস ও সহানুভূতি সহকারে বিভিন্ন ধর্মের শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করা প্রতিটি সু-সংস্কৃত মানুষের কর্তব্য। তিঁনি চাইতেন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকেরা পরস্পরের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করুক। তিঁনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও বিশ্বাস করতেন সব ধর্মই সমান এবং পরলোকের ধর্মবিচারে ইহলোকের কর্মই একমাত্র মানদন্ড। ইন্দ্রিয় সংযমের উপর তিনি অত্যন্ত জোর দিতেন। তিনি নিজে গোঁড়া হিন্দু হলেও তাঁর বিশ্বাসের সঙ্গে অন্য ধর্মের কোন বিরোধ দেখতেন না। সর্বোচ্চ উদারতার উপরে গান্ধীর ধর্ম বিশ্বাস ছিল আধারিত। খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, নিউ টেষ্টামেন্ট তাঁকে অমিত আনন্দ ও সান্তনা দিয়েছিলো এবং এই হর্ষ আস্বাদন করেছিলেন ওল্ড টেষ্টামেন্টের কিছু অংশ পাঠ করার পর। তিনি বলেছেন, তাঁর কাছে যদি গীতা না থাকে বা যদি এর সব কিছু ভুলেও যান কিন্তু একখন্ড বাইবেল পেয়ে যান তাহলে তা থেকে গীতা পাঠের মতোই আনন্দ পাবেন। যীশু খ্রিষ্টকে ঈশ্বর পুত্র বলেই তিঁনি বিবেচনা ও স্বীকার করতেন। ক্রশবিদ্ধ যিশুর চিত্র দেখে গান্ধীজি অনুভব করেছিলেন ব্যক্তির মতো জাতিকেও দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করতে হয়, অপরকে দুঃখ দেয়ায় আনন্দ নেই, স্বেচ্ছায় স্বয়ং নিগ্রহ বরণ করাতেই আনন্দ। বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে গান্ধীজি এই বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, অনেকের মতে বুদ্ধদেব ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না বরং বিশ্বব্রহ্মান্ডে নৈতিকতা বা নৈতিক বিধানই স্বয়ং ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করতেন। গান্ধীজির মতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রকারান্তরে ঈশ্বর বিশ্বাসী। ঈশ্বরের বিধান শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়। নৈতিকতা ঈশ্বরের বিধান। বিধান থেকে ঈশ্বরকে পৃথক করা যায় না। বৌদ্ধ ধর্মে ‘নির্বান’ অর্থ অস্তিত্বের চিরবিলুপ্তি নয়। ‘নির্বান’ বলতে মানুষের মধ্যে যত অলীক ও অসারত্ব আছে, যত পাপ তাপ ও দূষনীয় বৃত্তি আছে এর সমাপ্তি বোঝায়। ‘নির্বান’ বলতে শশ্মানের প্রাণহীন শান্তি বুঝায় না। এর অর্থ হচ্ছে প্রাণবন্ত প্রশান্তি। মহাত্মা গান্ধী ইসলাম ধর্মকে মহান শান্তির ধর্ম বলে মনে করতেন। উগ্রবাদ (বর্তমানের জঙ্গিবাদ) পবিত্র কোরআনের শিক্ষা নয় বা হতে পারে না। প্রতিটি ধর্মের লক্ষ্য মানুষকে আরও ভালো মানুষ করে গড়ে তোলা। ঈশ্বরের অট্টালিকায় অনেক কামরা বা কোঠা আছে এবং এর প্রতিটি পবিত্র। মহাত্মা গান্ধীজি বলেছেন, আমাদের যখন অস্তিত্ব আছে তখন তার পিতা ও প্রপিতামহ আছেন। তাহলে সমস্ত সৃষ্টির জনক পরমপিতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। তিনি না থাকলে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই। এ বিষয়ে যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসই অপরিহার্য। ঈশ্বর আছেন এবং চিরকালই থাকবেন।
(২) মৌলানা আবুল কালাম আজাদ: ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এক প্রবাদ প্রতিম মহাপুরুষ। তাঁর সম্পর্কে এ প্রজন্ম অবগত নহেন বলেই ধরা যায়। হয়তো অনেকে তাঁর নামও শুনেননি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আফগানিস্থানের হিরাত অঞ্চলের বাসিন্দা। মোঘল স¤্রাট বাবরের আমলে তাঁরা ভারতবর্ষে আগমন করেন। এই পরিবার স¤্রাট আকবরের সময়ে ধার্মিক ও পন্ডিত হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। অন্যতম পূর্বপুরুষের নাম ছিল মৌলানা জামাল উদ্দিন। বিভিন্ন মোঘল স¤্রাটদের আমলে এই পরিবারের সদস্যগণ নানা উচ্চপদস্থ ও সম্মানজনক কার্য্যে নিয়োজিত ছিলেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পিতার নাম মৌলানা খয়ের উদ্দিন। খয়ের উদ্দিন তরুণ বয়সে পিতৃহারা হন। এই সময়ে মায়ের দিকের দাদা মৌলানা মনোয়ার উদ্দিন, খয়ের উদ্দিনের পরিবারকে তাঁর কাছে নিয়ে যান। সিপাহী বিদ্রোহের বছর দুয়েক আগে মৌলানা মনোয়ার উদ্দিন ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে হতাশ হয়ে মক্কা চলে গিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মৌলানা খয়ের উদ্দিন মদীনার বিখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তি শেখ মোহাম্মদ জাহের এর কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মৌলানা খয়ের উদ্দিন ক্রমশ: জ্ঞানী ব্যক্তি হিসাবে ইসলামিক বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেন। আরবী ভাষায় তিনি অনেক বই লিখে গেছেন। তিনি বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এই অবস্থায় ১৮৮৮ সনে মক্কা নগরীতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্ম হয়। ১৮৯০ সনে মৌলানা খয়ের উদ্দিন পরিবার পরিজন নিয়ে কলকাতা চলে আসেন এবং নানাবিধ পরিস্থিতির কারণে কলকাতাতেই বসবাস করতে শুরু করেন। কলকাতা আসার অল্প কিছুদিন পরই মৌলানা আজাদ ধর্মীয় শিক্ষায় পড়াশুনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের বিভিন্ন লেখা পড়ে আধুনিক শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে অবশেষে তিনি নিজের পথে চলার সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং প্রতীক স্বরূপ নিজের নাম মৌলানা আবুল কালাম এর সঙ্গে ‘আজাদ’ বা ‘মুক্ত’ শব্দটি যুক্ত করেন। ভারতবর্ষে লর্ড কার্জনের আমলে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে পরিবর্তিত চিন্তা নিয়ে। অবিভক্ত বাংলায় বৃটিশ বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় ছিল অনেক বেশি। লর্ড কার্জন লক্ষ্য করেন বাংলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব মূলতঃ হিন্দুদের হাতে। ১৯০৫ সনে লর্ড কার্জন চতুরতার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গের সিন্ধান্ত নেন। লর্ড কার্জনের এই সিন্ধান্তের পেছনে কাজ করে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য, তিনি মনে করেন এতে হিন্দুরা কার্যতঃ দুর্বল হয়ে পড়বে এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি হবে। যাই হোক পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের কারণে এটি আর কার্য্যকর হয় নাই। বাংলায় তখন ইংরেজ বিরোধী নানা সশস্ত্র বিপ্লবী গ্রুপ তৎপর ছিল। শ্যাম-সুন্দর চক্রবর্তী নামের এক বিপ্লবীর সঙ্গে মৌলানা আজাদের পরিচয় হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ অতঃপর অরবিন্দ ঘোষ সহ অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এক পর্যায়ে তিনি বিপ্লবী কর্মকান্ডে আকৃষ্ট হয়ে এতে যোগ দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন। তৎকালীন সময়ে বিপ্লবী সংগঠনগুলিতে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে সদস্য বাছাই ও নির্বাচন করা হতো। বিপ্লবী দলগুলি মনে করতেন মুসলিমরা বৃটিশদের দ্বারা পরিচালিত হন। বিপ্লবী দলগুলি মুসলমানদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী হিসেবে ধারণা করতেন এবং কার্যকলাপে মুসলিম বিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন। অবস্থার সুযোগ নিয়ে বৃটিশ সরকার উত্তরপ্রদেশ থেকে অনেক মুসলিম অফিসার নিয়ে এসে বাংলায় নিয়োগ করেন। এতে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষমূলক মনোভাব আরো বৃদ্ধি পায়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যখন বিপ্লবী দলে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন নেতারা হতভম্ব হয়ে যান এবং মৌলানা আজাদ কে অবিশ্বাস করেন। মৌলানা আজাদ তাদেরকে হিন্দু মুসলিম একতা সম্পর্কে বুঝাতে সমর্থ হন এবং বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলিম তরুণ যুবাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলে অনেক তরুণ যুবক এতে আকৃষ্ট হন। বিপ্লবী দলগুলির কার্যক্রম বিশেষ ভাবে বাংলায় এবং কিছুটা পার্শ্ববর্তী বিহারে সক্রিয় ছিল। মৌলানা আজাদ ইরাক, মিশর, তুরস্ক ইত্যাদি স্থানে ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার অনেক বিপ্লবী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমগ্র ভারতবর্ষে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু গোপন সংগঠনের কার্যক্রম এতে প্রকাশিত হয়ে যাবে এই যুক্তিতে নেতৃত্ব দ্বিমত পোষণ করেন, কিন্তু মৌলানা আজাদ তাদের বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তাঁর উদ্যোগে উত্তর ভারতের কয়েকটি স্থানে ও বোম্বেতে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তিনি ১৯১২ সনে ‘আল হিলাল’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। বৃটিশ সরকার এতে আতংকিত হয়ে একসময় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। ঐ সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক নেতাদের হাতে। গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং ঐ সময়কালীন সময়ে ভারতের রাজনীতিতে অংশ নেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরবর্তী সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ১৯২০ সালে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিন চন্দ্র পাল, সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ বাংলায় কংগ্রেসের বড় নেতা ছিলেন। সি.আর দাশের সঙ্গে মৌলানা আজাদের প্রায়ই সাক্ষাৎ ও আন্দোলন নিয়ে আলাপ আলোচনা হতো। গান্ধীজির বিভিন্ন মতের সঙ্গে তাঁরা দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। বাংলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিন্দুদের হাতে থাকলেও জনসংখ্যায় সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু শিক্ষা ও চাকুরী-বাকুরীতে তারা অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। সি.আর দাশ বাস্তবতা অনুধাবনে সমর্থ হন। সি.আর দাশ মনে করতেন যতদিন মুসলিমরা অর্থনৈতিক সমতা এবং শিক্ষা দীক্ষার নিশ্চয়তা পাবেন না ততদিন মনে প্রাণে তারা কংগ্রেসে যোগদান করবেন না। এই প্রসঙ্গে মৌলানা আজাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এই প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক ও সময়পোযোগী পদক্ষেপ নেন। তিনি ঘোষণা দেন বাংলায় কংগ্রেস কে ক্ষমতায় সমতা আনতে হবে এবং নূতন চাকুরীতে ৬০% ষাট শতাংশ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করতে হবে, যতদিন পর্যন্ত না তাঁরা সমপর্যায়ে আসতে পারেন। সি.আর দাশের এই ঘোষণায় কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁর উপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মনে করেন কংগ্রেস কর্তৃক সি.আর দাশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বাংলার মুসলমানরা কংগ্রেস থেকে দূরে সরে যান। বাংলা বিভাজনের বীজটি এভাবেই রোপিত হয়ে যায়। একইভাবে বিহারে স্থানীয় নেতৃত্ব সৈয়দ মাহমুদ কে না দেয়ায় কংগ্রেস বিরাট ভুল করে। কিন্তু জিন্না ও মুসলিম লীগের ঢালাও অভিযোগ অসত্য বলেই মৌলানা আজাদ মনে করতেন। এই অবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গান্ধীজি কোন পক্ষকেই সমর্থন না করতে মত পোষণ করেন। মৌলানা আজাদ এতে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর যুক্তি ছিল হিটলার-মুসোলিনীর নেতৃত্বে যেহেতু একপক্ষ ফ্যাসিবাদী নীতির ধারক ও বাহক এবং বৃটিশ-আমেরিকা-সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে অপর পক্ষ গণতান্ত্রিক, সেইহেতু গণতান্ত্রিক পক্ষকেই সমর্থন করা উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সর্বভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর পরপরই মৌলানা আজাদ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে দুই বৎসরের মাথায় মৌলানা আজাদ মুক্তি লাভ করেন এবং কংগ্রেস অধিবেশন আহবান করেন। নীতিগতভাবে সিন্ধান্ত হয় বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিলে ভারতীয় জনগণ যুদ্ধে তাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে। এই সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গোপনে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে রাশিয়া হয়ে জার্মানীতে চলে যান এবং বন্দী ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে আজাদ হিন্দ্ ফৌজ গঠন করে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করেন। সেই সময়ে চীনের শাসক ছিলেন চিয়াং কাই শেক্। জওহরলাল নেহেরু চীন সফর করেন। চিয়াং কাই শেক্ ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের ক্রিপস মিশন সেই সময়কার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতের স্বাধীনতার দাবি সম্পর্কে একটি সমাধান কল্পে বৃটিশ সরকার স্যার ষ্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্ কে ভারতে পাঠান। স্যার ক্রীপস ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে সম্মতির ইচ্ছা প্রকাশ করে মৌলানা আজাদের মতামত জানতে চান। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ দৃঢ়ভাবে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, যদি বৃটিশ সরকারের সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকে তাহলে ভারতের জনগণ এতে দ্বিমত করবেনা। রাজনীতির নানা ঘোর প্যাঁচে ক্রীপস মিশন ব্যর্থ হয়। বেশ আগেই ভারতের জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। এক পর্যায়ে গান্ধীজি ‘ভারত ছাড়ো’ বা ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কংগ্রেসে গান্ধীজির প্রভাব ছিল অপরিসীম। অনেক ভারতবাসীরা মনে করতেন গান্ধী যে কোন ম্যাজিক করে সুপারম্যান কার্য্যকলাপে ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারেন। এ ধরনের ক্যারিসমাটিক গুণাগুণ ছিল গান্ধীজির ভিতরে। মৌলানা আবুল কালামের কথা অনুযায়ী গান্ধীই প্রথমে জিন্নাহ্কে কায়েদে আযম নামে সম্বোধন করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ১৯০৬ সনে ঢাকাতে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয় এবং ক্রমশঃ জিন্না এর নেতৃত্বে আসেন। পূর্ণ স্বাধীনতার আগে বৃটিশ সরকার এক ধরনের স্বায়ত্ব শাসন ভারতবর্ষকে প্রদান করে। সে অনুযায়ী ভারতবর্ষের প্রদেশগুলিতে সরকার গঠনে নির্বাচন হয়। বাংলা, পাঞ্জাব এবং সিন্ধু ব্যতিত অন্যান্য রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। বাংলায় মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রায় অর্ধেক আসন পায়। পাঞ্জাবে মুসলিম লীগও ইউনিয়নিস্ট পার্টি প্রায় সমান সমান আসন লাভ করে। সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম লীগ একক দল হিসেবে বেশী আসন পেলেও সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভ করতে পারেনি। এই তিন প্রদেশ ছিল মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ। এগুলিতে যে সব মুসলিমগণ কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন তারা এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। আবার উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সেখানে কংগ্রেস বেশী আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিল। সরকার গঠনকল্পে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন। বিহারে যে সব আসনে মুসলিম প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন তাদেরকে নিয়ে সরকার গঠনে মৌলানা আজাদ চেষ্টা করলেও জিন্নার বিরোধিতার কারণে তা ব্যর্থ হয়। পাঞ্জাব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম প্রার্থীরা ইউনিয়নিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগ এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। কংগ্রেস ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সমর্থনে সেখানে খিজির হায়াতের নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট পার্টি ও কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার গঠনে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সনে বোম্বাই বন্দরে ভারতীয় নৌ বাহিনীর বিদ্রোহকে তৎকালীন সময়ে এক বিশেষ ঘটনা হিসেবে মৌলানা আজাদ অভিহিত করেন। সিপাহী বিদ্রোহের পর এটিই ছিল রাজনৈতিক ইস্যুতে সেনা বিদ্রোহের দ্বিতীয় ঘটনা। সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন এবং এক পর্যায়ে মনিপুরের ইমফল পর্যন্ত যুদ্ধ জয়কে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। ১৯৪৬ সনেই বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনার জন্য একটি কেবিনেট মিশন ভারতে প্রেরণ করার সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে বৃটিশ নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসেন এবং মি. এটলী প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৪৬ সনের ১৫ মার্চ তারিখে হাউস অব কমন্সে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি একটি ঘোষণা দিয়ে বলেন, ইতিমধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেছে, ভারতীয় জনগণের মনোবাসনা অনুযায়ী কেবিনেট মিশন সমস্যার সমাধান করবেন। কেবিনেট মিশন ১৯৪৬ সনের ২৩ মার্চ ভারতে আগমন করে। মুসলিম লীগ প্রথমবারের মতো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি রূপে পরিচিত হয়ে উঠে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির পটভূমিতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেস দলীয় সহকর্মী ও কেবিনেট মিশনের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। ১৫ই এপ্রিল ১৯৪৬ সনে তিনি মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দাবি নিয়ে একটি পরিকল্পনা বিবৃতি আকারে প্রকাশ করেন। তিনি স্বীকার করে নেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত বিভাগ একটি বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। ১৫ই এপ্রিল ১৯৪৬ সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কর্তৃক তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে পরিকল্পনা বিবৃতি আকারে প্রকাশ করেন তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তার সারমর্ম তুলে দেয়া হলো। তিনি একজন মুসলমান এবং একজন ভারতীয় হিসেবে মুসলিম লীগের প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কিত দাবি বিবেচনায় এনে সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলিমদের ভবিষ্যত ও প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা ও পর্যালোচনা করেন। তিনি সিন্ধান্তে আসেন যে, পাকিস্তান পরিকল্পনা শুধু ভারতবর্ষের জন্যই ক্ষতিকর হবে না বরং মুসলিমদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে অধিক সমস্যা সৃষ্টি করবে। এতে শুধু দেশের বিভাজন হবে না, মনেরও বিভাজন ঘটবে। ভারতের মুসলমানরা দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। তাঁর মতে অখন্ড ভারতবর্ষে একত্রিত বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী দেশ পরিচালনায় ও নীতি নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। তাঁর মতে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আদৌ যুক্তিসঙ্গত ও জোরালো হতে পারেনা। মৌলানা আজাদের মতে জিন্নার পাকিস্তান দাবি বা প্রস্তাব দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। জিন্নার মতে শত শত বৎসর ব্যাপি ভারতে হিন্দু-মুসলমান একত্রে বসবাস করলেও আসলে তারা দুটি পৃথক জাতি এবং পৃথক হওয়াই উত্তম সমাধান। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের ফলাফল কি হতে পারে তা নিয়ে নিজস্ব মতামত যুক্তিসহ উত্থাপন করেন। ভারত দ্বি-খন্ডিত হলে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। একটি পাকিস্তান অপরটি ভারত বা ইন্ডিয়া। একটি মুসলমান প্রধান অন্যটি হিন্দু প্রধান। যেহেতু সংখ্যা গরিষ্ঠতার সূচকে প্রদেশগুলি নিয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হবে সেইহেতু বাস্তবে হিন্দুস্থান রাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে তিন কোটির মত মুসলমান থেকে যাবেন এবং তারা অধিকতর সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে নিজেদেরকে দেশহারা ভাববেন এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকবেন। একই পরিণতি হবে পাকিস্তানে পড়ে যাওয়া হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের। দুটি রাষ্ট্র জন্ম থেকে পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতায় ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে যাবার ফলে কোন রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘুদের মঙ্গল সাধিত হবে না। পাকিস্তান প্রবক্তাদের একটি জোড়ালো যুক্তি ছিল অখন্ড ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেন্দ্রীয় সরকারে হিন্দুদের নিরঙ্কুষ প্রাধান্যই থেকে যাবে। কাজেই পৃথক হওয়াই যুক্তিসংঙ্গত সমাধান। এই পটভূমিতে মৌলানা আজাদ প্রস্তাব রাখেন প্রতিটি প্রদেশে পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসন থাকবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট প্রদেশগুলিতে গঠিত সরকার দেশরক্ষাসহ কয়েকটি বিষয় বাদে নিজ প্রদেশের শাসন পরিচালনায় স্বাধীন থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব রাখার অধিকারী হবেন। তেমনি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট প্রদেশগুলির অবস্থা একই রকম হবে। এইভাবে ভারতবর্ষের প্রকৃত উন্নয়ন সাধিত হয়ে এক সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বিলুপ্তি ঘটবে এবং ভবিষ্যতে দেশ চলবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে রেখে। কেবিনেট মিশন মৌলানা আজাদের এই পরিকল্পনা সরাসরি গ্রহণ না করলেও এটিকে সমাধানের একটি গাইড্লাইন হিসাবে গণ্য করেন। কেবিনেট মিশন ১৯৪৬ সনের ১৬ মে তারিখে তাদের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। যা মূলত: মৌলানা আজাদের পরিকল্পনারই অনুরূপ। প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়ক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে বলে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। কেবিনেট মিশন নূতন একটি বিষয় সংযোজন করে। দেশ তিনটি জোনে বিভক্ত হবে। যথা: এ. বি. এবং সি। ‘বি’ জোনে থাকবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বৃটিশ বেলুচিস্তান। জোন ‘সি’ তে থাকবে বাংলা ও আসাম। সেখানে একত্রিতভাবে সামান্য মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিল। বাকী প্রদেশ গুলি থাকবে ‘এ’ জোনে। কেবিনেট মিশন মনে করে এতে করে মুসলমানদের সমস্ত রকম শংকা ও আশংকা দূরীভূত হবে। জিন্না প্রথম দিকে এই প্রস্তাব সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী সময়ে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ক্রমে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় এই প্রস্তাব সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কংগ্রেসও এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচনকালে মৌলানা আজাদ সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে করে সভাপতি পদে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু’র নাম প্রস্তাব করলে নেহেরু কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। মৌলানা আজাদ পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিলেন এটি তার জীবনে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল সিন্ধান্ত ছিল। কেবিনেট মিশন প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে বোম্বেতে ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে। মৌলানা আজাদ সেই সময়ে ছিলেন কলকাতায়। ভেবেছিলেন কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য এই অধিবেশন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। তদুপরি শরীরও ভালো ছিল না। এ সব কারণে তিনি ঐ অধিবেশনে যান নাই। কিন্তু কংগ্রেসের এই অধিবেশনের সিন্ধান্ত ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়। ১০ জুলাই ১৯৪৬ সনে জহওলাল নেহেরু প্রেস কনফারেন্সে ডাকেন। সাংবাদিকরা জানতে চান হুবহু কেবিনেট মিশন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে কি না। উত্তরে জহরলাল নেহেরু জানিয়ে দেন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে, তবে পুরোপুরি হুবহু নয়। কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবে সংশোধন ও পরিবর্তন আনতে পারবে। এখানেই কবর রচিত হয়ে যায়। মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেও ভিতরে ভিতরে লীগ ও মি. জিন্না এতে খুব একটা খুশী ছিলেন না। নেহেরু’র বক্তব্যে মুসলিম লীগের অবস্থান পুনরায় আগের জায়গায় ফিরে যায়। তাঁরা যুক্তি দিলো নেহেরুর বক্তব্য অনুযায়ী যেহেতু কংগ্রেস কথা অনুযায়ী কেবিনেট মিশন প্রস্তাব হুবহু গ্রহণ করেনি কাজেই সেটি কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের নামান্তর মাত্র। ১৯৪৬ সনের ২৭ শে জুলাই তারিখে মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশন বসে। উদ্বোধনী ভাষণে জিন্না কেবিনেট মিশন প্রস্তাব থেকে সরে আসার কথা উল্লেখ করেন। কাউন্সিল অধিবেশনে পুনরায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাব গৃহিত হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েন। তবে আশা না ছেড়ে পুনরায় জোড়া লাগানোর চেষ্টায় রত হয়ে জানতে পারেন কংগ্রেস অধিবেশনে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব হুবুহু গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু নেহেরু সংবাদে সম্মেলনে নিজ দায়িত্বে সংশোধনী ও পরিবর্তনের কথা বলে দিয়েছেন। কিন্তু জিন্না ও মুসলিম লীগ পুনরায় মত পরিবর্তনে অসম্মতি জানিয়ে দিলো। তাদের যুক্তি ছিলো নেহেরুর বক্তব্যে কংগ্রেসের ভিতরের মনোভাব প্রকাশ পেয়ে গেছে। কাজেই কংগ্রেসের উপর তারা বিশ্বাস এবং আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। মৌলানা আজাদের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্বেও প্রস্তাব বাস্তবায়নের সব আশা ধীরে ধীরে নির্বাপিত হয়ে যায়। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সন ভারতের ইতিহাসে এক কালো দিন। ঐ দিন কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গার শুরু হয় এবং ক্রমশঃ তা সারা ভারতবর্ষে কম বেশী ছড়িয়ে যায়। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে আকার ধারণ করে। বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্ত্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই পরিস্থিতিতে বিভক্তির চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করতে লর্র্ড মাউন্টব্যাটনকে ভারতে পাঠানো হয়। যা মাউন্টব্যাটন মিশন নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে মাউন্টব্যাটনের পরিচয় পাওয়া যায় দক্ষ সেনাপতি হিসেবে। তিনি ভারতে এবং শ্রীলংকায় অনেকদিন দায়িত্ব পালন করেন। লর্ড ওয়াভেল পদত্যাগ করলে লর্ড মাউন্টব্যাটন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল হিসাবে নিযুক্তি পান। মিশন নিয়ে ভারতে আসার আগে বৃটেনের লেবার পার্টি সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিঃ এট্লী, ব্যাটনকে বলে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষে ১৯৪৮ সনের ৩০ শে জুনের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। মাউন্টব্যাটন দিল্লীতে ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত সমাধানে আসতে হবে বলে জানিয়ে দেন। মাউন্টব্যাটন নিজস্ব পদ্ধতিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত চতুর ও বুদ্ধিমান লোক। কূটনীতির নানা কৌশলে নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেলকে দেশ বিভাগে রাজী করাতে সমর্থ হন। পরিস্থিতি তখন এমন দাঁড়িয়েছিল যে আর দেরী নয় একটা কিছু হয়ে যাক। বিভক্তি হলেও স্বাধীনতা আসুক। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ অখন্ড ভারত বহাল রাখতে শেষ চেষ্টা হিসাবে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর ভাষায় তিনি গান্ধীজির কাছ থেকে জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত পান। তিনি দেখতে পান, যে গান্ধীজি বলতেন কংগ্রেস যদি বিভক্তি মেনেও নেয় তাহলে আমার লাশের উপর দিয়ে পার্টিশন করতে হবে, সেই গান্ধীজি আর নেই। যদিও তিনি প্রকাশ্যে বিভক্তি সমর্থন সূচক কথা বলেন নাই কিন্তু বিভক্তির বিপক্ষে কোন বক্তব্যও রাখেন নি। বরং পরোক্ষভাবে বিভক্তির পক্ষেই যুক্তি রাখেন। মৌলানা আজাদ অনেক্ষণ ধরে গান্ধীজিকে বুঝাতে চেষ্টা করলেও তাঁকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হননি। সর্বশেষে বলেন, আপনি যদি ভূমিকা না নেন তাহলে কাটাছেড়া থেকে ভারতবর্ষকে আর রক্ষা করা যাবেনা। গান্ধীজি নীরব থেকে যান। তিনি অন্য একটি মত প্রকাশ করে বলেন জিন্না কে প্রধান করে সরকার গঠন করার জন্য মাউন্টব্যাটেনের কাছে প্রস্তাব করেছেন এবং মাউন্টব্যাটন তাতে সম্মত হয়েছেন। মৌলানা আজাদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়ে দেন কংগ্রেস এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে হয়তো ভারতবর্ষকে বিভক্তি থেকে রক্ষা করা যাবে। আসলে বাস্তবে তা ছিলে অসম্ভব। জিন্না, নেহেরু ও প্যাটেল এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এইভাবে ভারত বিভাগ চূড়ান্ত হয়ে যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে পাঞ্জাব এবং বাংলার গুরুত্ব ছিল আলাদা। মাউন্টব্যাটন এই ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেন। তাঁর মতে, যেহেতু বিভক্তি হচ্ছে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে, কিন্তু পাঞ্জাব ও বাংলায় এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে মুসলমানরা পরিস্কারভাবে সংখ্যালঘু। কাজেই পাঞ্জাব এবং বাংলায়ও পার্টিশন হবে। তিনি এ ব্যাপারে কংগ্রেস নেতাদের আশ্বস্ত করেন। অতঃপর মাউন্টব্যাটন পার্টিশন রূপরেখা চূড়ান্ত করতে লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে মাউন্ট ব্যাটন প্রধানমন্ত্রী এট্লির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সবকিছু চূড়ান্ত করে ফেলেন। প্রথমে ঠিক হয় ২০ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ এর মধ্যে পার্টিশন হয়ে যাবে। মাউন্ট ব্যাটন আরো কিছু সময় চান এবং সাব্যস্ত হয় ১৯৪৭ এর আগস্ট মাসের মধে ভারত বিভক্ত হয়ে পৃথক দুই রাষ্ট্রের জন্ম হবে। মাউন্টব্যাটন পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন। কংগ্রেসও মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ আলোচনায় দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৯৪৭ এর ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হবে। পরদিন ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হবে। কংগ্রেস ঠিক করেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হবেন মাউন্টব্যাটেন। মুসলিমলীগ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে জিন্নার নাম ঘোষণা করে। ১৫ই আগস্টের আগে তখন হাতে আছে মাত্র তিয়াত্তর দিন। জটিল এই ভাগ বাটোয়ারা শুধু পাঞ্জাব ও বাংলায় হবেনা হবে অন্যান্য সম্পদ এবং ফাইল পত্রেও। আছে আমলা বিভাগ, টাকা পয়সা, সেনাবাহিনী ও নানা ধরনের খুঁটিনাটি সমস্যা। কে পারবে এই গুরু দায়িত্ব বহন করতে। পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগাভাগির চেয়েও অধিক জটিল। বলা যায় জটিলতম। মাউন্ট ব্যাটন স্বয়ং ফরমান জারী করলেন। ভূমি বিভক্তি বাদে বাকী সব সম্পদ বিভাজনের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ল দুজন মানুষের উপর। দুই বন্ধু এবং দুজনেই দুঁদে আমলা। নিপুণ তাদের কর্মপদ্ধতি। দুজনই নিরপেক্ষ এবং সরকারের কাছে বিশ্বস্ত। একজন হিন্দু আরেকজন মুসলিম। একজনের নাম চৌধুরী মুহাম্মদ আলী এবং আরেকজন হলেন এইচ এম প্যাটেল। ভীষণ চাপ ও জটিলতার পরীক্ষায় তাঁরা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ছিলেন লন্ডনের একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। কিন্তু আইন পেশায় ছিলেন প্রবাদ প্রতিম কৃতি পুরুষ। তিনি ছিলেন জ্ঞানের খনি। তাঁকে বলা হতো সচল অভিধান। লর্ড মাউন্ট ব্যাটন পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের পরিকল্পনা দিলেও কোন বিভক্তি রেখা বা সীমানা রেখা দিতে পারেন নি। এদিকে সময় কমে আসছে। মাউন্টব্যাটন নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বিলাতে গিয়ে ডেকে পাঠান র্যাডক্লিফকে। একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো জিন্না এবং নেহেরু দুই জনেই মাউন্ট ব্যাটনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন এমন একজনের উপর এই দায়িত্ব দেয়া হোক যিনি ভারতবর্ষ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে। মাউন্ট ব্যাটনের কাছে মনে হয়েছিল র্যাডক্লিফই হবেন উপযুক্ত ব্যক্তি। মাউন্ট ব্যাটন যখন র্যাডক্লিফের কাছে এই প্রস্তাব করলেন তখন তিনি আঁতকে উঠেন। ভারতবর্ষের কোনদিকে পাঞ্জাব আর কোনদিকে বাংলা সে ধারণাও তাঁর নেই। সুতরাং ছুরি চালিয়ে দেশদুটো দুভাগ করার দায়িত্ব নেয়াটা তার কাছে হবে চরম অবিমৃষ্যকারিতা। কিন্তু উপায় নেই। অবশেষে কাজটা তাঁকে নিতেই হলো। বসে গেলেন মানচিত্র নিয়ে। মানচিত্রের গায়ে আবিস্কার করলেন পাঞ্জাব ও বাংলাকে। কাজটা অত্যন্ত দুরহ এবং বিপুলা এতে কোন সন্দেহ নেই। দুটি প্রদেশের প্রায় আট কোটি আশি লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ী, জমিজমা, খেতখামার, কলকারখানা, রেলপথ, সড়কপথ, জলপথ এমনভাবে ভাগ করতে হবে যাতে কোন পক্ষই ক্ষুন্ন না হন। নিপুণ আস্ত্রোপাচার করে দুটো জাতির দেহ থেকে হাড় ও মাংসপেশী আলাদা করবেন। কাজ খুবই কঠিন। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের রাজা, মহারাজা নবাবদের আবদার মাউন্ট ব্যাটনের কাছে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। তারা জানালেন তাদেরও স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার আছে। মাউন্ট ব্যাটেন কঠিন হস্তে এর সমাধান করলেন এবং বলে দিলেন ১৫ই আগস্ট এর ভিতরে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ঘোষণা দিতে হবে কে কোনদিকে যাবে। তারপর সেই দেশের সরকারের সঙ্গে পাওনাদি ভাতা, খেতাব নিয়ে দেনদরবার করতে হবে। র্যাডক্লিফ গুরু দায়িত্ব নিয়ে চলে আসেন ভারতে। সময় অত্যন্ত স্বল্প, মাত্র কয়েকটি সপ্তাহ। দেশ প্রদেশ দুটি ভালো করে দেখতেও পারবেননা। কিন্তু ছুরি চালাতে হবে। বড়রকমের ভুল চুক থেকেই যাবে। কিন্তু শেষ সীমা ১৫ই আগস্ট। র্যাডক্লিফ ভাবলেন ছুরি দিয়ে হবে না। হাতে নিতে হবে একটি খাঁড়া। বিভক্ত হলো পাঞ্জাব ও বাংলা, বিভক্ত হলো ভারতবর্ষ। উল্লেখ যে আসামের সঙ্গে যুক্ত সিলেটে রেফারেন্ডাম বা গণভোট হয়ে তা পাকিস্তানে পড়ে। কিন্তু করিমগঞ্জ মহকুমা থেকে যায় আসামে। খুলনা পড়ে ভারতে ও মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে। পরে খুলনা ও মুর্শিদাবাদের মধ্যে বদলাবদলি হয়ে খুলনা থেকে যায় পাকিস্তানে আর মুর্শিদাবাদ ভারতে। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ ভারতবাসীর কাছে পৌঁছে যায় ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে আর পরদিন ১৫ই আগস্টে। পাকিস্তানের হিন্দু ও শিখরা স্বাধীনতার উল্লাসে যোগ দিতে পারেনি, তেমনি পরদিন স্বাধীনতার আনন্দে সামলি হতে পারেনি ভারতের মুসলমানরা। অতঃপর স্বাধীন দুই দেশে ঘটে যায় অনেক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। সৃষ্টি হয় নূতন করে রিফিউজি সমস্যা। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দু-টুকরো হয়ে যায়। গান্ধীজির মৃত্যু ঘটে আততায়ীর হাতে। জিন্না মারা যান অসুস্থতার কারণে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর বইতে অনেক আগেই লিখে যান দুই ভূখন্ড নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের মানুষের কাছে ধর্ম ছাড়া আর কোন বিষয়ে মিল নেই। তেমনি ভারতীয় মুসলামনেরা হয়ে গেলো আরো দুর্বল ও খন্ডিত। কারো মতে বিভক্তি সঠিক আর কারো মতে ভুল। একমাত্র ভবিষ্যত ইতিহাসই এর শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা নিয়ে সিন্ধান্ত দিতে পারবে।
(৩) জিন্নাঃ অখন্ড ভারতবর্ষে মুসলিম রাজনৈতিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুসলিম যুব সম্প্রদায়ের উত্থান। সেটা ছিল বিশ শতকের গোড়ার দিক্। এই যুব সম্পদায়ের প্রধান ছিলেন আইনজীবী ও অন্যান্য পেশার মানুষেরা। যুক্ত প্রদেশের মুহাম্মদ আলী, শওকত আলী ভ্রাতাদ্বয় এবং হাকিম আজমল খানের মতো মানুষেরা। বৃটিশরা ভারতের জনমতকে সর্বদাই বিভক্ত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন যাতে ভারতে তাদের প্রশাসন সহজ হয়। সিপাহী বিদ্রোহের প্রতিধ্বনি বৃটিশের কানে তখনও বাজতো। ঐ সময়ে হিন্দু-মুসলিমদের একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনাই বৃটিশ সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন ভারতের সেক্রেটারি অব-ষ্টেট লর্ড মিন্টো বড়লাটের নির্দেশে দুই ধর্মের জনগণ যাতে এক হতে না পারে সে ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালনে তৎপর ছিলেন। ঐ সময়ে ফিরোজ শাহ্ মেটা গোষ্ঠির একজন সক্রিয় কংগ্রেস নেতা দাদাভাই নওরোজির একান্ত সচিব ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্না। পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন মহাকবি ইকবাল আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছিল জিন্নার উপরে। মুহাম্মদ আলী জিন্না যখন ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এলেন তখন মুসলিম লীগ বলে কিছু ছিলনা। ছিল এক নবজাগ্রত মুসলিম চেতনা। সেটা ছিল বিশ শতকের শুরু। গ্রেটবৃটেন নিজের সা¤্রাজ্যবাদী গরিমার শীর্ষে। মহারানী ভিক্টোরিয়া প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছেন। জিন্নার জন্মস্থান গুজরাত প্রদেশের কাথিয়াবাড় নামক স্থানে। কচ্ছের রান এলাকার লাগোয়া। সেখানে ছিল অনেক হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের বাসস্থান। গান্ধীজির জন্মস্থান ছিল গুজরাটের রাজকোটে। সেখান থেকে ৫০ মাইল দূরে কাথিয়াবাড়ের পানেলি নামের একটি গ্রাম বা জনপদ। সেখানে এক খোজা মুসলিম পরিবারের বসবাস ছিল। পরিবার প্রধান এর নাম পূঞ্জা ভাই। তাঁর তিনপুত্র বলজি ভাই, নাথু ভাই, জেনা ভাই এবং এক কন্যা মানবাই। পরবর্তী সময়ে জেনা ভাই পানেলি ছেড়ে ১৮৭৫ সালে ব্যবসার উদ্দেশ্যে করাচী চলে যান এবং ব্যবসা বাণিজ্য করে ধনাঢ্য বণিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেনা ভাইয়ে স্ত্রীর নাম ছিল মিঠাবাই। করাচীতে ১৮৭৬ সনের ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখে এই দম্পতির একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। গুজরাটে থাকাবস্থায় পুঞ্জা ভাই পরিবারের সকলের নামের সঙ্গে হিন্দু নামের সাদৃশ্য ছিল। কিন্তু করাচীর পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশী। সকল ছেলে মেয়েদের নামই হতো ইসলামী রীতি অনুযায়ী। জেনাভাই দম্পতির এই পুত্র সন্তানের নাম রাখা হলো মোহাম্মদ আলী জেনা ভাই। পিতার নাম শেষে রাখার নিয়ম মেনে। পরবর্তীতে জেনা ভাই থেকে জিন্না শব্দের উৎপত্তি ঘটে। জিন্না করাচীতে প্রথমে মাদ্রাসা ও পরে চার্চ মিশন স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় ১১ বছরের এমা বাই এর সঙ্গে। ১৮৯২ সালে মোহাম্মদ আলী লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পিতা জেনা ভাইয়ের ব্যবসা বিপর্যয় ঘটলে তিনি আবার স্থান পরিবর্তন করে বোম্বেতে চলে যান। ইংল্যান্ডে জিন্না প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ১৮৯৩ সনে আইন পড়তে লিঙ্কনস্ ইন এ ভর্তি হন। সেখানে লেখা পড়া শেষে ১৮৯৬ সালে বোম্বেতে ফিরে আসেন। আইন ব্যবসা শুরু করলেও মক্কেলের অভাবে তাঁর অবস্থা ছিল খুবই করুণ। ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে ওকালতি জীবনে সাফল্য আসে। প্রথম জীবনে ধর্ম বিশ্বাসে ছিলেন উদার। হিন্দু লোহানা সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল খোজা সম্প্রদায়। জিন্না ছিলেন খোজা মুসলিম এবং শিয়া সম্প্রদায়ের আশারি গোষ্ঠীর মানুষ। হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের প্রভাব ছিলো এই সম্প্রদায়ের উপরে। মনে করা হয়েছিল তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত হয়ে উঠবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। জিন্নার রাজনৈতিক জীবন শুরু বম্বেতে আইন ব্যবসা শুরু করার সময় থেকে। তিনি আঞ্জুমানে-ই-ইসলাম নামে এক সংগঠনে যোগ দেন ১৮৯৭ সালে। এই সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে পরবর্তীকালে কংগ্রেস সহ বিভিন্ন নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। তৎকালীন সময়ে ভারতের জনগণের উপর গান্ধীজির প্রভাব ছিল অপরিসীম। গান্ধীর সঙ্গে জিন্নার তুলনা চলে না। তবুও কেউ কেউ বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলনা করতেন। গান্ধীজির রাজনীতি ছিল খোলা রাজপথের রাজনীতি, সাধারণ মানুষের জন্য অহিংস রাজনীতি। গান্ধীর উপর অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ ও বিরক্ত থাকলেও এক সময় জিন্না গান্ধীর প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধা অনুভব করতে থাকেন। গান্ধীজিকে অনুসরণ করে জিন্না মুসলিম লীগের একমাত্র নেতা ও মুখপাত্র হয়ে উঠতে ইচ্ছা পোষণ করতে থাকেন। জিন্না কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয় সংগঠনেই যোগ দিয়েছিলেন। পরে মুসলিম লীগে থিতু হন। জিন্নার পারিবারিক জীবনে রতন বাই এর সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়। তিনি লন্ডন গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতির ডাকে ব্যক্তিগত জীবন অবহেলিত হয়েছিল। বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়। রতন বাই মারা যান। প্রবল মানসিক চাপে জিন্নার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। বয়স তখন ষাট বৎসর। অনবরত ধুমপান করতেন। একবার ভেবেছিলে বৃটিশ রাজনীতিতে প্রবেশ করবেন। সিদ্ধান্ত বদলে আবার ভারতে চলে আসেন এবং মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নিবেদিন হন। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ছিল উচ্চবর্গের নবাব জমিদারদের হাতে। কার্য্যক্রমে গতি ছিলনা। জিন্না নেতৃত্বে এসে মুসলিম লীগকে বেগবান করে তুলেন। তবে তাঁর অহংবোধ ছিল প্রবল। জিন্না মুসলিম লীগের সংগঠন দেখতে বাংলা সফর করেছিলেন। বাংলায় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। খাজা নাজিম উদ্দিন ছিলেন মুসলিম লীগের মঞ্চে। মুসলিমরা কংগ্রেস এর উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিলেন না। তারা একজন সর্বভারতীয় মুসলিম নেতা চাইছিলেন। এই ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হিসাবে খুঁজে পেলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে। কেবল মাত্র মুখপাত্র নয়, বাস্তবের পরিত্রাতা হিসেবে। জিন্না ও নেহেরু দুজনের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে মিল থাকলেও অমিল ছিল বেশি। দুইজনেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। জিন্না খোজা মুসলিম আর নেহেরু কাশ্মীরি পন্ডিত। দুজনই শিক্ষিত আইনজ্ঞ, বিলাতি কেতা দুরস্ত এবং অহংকারী। পরস্পরের প্রতি দুজনেরই ব্যক্তিগত বিরাগ ছিল তীব্র ও সুস্পষ্ট। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে জিন্না পাকিস্তানের দাবি জানালেও প্রস্তাবের বিস্তারিত বর্ণনা কখনও ¯পষ্ট করেন নি। প্রাদেশিক রাজনীতি ও ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৪০ সালের ৮ই আগস্ট বড়লাটের প্রস্তাবে একটি নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদে তিনজন মুসলিম নেতা ছিলেন যথাক্রমে বাংলার ফজলুল হক এবং পাঞ্জাবের সিকন্দর হায়াত খান আর আসামের স্যার সাদ উল্লøা। জিন্না ভাবলেন উল্টো। জিন্না মনে করলেন তার একমাত্রা আধিপত্য এতে ক্ষুণœ হয়ে যাবে। দলের নির্দেশে সিকান্দর হায়াত খান এবং স্যার সাদ উল্লা পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে ফজলুল হকও ইস্তফা দেন। বাংলার পূর্ব অঞ্চলে পাকিস্তান আন্দোলন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং মুসলিম ছাত্ররাও এতে অংশ নেয়। পাকিস্তÍান দাবিতে জিন্না সব সময়ই অটল থাকতে চেয়েছেন। সব শেষে ভারত ভাগ হলো। জন্ম হলো দুটি পৃথক রাষ্ট্রের পাকিস্তান এবং ভারত বা ইন্ডিয়া। জিন্না শেষবারের মতো বোম্বে ছেড়ে চলে গেলেন করাচীতে। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে। করাচীতে তাঁর আসার তারিখ ছিল ৭ই আগস্ট ১৯৪৭ সাল। করাচী বিমান বন্দরে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে বরণ করে নিলো। ভারত বিভাগ ছিল অনিবার্য। তবে তাড়াতাড়ি করে এবং এগিয়ে এনে ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত ও ১৫ই আগস্ট দিনটি একেবারে চূড়ান্ত করার কারণ কি ছিল? পরবর্তীকালে মাউন্ট ব্যাটন এটি পরিষ্কার করেছিলেন। মাউন্ট ব্যাটনের উপর লেখা একটি বই সম্পর্কে লেখকের জিজ্ঞাসায় তিনি জানিয়েছিলেন ১৫ই আগস্ট দিনটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পনের দ্বিতীয় বার্ষিকী। মাউন্ট ব্যাটন তাই এই দিনটি নির্ধারণ করেন। কি অদ্ভুত ও নেতিবাচক মানসিকতা। উল্লেখ্য, লর্ড মাউন্ট ব্যাটন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ নৌ-বাহিনীর একজন দক্ষ সেনাপতি ছিলেন। জিন্না পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি প্রথম থেকেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। ঢাকা এসে জনসভায় ঘোষণা দেন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে একমাত্র উর্দু। প্রতিবাদ জানায় বাঙালিরা। দানা বাঁধে ভাষা আন্দোলন। পরবর্তীকালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সৃষ্টি হয় ইতিহাস। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা চলতে থাকে বাঙালিদের উপর। অবশেষে দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের পথ অতিক্রম করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে জিন্নার জীবনের শেষ দিনগুলি সুখকর ছিল না। পাকিস্তান হওয়ার কিছুদিন পরে তাঁর দেহে বাসা বাঁধে ক্ষয় রোগ। জিন্না ক্রমশঃ নির্জীব ও অধিক অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন। বিধ্বস্ত শরীরকে বিশ্রাম দিতে শৈল নিবাসে অবস্থান করেন। কিন্তু ভগ্ন শরীর আর ঠিক হয় নি। শেষ জীবনে সারাক্ষণের সঙ্গি ছিলেন বোন ফাতেমা জিন্না। আবার ফিরে আসেন করাচীতে। এই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাত দশ ঘটিকায় পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার তেরো মাসের মাথায় মোহাম্মদ আলী জিন্না মারা যান। ইতিপূর্বে মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারী তারিখে মারা যান। কিছু কিছু বইয়ে পাওয়া যায় রহমত আলী নামে যে ব্যক্তি জিন্নাকে লন্ডনে পাকিস্তান আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁকে জিন্না পরবর্তিতে অস্বীকার করেছিলেন।
লেখক: সিনিয়ন আইনজীবী ও কথা সাহিত্যিক
যে সব গ্রন্থ নির্ভরে এই লেখা
১। আমার ধর্ম-মহাত্মা গান্ধী।
২। ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম-মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।
৩। ফ্রিডম এ্যাট মিড্ নাইট। – ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক ল্যাপিয়ের।
৪। জিন্না-ভারত-দেশভাগ-স্বাধীনতা Ñ যশোবন্ত সিংহ।