চিনির চোরাচালান/ অভ্যন্তরীণ বাজারের অস্থিরতাই দায়ী

ছাতক সিমান্তে চিনি চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে বলে গতকাল দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদ তথ্য অনুসারে গত এক সপ্তাহে ওই উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসা প্রায় ৪ হাজার কেজি চিনি আটক ও ৭ চোরাকারবারী গ্রেফতারের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুমান করা খুবই স্বাভাবিক যে, আটককৃত চিনির চাইতে অনেক বেশি চিনি বাজারে ঢুকেছে। নিঃসন্দেহে চোরাচালান অর্থনীতির জন্য খারাপ একটি বিষয়। এতে সরকারের রাজস্ব প্রাপ্তি বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে বৈধ ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। সরকারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোরাচালান রোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখা দরকার বলে আমরা মনে করি। ভারতের সাথে আমাদের বিশাল স্থল সীমান্ত পাহারা দিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু তৎপরতা আন্তরিক ও জোরদার থাকলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা দুঃসাধ্য নয়। সীমান্তে কারা চোরাচালানের সাথে জড়িত তা অজানা থাকার কথা নয়। যেসব বাহক বমাল ধরা পড়ে থাকে তারা মূল চোরাকারবারী নয়। এরা শেষ দিকের দরিদ্র শ্রেণির শ্রমজীবী মানুষ মাত্র। চোরাচালান বন্ধ করতে হলে আসল ব্যক্তিদের ধরতে হবে। এরকম নিরীহ বাহকদের ধরে খুব বেশি লাভ হবে না। কারণ দশজন বাহক ধরা পড়লেও টাকার বিনিময়ে সহজেই আরও বিশজন বাহক এই শূন্যতা পূরণ করে ফেলবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো আসল চোরাকারবারীরা সকল সময়েই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আরেকটি প্রশ্ন সঙ্গতকারণেই উত্থাপনযোগ্য। কেন চিনি চোরাকারবারীর মাধ্যমে ভারত থেকে এখন বাংলাদেশে আসছে? যে পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার মূল্যের চাইতে ওপাড়ে দাম কম থাকে সাধারণত সেই পণ্যই চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হয়। বহুদিন ধরে বাংলাদেশে চিনির বাজার অস্থির। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রমাগত এই পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় হাতে গোণা কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের মাধ্যমে। অভিযোগ আছে এই বড় গ্রুপগুলো সিন্ডিকেট করে বাজারে চিনির দাম বাড়িয়ে থাকে। এদের নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয় না। অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির এই অত্যধিক মূল্যের কারণেই ভারত থেকে চিনি চোরাচালান হয়ে আসছে। সুতরাং চিনির চোরাচালান নিরোধের সর্বোত্তম পথ হলো অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। ভারত যদি কম দামে চিনি বিক্রি করতে পারে তাহলে আমরা কেন পারি না. এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে হবে। সবকিছু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার আশা করা ঠিক নয়। এখানে অর্থনীতির কিছু সাধারণ নিয়মকেও আমলে রাখতে হবে।
নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত চিনি রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ফলে বৈধপথে ভারত থেকে চিনি আমদানি করে কম দামে দেশে বিক্রি করার আপাতত সুযোগ নেই। সরকারকে এই জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার সম্মত হয়ে যদি চিনি আমদানি রফতানির সুযোগ করে দেয় তাহলে চোরাচালানের প্রবণতা কমে যাবে একইসাথে দেশীয় ভোক্তারাও অতিরিক্ত দামের চাপ থেকে কিছুটা মুক্ত থাকতে পারবেন বলে আশা করা যায়। এতে উভয় দেশেরই বাণিজ্যিক ও রাজস্ব সংক্রান্ত স্বার্থ রক্ষিত হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারে যদি অযৌক্তিকভাবে চিনির দাম বাড়ানো হয়ে থাকে তাহলে কঠোর হাতে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে গোষ্ঠী বিশেষের অতিরিক্ত মুনাফামুখী তৎপরতাকে অবশ্যই দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারি সংস্থা টিসিবিকে আরও বেশি মাত্রায় কার্যকর করতে হবে। দেশীয় মৃতবৎ চিনিকলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করাও আরেক কর্তব্য। নতুবা যতই আমরা হাপিত্যেশ করি না কেন চিনির চোরাচালানি বন্ধ করা কঠিন হবে বৈকি।