বিশেষ প্রতিনিধি
লোককবি রাধারমণ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামের রাধারমণ দত্ত কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সংরক্ষিত জমির বড় অংশ স্থানীয় পাঁচ ব্যক্তির নামে একসনা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বন্দোবস্ত প্রদানকালে অর্থ লেনদেনেরও অভিযোগ ওঠেছে। বন্দোবস্ত গ্রহিতারা এই জমি এখন সাবলিজও দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। স্থানীয় অভিজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত রাধারমণ কমপ্লেক্সের পাশের এই জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যৌক্তিক হবে না, এটি সরকারের কাছেই রেখে রাধারমণ কমপ্লেক্সের নামে কাজে লাগাতে হবে।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর এলাকাবাসীর পক্ষে অভিযোগ করেছেন জগন্নাথপুর পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. দরছ মিয়া, মো. সুনু মিয়া, মো. আব্দুল খালিক ও মো. ছুরত মিয়া। অভিযোগের অনুলিপি পরিকল্পনা মন্ত্রী, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার, সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার ও জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবরও দেয়া হয়েছে। তবে জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাজেদুল ইসলাম বলেছেন, কমপ্লেক্সের জমি লিজ দেয়া হয় নি। যে জমি লীজ দেয়া হয়েছে, তা কমপ্লেক্সের জন্য নির্ধারিত নয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৩ সাল থেকে ভরতপুর মৌজার ৪৬ নং জেএলকৃত ১১৫ নং দাগে ০৩.১৪ একর ভূমির সরকারি রাজস্ব প্রদান করে আসছেন কেশবপুর গ্রামবাসী। কিন্তু রাধারমণ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা বলে পরবর্তীকালে এই জায়গার রাজস্ব আর গ্রহণ করে নি কর্তৃপক্ষ। ২০১৫ সালে রাধারমণ দত্তের মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জগন্নাথপুরে তিন দিনের কর্মসূচিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী (বর্তমান পরিকল্পনা মন্ত্রী) স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। তখনই কেশবপুর বাজার সংলগ্ন ভূমিতে রাধারমণ দত্তের কমপ্লেক্সের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। যেখানে রাধারমণ কমপ্লেক্সের সাইনবোর্ড লাগানো হয়, সেখানে রাধারমণ দত্তের ছেলে বিপিন বিহারী দত্তের নামে একসময় জমি ছিল। ওখানে জমি ছিল তিন একর ১৪ শতাংশ। সময়ের পরিবর্তনে এটি অর্পিত সম্পত্তি হয়। এই সম্পত্তির ৬০ শতাংশ প্রস্তাবিত রাধারমণ কমপ্লেক্সের জন্য রেখে বাকি ২৫৪ শতাংশ জমি সম্প্রতি রাধারমণ সমাজ কল্যাণ ও সাংস্কৃতিক পরিষদের নাম ব্যবহার করে এলাকার জিলু মিয়া, তাজিবুর রহমান, আসকির মিয়া, রমজান আলী ও টুনু মিয়া কে ২৫৪ শতাংশ জমি লীজ প্রদান করা হয়।
লীজ গ্রহীতাগণ ৯৯ বছরের জন্য লীজ এনেছেন দাবি করে একসনা বন্দোবস্ত নেওয়া বাজাররকম ভিট এলাকার সহজ সরল মানুষের কাছে লীজ ও সাব লীজ দিয়ে ভিট প্রতি এক থেকে দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।
অভিযোগে এলাকাবাসী এই নিয়ে যে কোন সময় আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে বলেও উল্লেখ করেন। এছাড়াও ভূমি বাণিজ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয় এলাকাবাসীর আবেদনে।
কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা দরছ মিয়া বলেন, রাধারমণ কমপ্লেক্সের প্রস্তাবিত জমি বন্দোবস্ত দেওয়ায় উপজেলার সাংস্কৃতিককর্মীরা ক্ষুব্ধ। অবিলম্বে বন্দোবস্ত বাতিল করে রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি জানান তারা। তিনি বলেন, বন্দোবস্ত নিয়ে ভূমি খেকোচক্র উক্ত ভূমি সাবলীজ দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। রাধারমণের পূর্বসূরীর জমি রাধারমণের কমপ্লেক্সের সম্পদ হিসাবে রাখার আবেদন জানান তারা।
কেশবপুর গ্রামের আরেক বাসিন্দা সুনু মিয়া বলেন, রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে উক্ত ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল করে দখল মুক্ত করা হয়। এখন হঠাৎ করে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে ৫ জনের নামে বন্দোবস্ত দেওয়ায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। তিনি বলেন, আমরা চাই রাধারমণ দত্ত কমপ্লেক্সের প্রস্তাবিত জমিতে রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হোক। সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন হলে, বিনা স্বার্থে কেশবপুর গ্রামবাসী সরকারকে রাজস্ব দিতে রাজি আছে।
অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে রাধারমণ সমাজ কল্যাণ ও সাংস্কৃতিক পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক রমজান আলী বললেন, ওখানে তিন একর ১৪ শতাংশ জমি আছে। ৬০ শতাংশ জমি রাধারমণ কমপ্লেক্স’এর জন্য রেখে ২৫৪ শতাংশ আমাদেরকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। আমরা কাউকে সাবলীজ দিয়েছি এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। ওখানকার পুকুর রকম ভূমিতে মাছ চাষ করে এর আয় দিয়ে আমরা রাধারমণের স্মৃতি রক্ষায় ব্যয় করবো।
এই সংগঠনের সহসভাপতি আছকির মিয়া বললেন, আমরা এই জমি কাউকে সাবলীজ দিচ্ছি না। প্রশাসনের অনুমতি পেলে ওখানে স্থাপনা নির্মাণ করে আয়ের ব্যবস্থা করে রাধারমণের স্মৃতি রক্ষায় কাজে লাগাবো।
সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায় এই প্রসঙ্গে বললেন, রাধারমণ কমপ্লেক্স’এর জন্য নির্ধারিত জমির আশপাশে সরকারি জমি থাকলে এটি ব্যক্তি বিশেষের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া কোনভাবেই যৌক্তিক হবে না। এটি সরকারের কাছে রাখতে হবে, বা রাধারমণ কমপ্লেক্সের সম্পত্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। না হয় উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
অভিযোগ সত্য নয় উল্লেখ করে জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, রাধারমণ কমপ্লেক্সের জায়গা কাউকে লীজ দেয়া হয় নি। আমরা জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে যে জায়গা লীজ দিয়েছি, সেটা কমপ্লেক্সের জায়গা নয়। আমাদের কাছে ডকুমেন্টও আছে। রাধারমণ কমপ্লেক্স’র জন্য এই জমি নিতে চাইলে একসনা বন্দোবস্ত যে কোন সময় বাতিল করে কমপ্লেক্সে’এর নামে দেওয়া যাবে। তিনি বললেন, স্থানীয় রাধারমণ অনুরাগীদের মধ্যে বিভক্তি আছে। একপক্ষ এটা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠায়। এর আগেও ওঠানো হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তাদের অভিযোগ সত্য নয়।
বন্দোবস্ত প্রদানকালীন সময়ের সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন (বর্তমানে বরিশালের জেলা প্রশাসক) বললেন, আমি রাধারমণ কমপ্লেক্সের পাশের জমি বন্দোবস্ত দেবার জন্য নির্দেশনা দেই নি।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। এটা অর্পিত সম্পত্তি। অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
এদিকে গত বছরের ২৫ নভেম্বর বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে ‘রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণ সময়ের দাবি’ স্লোগানে তিন দিনব্যাপী রাধারমণ লোকসংগীত উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একই অভিযোগ করেন রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়। তিনি ওই সময় দাবি করেন, ‘রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের জায়গাটি ভূমিদস্যুদের লীজ দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের জন্য শঙ্কার বিষয়। ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করে কমপ্লেক্স স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি। যাতে রাধারমণের স্মৃতি ও কর্ম রক্ষা করা যায়। আমরা এক লাখ স্বাক্ষর গ্রহণ করেছি, আমাদের একটাই দাবি রাধারমণের কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হোক।’
একই অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের আশ^াস দেন। তিনি বলেছিলেন, রাধারমণ কমপ্লেক্স স্থাপত্য নকশা মোটামুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে, সমীক্ষা হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত করার জন্য ফাইলটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পারব।
- আদালতের নির্দেশ অনুসারে খাল উদ্ধারে ভূমিকা নেয়া হোক
- বিশ্বম্ভরপুরে বসন্ত বরণ