বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে (৮ অক্টোবর) দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি কমছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে পরিযায়ী পাখিদের জন্য নিরাপদ জলাভূমি তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগহীনতার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পাখি বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের মত অনুসারে টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি কমার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছেÑপানির নীচের নরম তৃণ-গুল্মাদি কমে যাওয়া, পর্যটকবাহী ইঞ্জিননৌকার যত্রতত্র ঘুরাঘুরি ও উচ্চশব্দ উৎপাদন, টাঙ্গুয়ার হাওরে বৃক্ষাদির সংখ্যা কমে যাওয়া ইত্যাদি। ২০২১ সনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই হাওরে পাখির সংখ্যা ছিলো ৫৯ হাজার ৭৪টি। ২০২২ সনে এই সংখ্যা আরও কমার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আজ থেকে ২০ বা ৩০ বছর আগের পরিসংখ্যানের তুলনা করলে বর্তমান চিত্র দেখে সকলেই আঁতকে উঠবেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর কেবল পাখি কমার জন্যই এখন আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। বরং মিঠাপানির মাছ ও অসংখ্য প্রাণিজ-উদ্ভিজ প্রজাতি বিলুপ্তির জন্যও বহুল আলোচিত। টাঙ্গুয়ার হাওরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করার পর এর ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা অক্ষুণœ রাখতে হাওর থেকে ইজারাপ্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়ে একে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আনা হয়। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আনার পর হাওরটি ক্রমান্বয়ে অবনতিশীল অবস্থার দিকে ধাবিত হয়েছে। এখন এই সুবিশাল হাওরে মাছ, বৃক্ষ, পাখি সবকিছুই ক্রমহ্রাসমান। পশ্ন উঠেছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই তথাকথিত হাওর ব্যবস্থাপনার তাহলে কী দরকার ছিলো? মূলত আমলাতান্ত্রিক অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি ও জনসম্পৃক্ততার অভাবেই এই অবনতি বলে সকলে একমত হয়েছেন। দুঃখের বিষয় হলো, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এখনও কোনো নতুন ব্যবস্থাপনার চিন্তা করা হচ্ছে না। বরং নতুন করে আগের মতোই এই হাওরকে এনজিও ব্যবস্থাপনা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অতিথি পাখিরা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাই এদের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করতে সরকার পৃথক আইন তৈরি করেছেন। পাশাপাশি অন্তত কাগজেপত্রে পাখির আবাস নিরাপদ রাখার কিছু কর্মসূচীও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুরই প্রয়োগ নেই। নেই নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও হাওরের পরিবেশ বিধ্বংসী উপাদান বন্ধ করার সক্রিয় উদ্যোগ। আজ তথাকথিত পর্যটনের নামে পুরো টাঙ্গুয়ার হাওরকে মেরে ফেলার আয়োজন করা হয়েছে। বিশাল হাওরের কোনো অংশকেই সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়নি। ফলে পর্যটকবাহী নৌকাগুলো যত্রতত্র যাতায়াত করে হাওরের পরিবেশ নষ্ট করছে। এই অপরিকল্পিত পর্যটনের ফলে শুধু পাখি নয় হাওরের পুরো উৎপাদন ব্যবস্থাই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পর্যটকরা হাওরে ব্যাপকভাবে প্লাস্টিক বর্জ ফেলছেন। এতে মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে হাওরে বনায়ন ও মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো কার্যকর পরিকল্পনাও আমাদের চোখে পড়ে না। পানি, পাখি, বৃক্ষাদি, লতাগুল্ম, মাছ প্রভৃতি নিয়েই টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্ভাবনা। এর কোনটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির সংরক্ষণ অসম্ভব। এরা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে হলে সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল অপরিহার্য। সাথে সাথে হাওর তীরবর্তী সাধারণ মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। তথাকথিত আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে হাওর ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এসব কাজ করতে পারলে একটা সময়ে টাঙ্গুয়ার হাওর তার হৃত গৌরব ফিরে পেতে পারে। পরিযায়ী পাখিদের কলকাকলীতেও আবার ভরে উঠবে নির্জন হাওরের বুক। আমরা টাঙ্গুয়ার হাওরের সজীব যৌবনাবস্থা দেখতে চাই।
- জলমহালের তদন্ত/ মৎস্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ
- যান্ত্রিকতায় ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে হালচাষ