হাওর, চর, উপকূল, পাহাড় প্রভৃতি অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে দারিদ্রতার হার বেশি হবে এ কথা সাদা চোখেই বোঝা যায়। কারণ প্রাকৃতিকভাবে প্রতিকূল এসব অঞ্চলের উৎপাদন ও জীবিকার ব্যবস্থা অপ্রতৃল, ঝঁুকিপূর্ণ ও প্রান্তিক পর্যায়ের। আমদের জেলা সুনামগঞ্জকে যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে দেখতে পাব, বিশাল হাওর অঞ্চলে প্রধানত বোরো ধান ছাড়া আর কোনো ধানের উৎপাদন সম্ভব হয় না বছরের সাত মাস হাওর জলমগ্ন থাকে বলে। আগে হাওরে মাছ ধরে বর্ষায় অনেকে কিছু রোজগার করতে পারতেন এখন সেই সুযোগ কমে গেছে কারণ অমনোযোগিতা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা হাওরের মিঠা পানির মূল্যবান ও সুস্বাদু মৎস্যসম্পদের বিলুপ্তি সাধন করে ফেলেছি। হাওরাঞ্চলে গড়ে উঠেনি কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। কিছু মানুষ বাইরে গিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের কাজে নিয়োজিত হয় বটে এবং এতে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর অতিদারিদ্রতা কমলেও এই পরিবারগুলো দারিদ্রতার চক্র থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছল শ্রেণিতে উন্নীত হতে পারেনি। সার্বিকভাবে আমাদের পুরো দেশেরই দারিদ্রতার গ্রাফ খুব বেশি উঁচু—নীচু করার সুযোগ নেই। কারণ দরিদ্র বা অতি দরিদ্র শ্রেণি সাধারণভাবে এখন আমাদের দেশে খাবার সংগ্রহ করাকেই মুখ্য বিবেচনা করে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক অধিকার এই শ্রেণির হাতে পৌঁছানোর মতো বাস্তবতা দৃশ্যমান নয়। বরং সম্পদের অতিরিক্ত পুঞ্জিভবন মানুষের বৈষম্যকে আকাশচুম্বী করে তোলেছে। ্এই বৈষম্য কমানোর জন্য রাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক দিগ্দর্শনের প্রয়োজন রয়েছে ব্যাপকভাবে সেই জায়গায় ঘাটতি বিদ্যমান। বরং প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো এই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়ার জায়গাটিকেই পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। সুতরাং প্রাকৃতিক প্রতিকূল এলাকাসমূহের দারিদ্রতা কমানোর সাথে যদি জাতীয়ভাবে এই হার কমানোর জন্য সঠিক নীতি—দর্শনের চর্চা করা হয় তাহলে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো কঠিন কোনো কাজ নয়। আমাদের সুজলা সুফলা দেশটি প্রাচুর্য ও সম্ভাবনাময়। দেশের সকল সম্পদ ও সম্ভাবনা মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারলে সোনার এই দেশের দারিদ্রতা প্রকৃত অর্থেই জাদুঘরে পাঠানো যাবে। কিন্তু কোথায় সেই দিগ্দর্শন?
উপরের কথাগুলোর অবতারণা করা হলো পল্লী কর্মসহায়ক ফাইন্ডেশনের উদ্যোগে বুধবারে অনুষ্ঠিত অতিদরিদ্রদের জন্য ইউরোপিয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্প শুরুর ওয়ার্কশপের খবর পড়ে। ওই ওয়ার্কশপে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক প্রাকৃতিক প্রতিকূল এলাকাগুলোতে দেশের অন্য এলাকার গড় দারিদ্রতার চাইতে নেতিবাচক অবস্থানের কথাটি স্বীকার করেছেন। পিকেএসএফ এইসব এলাকায় বিদেশি সাহায্যে দারিদ্র বিমোচণের একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিগত কয়েক দশকে দারিদ্রতা বিমোচণের নামে বহু প্রকল্প বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু সাদা চোখে এসব কর্মকাণ্ডের ফলাফল খুব আশাব্যঞ্জক নয়। যেসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ প্রকল্প শুরুর আগে নির্ধারণ করা হয় পরে তার কোনো বাস্তবতা খোঁজে পাওয়া যায় না। দারিদ্রতা কমার অন্যতম কারণ হলো দেশে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি এবং সেগুলোতে কর্মীর বিনিয়োজন, বিদেশ গমন, কৃষির ফলন বৃদ্ধির সফলতা, শিল্পায়ন; এসব। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্রতা বিমোচনের ব্যর্থতা এখন প্রমাণিত। দরিদ্র গ্রামবাসীর বহুজন এখনও এই ঋণ জালের দুঃসহ বোঝা বয়ে চলেছেন। দারিদ্র বিমোচনের জন্য দরকার ব্যাপক কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সকলের অভিগমনের নিশ্চয়তা বিধান তথা জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন। যতদিন এই সরল সত্য অনুধাবনে আমরা ব্যর্থ হব ততদিন দেশের একটি বড় শ্রেণি অন্য ক্ষুদ্র শ্রেণিটির তুলনায় সম্পদে—সুযোগে—ন্যায্যতায় অনেক অনেক পিছিয়ে থাকবে। শুধু ক্ষুধা নিবারণের নামই দারিদ্রমুক্তি নয়। নিজেদের ও সন্তান সন্ততিদের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে আরও বিকশিত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই উন্নয়ন। আমরা সেই প্রকৃত উন্নয়ন দেখতে চাই।
- শান্তিগঞ্জে মাদকের বিরুদ্ধে ফুটবল টুর্নামেন্টের সমাপ্ত
- মাঠ জুড়ে মাচায় দুলছে চাল কুমড়া