স্বপন কুমার বর্মন, বিশ্বম্ভরপুর
ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের রাজ্যের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হাওর নদী নালা বেষ্টিত উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর। উপজেলায় আগে তেমন কোনো পর্যটন স্পট ছিল না। তবে পর্যটক আকর্ষণে ও স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নে উপজেলায় হাওর বিলাস, পাহাড় বিলাসসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নান্দনিক উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার। এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মো. সাদি উর রহিম জাদিদ।
জানা যায়, বেকার তরুণ তরুণীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, শিশুদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধনের জন্য একটি শিক্ষা ও বিনোদনমূলক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে উপজেলা প্রশাসন মাল্টিপারপাস সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদরের টিএনটি অফিসের সামনে দেড় একর জায়গার উপর উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার নির্মিত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। সেন্টারটি কম্পিউটার ক্লাব ও ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং সেন্টার, পাবলিক লাইব্রেরি, ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ডিসপ্লে সেন্টার (প্রদর্শনী কেন্দ্র), শিশু একাডেমী, মিনি শিশু পার্ক, বিউটি পার্লার, সেলুন, জিমনেসিয়াম (ব্যায়ামাগার), রেস্টুরেন্ট, মার্কেট এরিয়া, এ্যাম্পিথিয়েটার নিয়ে গঠিত। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ জনেরও বেশি বেকার তরুণ তরুণীর। সেন্টারের সৌন্দর্যবর্ধনে পানির ফোয়ারা, ভাস্কর্য, ফুলের বাগান ও দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার পরিচালনায় গঠনতন্ত্র এবং কমিটি রয়েছে। এখান থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৫০% অর্থ রক্ষণাবেক্ষণ ও ৫০% অর্থ উপজেলা শিক্ষা ফাউন্ডেশনে জমা করা হচ্ছে। উপজেলা শিক্ষা ফাউন্ডেশনটি ২০১২ সালে উপজেলা প্রশাসনের তত্ববধানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফাউন্ডেশন থেকে উপজেলার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ প্রদান করা হয়।
সেন্টারের মাধ্যমে যেভাবে উপকৃত হচ্ছেন স্থানীয়রা
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫ জন বেকার যুবক-যুবতীর মাধ্যমে কম্পিউটার ক্লাব ও ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এটি তিনটি ধাপে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হলো- বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদান ও সাইবার ক্যাফে। ব্যাচ ভিত্তিক বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান। ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল উদ্যোক্তাদের দিয়ে যুবক-যুবতীদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ।
পাবলিক লাইব্রেরিতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বইও রয়েছে। যে কেউ সদস্য হয়ে বই পড়তে পারবেন। এদিকে ল্যাংগুয়েজ ক্লাব পরিচালনা করছেন পাঁচ জন শিক্ষক। এখানে ইংলিশ স্পোকেন ল্যাংগুয়েজ ও শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা শেখানো হয়।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে যারা ভালো হস্তশিল্প ও পোষাক তৈরি করছেন তাদের পণ্য ডিসপ্লে সেন্টারে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এতে পণ্যগুলো বাজারজাতকরণ সহজ হয়েছে এবং তাদের আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশু একাডেমীতে কিশোর কিশোরী ক্লাবের ক্লাবের প্রশিক্ষকগণ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ভর্তির মাধ্যমে সঙ্গীত, আবৃত্তি, নাচ ইত্যাদি শেখাচ্ছেন। কার্যক্রম মনিটরিং করছে উপজেলা শিল্পকলা কমিটি।
ইনডোর শিশু পার্ক, মিনি শিশু পার্কে রয়েছে ইনডোর গেইম, মেরিগো রাউন্ড, হর্স রাইটসহ অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা। ইনডোর শিশু পার্ক একজন উদ্যোক্তার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
বিউটি পার্লার মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতাধীন আইজিএ (বিউটিফিকেশন) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ৪ জন নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এনজিও বিআরডিএস এবং উপজেলা মহিলা সংস্থাও তাদের আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের সাথে অস্থায়ী চুক্তি করে নারী উদ্যোক্তারা এটি পরিচালনা করছেন।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘ওস্তাদ-সাগরেদ’ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ৪ জন তরুণ ব্যবসায়ী সেলুন পরিচালনা করছেন।
উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার তত্ববধানে একজন উদ্যোক্তা জিমনেসিয়াম (ব্যায়ামাগার) পরিচালনা করছেন।
তরুণ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের সাথে অস্থায়ী চুক্তির ভিত্তিতে রেস্টুরেন্ট পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়াও মার্কেট এরিয়ায় কম্পিউটার সেলস ও সার্ভিস সেন্টার, শিশুদের খেলনা দোকান, লেডিস টেইলার্স ও স্কুল ইউনিফর্ম শপ, স্টেশনারী, কসমেটিক্স ও গিফট কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে।
মিনি এ্যাম্পিথিয়েটার সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এখানে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, উপজেলা প্রশাসনের মাল্টিপারপাস সেন্টার চালু হওয়ায় উপজেলায় আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে এবং আমাদের কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি বেনজির আহমেদ মানিক বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গ্রামকে শহরে বানানোর পরিকল্পনায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। হাওর বিলাস, পাহাড় বিলাসসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটের পর নান্দনিক উপজেলা প্রশাসন মাল্টিপারপাস সেন্টার চালু হয়েছে। এজন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাদি উর রহিম জাদিদ নিরলস পরিশ্রম করছেন। দেশ-বিদেশে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টারের প্রতিষ্ঠায় নারী উদ্যোক্তাদের উপার্জন বৃদ্ধি, যুবক-যুবতীদের ব্যবসার প্রসার, নিম্ন আয়ের পরিবারের মানুষদের পারিবারিকভাবে বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও তরুণ ফটোগ্রাফারদের উপার্জনের ক্ষেত্র, স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য অবকাশ যাপনের একটি শিক্ষাবান্ধব ও বিনোদনমূলক পরিবেশ, জনসাধারণের উন্নত ও স্মার্ট সেবা গ্রহণের সুযোগ, শিশুদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, দর্শনার্থী ও সেবা গ্রহীতাদের ব্যাপক আগমনের এই অঞ্চলের অনেক বেকার যুবক মোটরবাইক, ইজিবাইক, সিএনজি চালিত অটোসহ বিভিন্ন ধরণের যানবাহন চালিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। সর্বোপরি বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও মাল্টিপারপাস সেন্টার হওয়ায় উপজেলার জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তরুণ সমাজকে মাদক, জুয়া খেলা থেকে দূরে রাখছে।