বিশেষ প্রতিনিধি
‘বায়রে (বাইরে) কী ঠান্ডা লাগে, কোয়ায় (কুয়াশা) মাথা ভিজি (ভিজে যায়) যায়, উপরেতো (উপরে) ছাল নাই, স্যারে কইছইন আরও বউতদিন (বহুদিন) বায়রে বওন (বসা) লাগবো।’
গাছতলায় বসে ক্লাস করার সময় শাল্লার কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মোবারক মিয়া এভাবেই বলছিল।
পাশে বসা একই ক্লাসের শিক্ষার্থী মারজানা বললো, ‘আপনেরা আমরার স্কুলটা তাড়াতাড়ি বানাইয়া দেইন না, তাইলেতো কষ্ট করা লাগতোনায়, মেঘ (বৃষ্টি) দিলেতো ক্লাস অয় না।’
ভাটির তলানির এই বিদ্যালয়টির পুরোনো স্কুলঘর ভেঙে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে গেল মার্চ মাসের শুরুতে। সেই থেকে বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান হয় স্কুলের সামনের গাছতলায়।
হাওর টাইপের এই স্কুল ভবন নির্মাণের সময় শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য অস্থায়ী শেড নির্মাণের কথা। নির্মাণকারী সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) শেডের জন্য এক লাখ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিলেও এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য কোন শেড হয় নি।
শুরু থেকেই পাঠদান চলছিল গাছতলায় খোলা আকাশের নীচে। এপ্রিলের বন্যার সময় কাজ বন্ধ করে ঠিকাদারের মিস্ত্রীরা বাড়ি চলে গেলেও বন্যার পর মিস্ত্রীদের ছোট্ট শেডে কয়েকদিন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করানো হয়েছে। অন্যরা বসেছে গাছতলায়। সম্প্রতি আবার মিস্ত্রীরা এসে কাজ শুরু করলে, মিস্ত্রীদের শেড থেকে বের হয়ে এসেছে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। ঠিকাদার পাশর্^বর্তী বাড়ির একটি ছোট কক্ষ ভাড়া নিয়ে দিয়েছে পাঠদানের জন্য। ওখানে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গাধাগাধি করে তিনজন শিক্ষক নিয়ম রক্ষার পাঠদান সেরে নিচ্ছেন।
জানা গেছে, ওই বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ২৩, প্রথম শ্রেণিতে ১৮, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২৩, তৃতীয় শ্রেণিতে ২১, চতুর্থ শ্রেণিতে ১১ এবং পঞ্চম শ্রেণিত ১২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী বসতে পারে না ঠিকাদারের ভাড়া করা ঘরে। গাছতলায় পাঠদান হলেও আবহাওয়া খারাপ অর্থাৎ অতিরিক্ত কুয়াশা বা আকাশে বৃষ্টি থাকলে বন্ধ হয়ে যায় পাঠদান কার্যক্রম।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইলিয়াস মিয়া জানালেন, শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের খোলা আকাশের নীচে গাছতলায়ই ক্লাস করানো হচ্ছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। ওয়াশরুম না থাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদেরও গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে যেতে হয়। টিউবওয়েলও নেই সরকারি এই বিদ্যালয়ে।
শিক্ষিকা নিপা চৌধুরী বললেন, বিদ্যালয়ের পরিবেশ দীর্ঘদিন এভাবে থাকলে পাঠদান ব্যাহত হবে।
প্রধান শিক্ষক সজল কান্তি তালুকদার জানালেন, ভবন নির্মাণকালে শিক্ষার্থীদের শেড’এর জন্য এক লাখ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দের বিষয়টি তার জানা ছিল না। তিনি আজই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন।
এই বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ঠিকাদার মঈনুদ্দিন আহমদ নামের ধর্মপাশার একজন ঠিকাদার। তার কাছ থেকে সাব ঠিকা নিয়েছেন ধর্মপাশার শামীম আহমদ নামের এক সাবঠিকাদার।
শামীম আহমদকে এই কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন, এই বিষয়ে আমি বলতে পারবো না। মূল ঠিকাদার মঈনুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন তিনি। কাজ কবে শেষ করা যাবে প্রশ্ন করলে বললেন, বর্ষার পানি তাড়াতাড়ি এলে কবে শেষ হবে বলা যাবে না। পানি বিলম্বে আসলে সাত মাসে কাজ শেষ করা যাবে।
এলজিইডির শাল্লা উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী নুরুজ্জামান বললেন, কৃষ্ণপুর বিদ্যালয়ের ভবনটি হাওর টাইপের হচ্ছে। চারতলা ফাউন্ডেশনের ভবনটি নীচের অংশসহ তিন তলা হবে। নয় মাসে ভবনের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ওই সময়ে কাজ শেষ করা যাবে না। ঠিকাদারের উপর নির্ভর করছে কতদিনে কাজ শেষ হবে। ভবন নির্মাণকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য শেড নির্মাণের বরাদ্দ আছে। শেড না হয়ে থাকলে প্রধান শিক্ষক এবং ঠিকাদারকেই দায় নিতে হবে। প্রধান শিক্ষক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি বিষয়টি জানিয়ে দেব।
শাল্লা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তাপস রায় বললেন, দুইদিন আগে কৃষ্ণপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি ওখানে শিক্ষার্থীরা গাছের নীচে পাঠদান করছে। পাঠদানের জন্য যে কক্ষটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, ওখানে শিক্ষার্থীদের স্থান সংকুলান হয় না। ছোট কক্ষে গাধাগাধি করে কিছু শিক্ষার্থী বসে থাকে। বৃষ্টি হলে পাঠদানে সমস্যা হবে।
- মসজিদ-মন্দিরে প্রচারণা, কমেছে মামলা
- দিরাইয়ে প্রতারণামূলক পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহর