বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর জলপ্রবাহ মানুষের নিঃশ্বাসের সাথে তুলনীয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হলে যেমন মানুষ আর জীবিত থাকে না তেমনি কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের বেঁচে থাকার উপকরণ হলো অসংখ্য নদী, খাল, বিল, নালা প্রভৃতি জলাধার। মানুষের শরীরে অসংখ্য ছোট বড় রক্তনালী যেমন সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন করে তেমনি পুরো দেশকে জালের মতো বেষ্টিত করে রাখা নদীগুলো বাংলাদেশ নামক বিশাল দেহটিকে জল প্রবাহ করে জীবন্ময় করে রেখেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে আজ এই প্রাণপ্রবাহরূপ নদীগুলো একে একে মরে যাচ্ছে। নদীকে মেরে ফেলার বহু আয়োজন এই আমরাই করে চলেছি নিত্যদিন প্রতিমুহূর্তে। নদীর তলদেশ অবাধে ভরাট হতে দিচ্ছি, নদী খুঁড়ে তলদেশ থেকে বালি আহরণ করে গঠনপ্রকৃতি বদলে দিচ্ছি, প্রবাহের মুখে বাঁধ দিয়ে গতিপথ বন্ধ করে দিচ্ছি, বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে নদীর নিঃশ্বাস নেয়ার ক্ষমতা হরণ করছি। এসব কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী আজ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের উৎপাদন, আবহাওয়া ও জলবায়ুতে। কিন্তু বোধোদয় নেই আমাদের। নিষ্পৃহ থেকে আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি আর এক অন্ধকার ভবিষ্যতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
গতকাল দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরে জামালগঞ্জের পিয়াইন নদী নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে যেখানে একসময়ের খর¯্রােতা নদীটির চরম অসুস্থতার খবর পরিবেশন করা হয়েছে। আর দশটা নদ-নদীর মতো এই পিয়াইনও আজ মনুষ্যসৃষ্ট অনাচারের কারণে মরতে বসেছে। এই নদীটি সুরমা নদীর সাথে সংযুক্ত ছিলো। সেই সংযোগ মুখটি আজ বন্ধ হয়ে গেছে স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ দেয়ার কারণে। পাহাড়ী ঢলের সাথে নেমে আসা পলি মাটি ভরাট করে দিয়েছে নদীর তলদেশ। খর¯্রােতা নদীর উভয় তীরে মাইলের পর মাইল এলাকায় এখন ধান ও সবজি চাষ হয়। নদীকে সবসময় সচল রাখতে হয়। যেকোনো জলপ্রবাহের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। জলপ্রবাহের লক্ষ্য থাকে সমুদ্রের পানে। তার প্রবাহ পথে বাঁধা তৈরি করলেই বিপত্তি ঘটে। পিয়াইন নদীর ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেছেন পিয়াইন নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর দুই পাশের বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে সেচ সংকট তৈরি হয়েছে। নষ্ট হয়েছে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন। তিনি নদীটি খনন ও এর গতিপথ খোলে দেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন। আমরা তাঁর এমন দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মূল কারণ হলো নদীগুলোর নাব্যতা সংকট । এর ফলে আমাদের সুফলা বিশাল শস্যক্ষেত্রগুলো অনাবাদী থেকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। শুধু যন্ত্রনির্ভর বা ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে সেচ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। বেশি বেশি ভূগর্ভস্থ পানি তোলার কারণে তৈরি হয় নানা সংকট। বিশেষজ্ঞরা ভূমির উপরিভাগের পানি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন। এটি করতে গেলে আমাদের জলাধারগুলো রক্ষা করতে হবে। জামালগঞ্জের প্রাণ ও প্রকৃতির উপর পিয়াইন নদীর যে অপরিমেয় অবদান তাকে রক্ষা না করা গেলে ভোগবে এই অঞ্চলের মানুষ। মানুষ হারাবে চিরায়ত জীবিকার প্রাকৃতিক আশীর্বাদ। এরকম অবস্থা কাক্সিক্ষত নয়। সুতরাং পিয়াইন নদী রক্ষায় যা যা করা দরকার তাই করার উদাত্ত আহ্বান আমাদের। নদীর আশীর্বাদকে গ্রহণ না করার মত মূর্খতা অনেক দেখানো হয়েছে। এখন একটু দূরদর্শী হওয়ার সময় এসেছে। সময় হয়েছে নিজের দেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে এর পূর্ণ সুফল ঘরে তোলার যোগ্যতা দেখানোর। নিজের ঠাকুর ফেলে পরের কুকুরকে আর কত আদর করব আমরা? সময় এসেছে স্বদেশমুখী হওয়ার। আসুন এই মনোভাবের জাগৃতি ঘটিয়ে পিয়াইনসহ সমস্ত মৃতবৎ নদ-নদী রক্ষাকে আমরা জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করি।
- পিয়াইন নদী এখন মরা খাল/নদীর ৫ কিলোমিটার এলাকায় চলছে চাষাবাদ
- সুনামগঞ্জে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স/ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালনে গুরুত্বারোপ