প্রকৃতির সাথে মিতালী করে তৈরি হোক হাওর পরিকল্পনা

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, ‘হাওরের মধ্যে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে আমরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি। বাঁধ নির্মাণ আদতে আমাদের ক্ষতি করে। ফলে আমরা বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত যেকোনো প্রকল্প যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।’ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী হাওরে নতুন করে কোনো সড়ক নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা প্রধানমন্ত্রীর ওই কথারই প্রতিধ্বনি। শনিবার ঢাকায় সেন্টার ফর হলিস্টিক স্টাডিজ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত পরিবেশ ও দূষণ প্রতিকার বিষয়ক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী আরও অনেক কথার সাথে এই কথাগুলোও বলেছেন। হাওরবাসী হিসাবে আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পারি, বড় আকারের পাহাড়ি ঢল কিংবা অকাল বন্যার হাতে থেকে হাওরে নির্মিত বাঁধগুলো ফসল রক্ষা করতে পারে না। পানির চাপে হুড়মুড় করে এসব বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তাই ফসলকে অকাল বন্যা কিংবা পাহাড়ি ঢলের হাত থেকে বাঁচাতে বাঁধ ও এর সাথে বিকল্প আরও কী কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে তা নিয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা শুরু হয়েছে। হাওরজোরে এখানে-সেখানে নির্মিত বাঁধগুলো হাওরের চরিত্র অনেকক্ষেত্রে পালটে দিচ্ছে। বাঁধের মাটিতে হাওর ভরে যায়। বর্ষার সময় এসব বাঁধের কারণে হাওরের পানিপ্রবাহ বিঘিœত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরের বোরো ফসল রক্ষা করতে মোটামুটি মাসখানেক সময় হাওরে যাতে পানি ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। হাওরে পানি ঢুকে সাধারণত দুইটি উপায়ে। সবচাইতে বিপদজনক হলো ভারতের পাহাড়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতজনিত পানি গড়িয়ে নীচে নেমে হাওরকে প্লাবিত করে। পাহাড়ি ঢলের এই পানি ছোট ছোট নদী, নালা, ছড়া দিয়ে প্রবাহিত হয়। এসব নদী, নালা, ছড়ার সাথে সংযোগ আছে বড় নদ-নদীগুলোর। কিন্তু নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এসব নদী পাহাড়ি ঢলের পানিকে বয়ে নিতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত পানি হাওরে ঢুকে পড়ে। এখন যদি আমরা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করে পাহাড়ি ঢলের পানি নদী দিয়ে সরিয়ে নিতে পারি তাহলে একটি সমাধান পাওয়া যেতে পারে। এজন্য দরকার নিয়মিত নদী খনন করে নাব্যতা বৃদ্ধি করা। আঁকাবাঁকা নদীগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে সোজা করে দিয়ে পানির চাপ সহনীয় করে তৈরি করতে হবে।
অন্য যে কারণটি, তা হলোÑ অভ্যন্তরীণ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত। আমরা জানি প্রতিটি হাওরে রয়েছে অসংখ্য খাল, নালা, বিল, জলাশয়। এগুলো হাওরের রক্ষাকবচ। হাওরে পতিত বৃষ্টির পানি এসব প্রাকৃতিক উৎস নিজের মধ্যে ধারণ করে বাইরে বের করে দিতে সক্ষম হয় যদি সেগুলোর পুনরুজ্জীবন করা যায়। হাওর মধ্যস্ত এসব প্রাকৃতিক খাল-নালা এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভরাট হয়ে গেছে। ফলে হাওরের পানি-ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমাদেরকে হাওর রক্ষায় তাই প্রচলিত চিন্তা-ভাবনার সৃজনশীল উন্নয়ন ঘটাতে হবে। যা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর কণ্ঠেও উচ্চকিত হচ্ছে। সবচাইতে বড় কথা হলো, সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও দেশপ্রেমসুলভ আন্তরিকতা ও দক্ষতা দিয়ে তার বাস্তবায়ন। আমরা জানি আমাদের উন্নয়ন কাজের একটি বড় অংশ এখন দুর্নীতির মাধ্যমে নাই হয়ে যায়। এরকম হলে ভালো পরিকল্পনা করেও কোনো লাভ হবে না। হাওর-প্রকৃতি এখন আমাদের নিকট থেকে চরম দেশপ্রেম আশা করছে। সেটি যদি দেখানো সম্ভব হয় তাহলে হাওরকে প্রাকৃতিক ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখা কঠিন কাজ হবে না।
পরিকল্পনামন্ত্রী হাওর এলাকার লোক। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই হাওরের হাসি কান্না টের পান হৃদয়ের গভীরে। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে আমরা এটি বিজ্ঞানসম্মত হাওর উন্নয়ন পরিকল্পনা চাই। আমরা আশা করতে চাই প্রকৃতির সাথে মিতালী করে তৈরি হওয়া সেই পরিকল্পনা হাওরকে রাখবে বিপদমুক্ত, রক্ষা পাবে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি।