বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
জামালগঞ্জের হাওর এলাকায় মাছখেকোদের ফসল রক্ষা বাঁধ বিধ্বংসি হানা অব্যাহত আছে। প্রায় প্রতিবছরই হাওরের কোন না কোন বাঁধ কেটে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে এই লোভী চক্র। এ বছরও মাছ আহরণসহ হাওরের অভ্যন্তরে বিলের সাথে নদীর জলাধার সচল রাখতে হালি হাওরের গনিয়ার কাড়া অংশের বাঁধ কেটে বড় ক্লোজারের সৃষ্টি করা হয়েছে। এ নিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর হালি হাওর পারের কৃষকেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আগাম বন্যা-খরাসহ দুর্যোগপ্রবণ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে জীবিকা নির্বাহ করেন হালি হাওর পারের কয়েক হাজার কৃষক পরিবার। তারা বছরের একমাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল। হালি হাওর পারের বদরপুর গ্রামের পশ্চিমে গনিয়ার বিলসংলগ্ন আফর বাঁধটি গনিয়ার বাঁধ হিসেবে পরিচিত। এ বাঁধটি গত বোরো মৌসুম শেষে বদরপুর গ্রামের গনিয়ার বিলের ইজারাদার রুহুল আমিনসহ কয়েকজন মাছ ধরার স্বার্থে বাঁধটি কেটে দেয়। বর্তমানে সেখানে জাল পেতে মাছ শিকার করছে তারা। পানি কমার সাথে সাথে ভাঙ্গার গভীরতা বাড়লেও কারও বাধা মানছে না ইজারাদারের লোকেরা। এতে আগামী বোরো মৌসুমে ভাঙ্গনকৃত বাঁধটি হালি হাওরের জন্য চরম ঝুঁকির কারণ হবে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে অভিযুক্ত রুহুল আমিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গনিয়ার বিলের ইজারাদার অন্য কেউ জানিয়ে বাঁধ ভাঙ্গনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বোরো মৌসুমে অকাল বন্যায় হালি হাওরের এই গনিয়ার বিল অংশের বাঁধই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছিল। পরে স্থানীয় কৃষক ও প্রশাসনের জোর প্রচেষ্টায় এ বাঁধের ঝুঁকি ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। কৃষকের ফসল রক্ষায় সরকার প্রতিবছর অঢেল অর্থ ব্যয়ে হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করলেও মাছখেকোরা ফসল রক্ষা বাঁধ ধ্বংসে মত্ত রয়েছে। এতে ভাঙ্গনকৃত অংশ বিপজ্জনক ক্লোজারে রূপ নেওয়ার পাশাপাশি ভঙ্গুর ক্লোজার ভরাটে বাড়তি বরাদ্দসহ কৃষকদের অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিচ্ছে মাছখেকো সিন্ডিকেট। প্রতিবছর এ অবৈধ চক্র সরকারি অর্থের অপচয়সহ কৃষকের সর্বনাশ ডেকে আনলেও এদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে কৃষক ও হাওর সচেতন মানুষের মাঝে ক্ষোভ ও অস্বস্তি বিরাজ করছে।
বেহেলী ইউনিয়নের হালি হাওরের তীরবর্তী বদরপুর-হাওড়িয়া আলীপুরের মাঝ বরাবর গনিয়ার বিলের ভাঙ্গনকৃত অংশে গিয়ে দেখা যায়, হালি হাওর পারের এ বাঁধ কেটে বিশাল গর্তের সৃষ্টি করা হয়েছে। ভাঙ্গনকৃত বাঁধের এক পার থেকে আরেক পারের দূরত্ব প্রায় দেড়শ ফুট হবে। ভাঙ্গা স্থানে বাঁশের আড়ে জাল ঝুলিয়ে মাছখেকোরা তাদের উপস্থিতির জানান দিয়েছে। ভাঙ্গার বিপরীত অংশে তাঁবু গেড়ে আশ্রয় নিয়েছে মাছখেকো সদস্যরা। বাঁধসহ বাঁধের আশেপাশে মাছখেকোদের অবৈধ কর্মকান্ডের নানা চিহ্ন চোখে পড়েছে।
এ সময় বিপরীত পারের তাঁবুতে অবস্থান করা তক্কুল মিয়ার কাছে বাঁধ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানিয়েছেন, বাঁধ তারা কাটেননি। পানির চাপে এটি এমনি এমনি ভেঙ্গে এমনটা হয়েছে। তারা গনিয়ার বিল রেখেছেন। বদরপুরের এক মৎস্য সমিতির নামে ইসলামপুর গ্রামের আউয়ালসহ কয়েকজন এ বিল ইজারা নিয়েছেন। তিনি তার অংশীদার এবং বর্তমানে বিল পাহাড়া দেওয়ার জন্য এখানে অবস্থান করছেন।
বাঁধ কাটার বিষয়টি অস্বীকার করে গনিয়ার বিলের ইজারাদার আউয়াল মিয়া বলেন, ‘না ভাই, আমরার এইডা ভাঙ্গার কোন দরকার নাই। এইডা যদি আরও পন্ড (পনেরো) দিন আগে ভাঙতো তাহইলে আমরা নিরাপত্তা আছলাম। এইডার লাগি তো আমরার উড়া বাইন্ধ্যা থাকন লাগে। আমরা আরও লসে আছি। বর্ষাকালে কেডা ভাঙছে, অখন কিতা কইতাম।’
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, আমি কয়েকদিন আগে হালি হাওরের গনিয়ার কাড়া বাঁধে গিয়েছিলাম। ওই বাঁধে বিশাল ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। জেলে ও ইজারাদাররা মাছ ধরার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এটি ভেঙ্গেছে। তারা প্রতিবছরই এমনটা করে। এরা এমন একটা শ্রেণি, যারা বন্যায় বাঁধ ঝুঁকিতে পড়লে প্রশাসন কিংবা কৃষকেরা উরা-কোদাল নিয়ে ডাকলে আসে না। এরা কৃষকের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত সামন্ত সরকার বলেন, আমরা সরজমিনে গিয়ে ভাঙ্গনের বিষয়টি দেখেছি। কে বা কারা বাঁধটি কেটেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। সবকিছুই অনুমাননির্ভর। যাদের নাম এসেছে তাদেরকে শাসানো হয়েছে। অভিযোগের বিষয়টি ইউএনও মহোদয় দেখবেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, হ্যাঁ, অভিযোগ হয়েছে। সেটা তদন্ত হয়েছে। এখন যাচাই-বাছাই আমরা করব। উপজেলা কমিটির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সব বিষয়টাই প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।
- তাহিরপুরের দুই সরকারি অফিসের অপচর্চা/ পুরো ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই কাম্য
- দুই কৃষকের উদ্যোগ/ ৫১ একর অনাবাদি জমিতে সোনালি ফসলের ঝিলিক