বটবৃক্ষ সম মানুষটি খসরু ভাই

গৌরী ভট্টাচার্য্য
লেখাপড়ার মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমোহন রায় এর সাথে। এই চেনাজানার পরিধি অনেক বড় হলেও, চর্চায় ধারণ করতে হয়। নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য অনাচার দূর করতে এই দুই জন মহাপুরুষের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। নারী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে যখন কাজে নেমে এলাম, তখনই এই দেশের গ্রাম-শহরের সর্বত্র নিভৃতচারী, নারী-পুরুষের সম অধিকারে বিশ্বাসী অসংখ্য পুরুষের সাথে দেখা, পরিচয় ও পথচলা।
তেমনি একজন সুনামগঞ্জ শহরের সুপরিচিত ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, ১৯৭১ সালের রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু। পরিচয়ের সূত্র ১৯৮৪ সাল। দীর্ঘ সময় যে মানুষটির সাথে একটা মধুর সম্পর্কের ভিতর দিয়ে আমি একজন গৃহবধূ হিসাবে তিনি আমাকে বৌদি সম্বোধন করে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে তুললেন। এই সম্পর্কের সাথে বন্ধুদেরও যুক্ত করলেন। সবার প্রিয় বৌদি হলাম। বন্ধুরা অনেক আগেই গত হয়েছেন।
এভাবেই চলছিলো। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত হলাম। আনাড়ি একজন কর্মী। ভালোলাগা থেকেই কাজ করি। খসরু ভাই মাঝে দেখা হলেই সংগঠনের খোঁজ খবর নিতেন। পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট দেখলে খুশী হয়ে ফোন দিয়ে উৎসাহ দিতেন। নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে মনে প্রাণে সমর্থন দিয়ে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, ‘‘মহিলা পরিষদকেই শক্তিশালী ভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’’ নারী-পুরুষের সমতার ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। বিষয়টি আমার অজানা ছিলো। কোনো সমস্যায় পড়ে উনার দ্বারস্থ হলেই সমাধান পেয়ে যেতাম। তখনই দেখেছি তিনি উদার মনে এগিয়ে এসে সাহস জোগাতেন।
২০০৭ সাল। আমি তখন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাথী চৌধুরী সাংগঠনিক সম্পাদক। সংগঠন থেকে ৭ জনের একটি টিম করে লিগ্যাল এইডের কাজ সাংগঠনিক নিয়মে সম্পন্ন করার পর একটা পক্ষ প্রতিবাদের বিষয়টিকে মিথ্যা উপস্থাপন করে। আমাদের দু’জনকে ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবগত করি। খসরু ভাই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার আইন উপদেষ্টা। উনাকেও ফোনে জানালাম। শুনেই তিনি ছুটে এলেন। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘‘ঠিক আছে। যখনই প্রয়োজন পড়বে, আমাকে ফোন করবেন।’’ সাংগঠনিক এই সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিচলিত হলেন। তখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আয়শা খানম। তিনিও খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন আমাদেরকে পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। আমরাও ভেবে পাইনা কি করবো। খসরু ভাই তখন খুব সাহস দিয়ে বললেন, ‘‘আপনারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। আপনারা তো অন্যায় করেননি! চুপ করে বসে থাকেন।’’
এদিকে কেন্দ্রীয় কমিটি জেলার দুইজন সংগঠককে রক্ষা করতে সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বশরীরে বিশাল এক টিম নিয়ে সুনামগঞ্জ ছুটে এলেন। উনাদের আসার খবর শুনে খসরু ভাই ছুটে এলেন। কেন্দ্রীয় নেত্রীদের সাথে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে সময় দিয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার প্রতি খসরু ভাইয়ের আন্তরিকতা দেখে কেন্দ্রীয় কমিটি খুশি হন।
তিনি ছিলেন নিভৃতচারী সব দিক থেকে। উনি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেটা জেনেছি অনেক পরে। আলোচনা প্রসঙ্গে কখনো এই বিষয়টি সামনে আনেননি। নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতো না, তবে খোঁজ খবর রাখতেন।
২০০৯ সাল। আমি অসুস্থ। আমি ঢাকায় চিকিৎসাধীন। আমিও কাউকে বলে যাইনি। অসুস্থতার খবর শুনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ আমাকে ঢাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। সব দায়িত্ব দিদি নিলেন। দিদি শুধু একা নন পরিবারের সবাই (দিদির জীবনসঙ্গী পঙ্কজ ভট্টাচাার্য, বোন বহ্নিশিখা দাশ পুরকায়স্থ, ভগ্নিপতি ডা. মানস বসু)।
আমি তখন আমার জীবনসঙ্গী সহ ধানমÐিতে দিদির বাসায়। খসরু ভাই নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ করতেন। সব জায়গায় দলবদ্ধ পদচারণা এবং সব কিছুতেই সৃজনশীলতা। পরবর্তীতে সোনালীসকাল নামে প্রাতঃভ্রমণের সংগঠনের পরিচিত পায়। আমিও মাঝে মাঝে প্রাতঃভ্রমণে বের হতাম। এই টিমের সঙ্গে দেখা হতো। সেই টিমে ছিলেন অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায়। সম্ভবত আমাকে না দেখতে পেয়ে, আমার খোঁজ নিয়ে জানলেন আমি অসুস্থ ও চিকিৎসাধীন ঢাকায়। খসরু ভাই আমাকে ফোন করলেন। খোঁজ খবর নিলেন। কোথায় আছি ঠিকানা জানতে চাইলেন। খানিকটা রসিকতা করে বললেন, ‘‘শহরের দুইজন নেতা-নেত্রী অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায়, আমাদের কি দায়িত্ব নেই?’’
সত্যি সত্যি সবাইকে অবাক করে ঠিক পরের দিন ভোর বেলা ঢাকায় পৌঁছেই ফোন করলেন। সোজা চলে এলেন ধানমÐিতে রাখীদি’র বাসায়। উনার সঙ্গে ছিলেন স্বপন’দা । সেই সকালটাকে অন্যভাবে সাদরে গ্রহণ করলেন রাখী দি। সকালের খাবারের নানান আয়োজন। খাবার টেবিলে সিলেটি ভাষায় আড্ডা গল্পে মুখরিত হলো রাখীদি’র ধানমÐির বাসা। অল্প সময়েই জমিয়ে ফেললেন। সকালের খাবার শেষ করে ছুটে গেলেন সহযোদ্ধা বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.ত.ম সালেহ ভাইকে দেখতে। সেই সকালটা আজও আমার স্মৃতিতে অ¤øান। রাখীদি’ও নেই, খসরু ভাইও নেই।
এভাবেই নিভৃতে অসংখ্য দায়িত্ব পালন করে অভিভাবকের অবস্থান সুদৃঢ় করে রেখেছিলেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই।
সম্ভবত ১৯৮৬ সাল, খসরু ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো মৌলভিবাজার। আমাকে বললেন, ‘‘আপনার শ্বশুরবাড়ি আর আমার শ্বশুরবাড়ি এক জায়গাতেই হচ্ছে। কারণ আমার শ্বশুর বাড়িও মৌলভিবাজারে।’’আমার ছোট বোন মৌলভিবাজারে থাকে। ওর সাথে উনারও ভালো সম্পর্ক। আমাকে বললেন, ‘‘গঙ্গাকে বলেন, কন্যার খোঁজ খবর নিতে। ’’আমি বললাম, ‘‘বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। এখন আর খোঁজ নেয়ার দরকার নেই।’’ খুব হাস্যরস করে বললেন, ‘‘বলেনকি! মানুষ একটা চাঁদ পায়না। আর আমি ডাবল চাঁদ ঘরে আনবো। খোঁজ নেবো না? কারণ কনের নাম ছিলো মুনমুন চৌধুরী। এমনই চাঁদের আলোয় আলোকিত সংসার এবং আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে চলে গেলেন খসরু ভাই।
২০১২ সালে উদীচী আয়োজিত বাংলা নববর্ষ অনুষ্ঠানে আমাকে বললেন, ‘‘এখন কলম ধরুন। সব লিপিবদ্ধ করুন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমের সকল অভিযান পত্রপত্রিকায় দেখেন। এই সূত্র ধরে বললেন, ‘‘দুঃসাহসিক অভিযান ধারাবাহিক লিখে রাখুন। আগামী প্রজন্ম এখান থেকেই কাজের নিশানা ঠিক করবে ও অনুপ্রেরণা পাবে।’’
২০১৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একাদশ জাতীয় সম্মেলন। সেই সম্মেলনে কৃষক, শ্রমিক, তৃণমূল নারীদের আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণের প্রস্তাব পেয়ে সাথে সাথে রাজী হয়ে যাই। একজন কৃষক নারী বোনের নাম পাঠিয়ে দেই। কৃষক নারী বোনকে প্রস্তুত করে জাতীয় সম্মেলনে সদলবলে হাজির হই। নির্ধারিত সময়ে কৃষক নারী বোন মাজেদা তার বক্তব্যে কৃষক নারী জীবনের কথা তুলে ধরলো। হলের মধ্যে ছিলো তখন অন্যরকম নীরবতা। বক্তব্য শেষে ছিলো মূহুর্মূহু করতালি। বিষয়টি প্রথম আলো পত্রিকা মনের মাধুরী দিয়ে কৃষক নারীর মর্মকথা তুলে ধরলো পত্রিকায়। আমি তখন ঢাকায়। পরের দিন খসরু ভাই ফোন করে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ মাজেদা কে? বৌদি আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেছে। আমার সুনামগঞ্জের মেয়ে জাতীয় সম্মেলনে বক্তা হিসেবে বক্তব্য রেখেছে। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে? নারীর অগ্রযাত্রায় যিনি উচ্ছ¡সিত হতেন সেই মানুষটি আমাদের খসরু ভাই।
উনার একমাত্র পুত্র দ্বীপের বিয়ে। খসরু ভাই ফোন করে বললেন, ‘‘আমি তো শ্বশুর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। আশির্বাদ করবেন, আসবেন।’’ পরে চিঠি পাঠালেন। চিঠি পড়ে আমি অবাক এবং অভিভ‚ত। আমি নারীর সম অধিকার আদায়ের একজন কর্মী হিসেবে যে কাজ করতে পারিনি, সেই কাজটি খসরু ভাই করে আমাদের দেখিয়ে দিলেন, স্্েরাতের বিপরীতে কিভাবে পথ চলতে হয়। বিয়ের কার্ডটিতে মুনমুন চৌধুরীর নাম আগে দিয়ে, নিচে নিজের নাম। নারীর অধিকার আর মর্যাদায় কতোখানি বিশ্বাসী হলে পুরুষ শাসিত সমাজে এই কাজ করা সম্ভব! সেদিনও ফোন করে অভিনন্দন জানালে তিনি উচ্ছ¡সিত হয়ে বললেন, ‘‘সুনামগঞ্জের নারী আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করলাম। প্রচলিত প্রথা ভেঙে শুরু করলাম। একদিন অনেকেই করবে এবং করা উচিত, আমার বিশ্বাস বৌদি। ’’নারী-পুরুষের সম অধিকারে শতভাগ বিশ্বাসী ছিলেন আমাদের খসরু ভাই।
উনার ভ্রমণ কাহিনী ‘জার্মানির স্মৃতিকথা’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগারে। খসরু ভাই আমাকে বাসায় এসে বললেন, আমি যেন বিকাল ৪টায় জগৎজ্যোতি পাঠাগারে যাই। আমি তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কোথাও যাই না। নিজেকে গুটিয়ে থাকছি। খসরু ভাই বিষয়টি খেয়াল করেছেন। তাই বারবার অনুরোধ, ‘‘বৌদি আপনি আসবেন। আমি খুশী হবো। ’’যাবো বলে আশ্বস্ত করে উনাকে বিদায় করেছি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে আর নিজেকে কোথাও যাবার মতো প্রস্তুত করতে পারছিলাম না। কিন্তু খসরু ভাই নাছোড়বান্দা। ফোন করে বললেন, ‘‘বৌদি আপনি আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।’’ সেদিন সত্যিই সকল কষ্ট ভুলে আমি ছুটে গিয়েছিলাম। ঠিক দো’তলার দরজার সামনে খসরু ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে খুশি হয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন কবিতার মতো কওে বললেন, ‘‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে…।’’ সাথে ভাবী (মুনমুন চৌধুরী) এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন বৌদি এই ক্ষতি তো আমাদের। আমরা সম্পদ হারিয়েছি। এভাবে নিভৃতে কতো কঠিন কাজ সহজে করেছেন তিনি। আমি মানসিকভাবে যে অবস্থায় গিয়ে ছিলাম খসরু ভাইয়ের এই ভ‚মিকা আমাকে স্বাভাবিক জীবন পেতে শক্তি যুগিয়েছে। মোড়ক উন্মোচন পর্ব শেষ করে বাসায় এসে বই খুলে আবারও অবাক হলাম। বই উৎসর্গ করেছেন মুনমুন চৌধুরীকে। লিখেছেন, ‘আগামী পৃথিবীর ঠিকানা যার কাছে রেখে যাবো।’ ফোন করে অভিনন্দন জানালাম। ধন্যবাদ জানালেন।
‘‘পিতা/স্বামীর সম্পদে সম অধিকার চাই’’ ¯েøাগান নিয়ে যখন আন্দোলন করছিলাম ঠিক তখনি তিনি বই উৎসর্গ করলেন। শুধু বই নয়, উনার পৃথিবী। অবচেতন মনে সেটা করলেন। সেটাই আজ সত্য হলো। তিনি আজ অনেক দূরে। কতো দূরে জানিনা। আকাশের নক্ষত্র রাজির মাঝে একাকার হয়ে আছেন।
২০২১ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারিতে তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের সংবাদ শহরের মানুষকে স্তব্ধ করে দিলো। কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই অবিশ্বাসের জায়গায় ছিলাম আমিও। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হলো।
স্মারকগ্রন্থে উনাকে নিয়ে কী লিখবো? বিদ্যা ও জ্ঞানের বহর কী আছে? উনাকে ঘিরে অসংখ্য স্মৃতি। অসংখ্য স্মৃতির মাঝে অমলীন মানুষটি প্রিয় খসরু ভাই।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ জেলা শাখা।