সুনামগঞ্জের সর্বজনমান্য বাউল শিল্পী মকরম আলী শাহ নিজ গ্রাম সদর উপজেলার বাহাদুরপুরের বাড়িতে গত শুক্রবার রাতে লোকান্তরিত হয়েছেন। পরিবারের দাবিমতে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ১০৮ বছর। অর্থাৎ শতবর্ষজীবী বিরল ব্যক্তিদের তিনি একজন। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি সঙ্গীতের সাধনা করেছেন এবং গানের বাণীর মধ্য দিয়ে লোকশিক্ষা থেকে শুরু করে মানব জীবনের জন্য উপকারী ভাবাদর্শ প্রচারে নিয়োজিত থেকেছেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি মূলত জ্ঞানের সাধনা করে গেছেন। সেইসাথে যাপন করেছেন পরিচ্ছন্ন এক জীবন। জীবনের সকল পর্যায়ে শৃঙ্খলা ও পরিমিতিবোধের কারণে তাঁর জীবৎকালের ব্যপ্তি দীর্ঘায়িত হয়েছিলো। সৃষ্টি ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তিনি যে শিক্ষা রেখে গেছেন তাঁর মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন এই জ্ঞানী সাধক। তাঁর স্মরণে দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পারিবারিক সূত্রেই মকরম শাহ পেয়েছিলেন গানের উত্তরাধিকার। পিতা সিফাত আলী শাহ ও চাচা আজম শাহও সঙ্গীতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধন জগতের মানুষ ছিলেন। এঁদের দ্বারাই সঙ্গীতে অনুপ্রাণিত হন তিনি। এরপর জীবনের বিভিন্ন পর্বে সান্নিধ্য লাভ করেন আরও বহু জ্ঞানী গুণী ওস্তাদ, শিল্পী ও সাধকের। বলা যেতে পারে হাওরাঞ্চলে আবহমানকাল ধরে যে সঙ্গীত সাধনার ইতিহাস বাউল মকরম শাহ সেই ধারারই একজন স্বাার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। রাধারমণ দত্ত, হাছনরাজা, শাহ্ আব্দুল করিম, দূর্বিন শাহদের সফল উত্তরপুরুষ ছিলেন এই প্রবীণ শিল্পী। বাউল বা লোকগানের ভিতর ফুটে উঠে অভেদ মানবনীতি যার মূলে মানবপ্রেম, ঈশ্বরচিন্তা ও মানবিক সদাচারণের কথা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বাউল বা লোকশিল্পীরা সবসময় ধর্মে ধর্মে, মানুষে মানুষে মিলন চেয়েছেন। যেকোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছিলো তাদের জন্য অপার বেদনার বিষয়। হিন্দু বৈষ্ণববাদ ও মুসলমান সুফিবাদের যে মূল ভাব অর্থাৎ আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে ¯্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপন; এবং এই মতবাদগুলো এই অঞ্চলের মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছে; সঙ্গীতের মাধ্যমে মকরম আলী শাহ সেই দর্শনেরই ছিলেন স্বার্থক প্রতিনিধি। আজকের বিভেদপীড়িত পৃথিবী যেখানে বৈষম্য, হিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা, বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি মানুষকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেখানে এই তত্ত্বেরই বহুল প্রসার কাম্য। বাউল শিল্পীরা কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করে বরং অনেক গঞ্জনা ও বিড়ম্বনা সহ্য করে সমাজে এই ভাবদর্শন প্রচার করে গেছেন।
আমরা একটি আধুনিক পৃথিবীতে বসবাস করলেও বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় অশান্তির আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তুঙ্গস্পর্শী উন্নয়ন ঘটলেও মানুষের আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের জায়গাটি আজও অধরা। দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের থাবা আজ গণমানুষকে নিতান্তই তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর করে তোলেছে। আমরা যে সমাজে বাস করি সেখানেও আজ নানা ধরনের বিভক্তি, বিভেদ, হিংসা ও স্বার্থপরতার উন্মত্ত উপস্থিতি। এখন নানা কারণে এক ব্যক্তি পাশের ব্যক্তিকে বিশ্বাস করতে পারে না। বিচ্ছিন্নতার দেয়াল উঠে যাচ্ছে নানা পরিচয়ে। এই দেয়াল ভাঙার কাজে আমাদের শিল্পীরা সবসময় নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন। বাউল মকরম আলী শাহও তেমন একজন। এই মহত্ত্বর পরিচয় বৈশিষ্টের কারণে তিনি মানুষের হৃদয়ে অম্লান আলোর শিখা হয়ে থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন নিজের সৃষ্টিতে, নিজের হাতে তৈরি করা অসংখ্য শিষ্য-শিল্পীর মাঝে সর্বোপরি যে মহান আদর্শের কথা তিনি প্রচার করতেন সেই আদর্শের অমিত তেজ শক্তির ভিতরে। মেঘ সূর্যকে সাময়িক আচ্ছাদিত করে রাখতে সক্ষম হয়, সূর্য একসময় আপন উদ্ভাস নিয়ে তাপ বিকিরণ করেই। মকরম আলী শাহরা সমাজ মানসের সূর্যরূপ। এই প্রখর ও অননুপক্ষেণীয় তেজকে কখনও অস্বীকার করা যাবে না। এই রূপেই মহান এই শিল্পী আমাদের স্মরণে বরণীয় হয়ে থাকবেন। আবারও তাঁর কর্ম ও জীবনের প্রতি আমাদের গভীর অনুরক্তি প্রকাশ করছি, সেইসাথে অন্তহীন অনুরাগ।
- টাঙ্গুয়ায় পর্যটন শিল্প বিকাশে মতবিনিময়/ জীববৈচিত্র রক্ষার তাগিদ
- ছাতক শহর অভ্যন্তরে সিএনজি ও ইজিবাইক চলাচল বন্ধে সিদ্ধান্ত