পাভেল পার্থ
মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহ বা গ্যালাক্সিতে প্রাণের আবিভার্ব ও সভ্যতা বিকশিত হয়েছে কীনা আমরা এখনো জানিনা। সৌরজগতের এক ছোট্ট নীলগ্রহে আমরা প্রাণের আবিভার্ব, রূপান্তর ও গণবিলুপ্তি দেখে চলেছি। অকোষী থেকে বহুকোষী, ঘাস থেকে ঘড়িয়াল কিংবা ম্যামথ থেকে মানুষ কত প্রাণপ্রজাতির আবিভার্ব আর বিলুপ্তি ঘটেছে এই গ্রহে। কিন্তু অযুত নিযুত প্রাণস্পন্দনের ভেতর প্রজাতি হিসেবে মানুষ কী করে সর্বময় ক্ষমতার কতৃর্ত্ব দখল করল তা এখনো বিস্ময়ের বিষয়। কেন বৃক্ষ বা সরীসৃপ কিংবা অণুজীব বা নীল তিমি এই জায়গা দখল করতে পারল না? কিংবা মানুষ হিসেবে মানুষের সকল প্রজাতিই কী এমন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেছিল? যদিও এই ক্ষমতা এই গ্রহকে ছিন্নভিন্ন আর রক্তাক্ত করে এর টিকে থাকাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করছে বারবার? কিন্তু হোমো ইরেকটাস, ডেনিসোভান, নিয়ানডাথার্ল, হোমো ফ্লোরিয়েনসিস এইসব মানবপ্রজাতি কেন পৃথিবীর কতৃর্ত্ব ছিনতাই করতে পারল না? মানবপ্রজাতির ভেতর কেন কেবলমাত্র ‘হোমো স্যাপিয়েন্সরাই’ এক নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী ক্ষমতা অর্জন করল? কীভাবে পারল? দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা লোকআখ্যান কিংবা বিদ্যায়তনিক বহু গবেষণায় এর নানা যুক্তি, প্রমাণ ও ব্যাখা আছে। এসব ব্যাখা ও নথিকে পাঠ করে ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ মানুষের ক্ষমতা অর্জনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বোঝা যায়। আর তা হলো ‘গল্প বানানো ও গল্প বলবার’ এক বিস্ময়কর দক্ষতা। হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষ এক গল্পকে হাজার রকম করে বলতে পারে, গল্পের শতকোটি মানে তৈরি করতে পারে কিংবা গল্পটিকে উধাও করে দিতে পারে। মেরুদন্ডী, সরীসৃপ, বৃক্ষ কী পতঙ্গের জীবনেও গল্প আছে, কিন্তু সেটি হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের মত নয়। এই গল্প বানাবার প্রধান খুঁটি হলো ভাষা, যা, প্রতিনিয়ত মানুষকে জীবন্ত রাখতে হয়েছে। আর তাই পৃথিবীতে একটামাত্র প্রজাতি হিসেবে মানুষের লাখো কোটি ভাষা জন্ম নিয়েছে, বিলুপ্ত হয়েছে, নয়া ভাষার রূপান্তর ঘটছে। বরফজমাট তুন্দ্রা, বষার্রণ্য আমাজন, বিস্তীর্ণ কালাহারি, উচ্চতম হিমালয় কিংবা বৃহত্তম বদ্বীপে মানুষের ভাষার এতো ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য কেন? মানুষের ভাষা মূলত গড়ে ওঠে ও বিকশিত হয় তার চারধারের প্রাণ ও প্রতিবেশ ঘিরে। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আগলে। ভূমি হলো ভাষা গড়ে ওঠবার পয়লা ময়দান। এক ভূমিতে জন্ম নেয়া কোনো ভাষা ভূমিহারা হয়ে আরেক কোনো অচিন ভূমিতে গিয়েও জন্মভূমির চিহ্ন ও প্রতীক গুলো মেলে ধরে। ভাষা সবসময় কোনো না কোনো ভূমির দিনলিপি প্রকাশ করে। ভূমি ও ভাষার এই জটিল সমীকরণই মানুষের দিনযাপনের গল্পকে জীবন্ত রাখে। কিন্তু এই গল্প কী নিজের মতো বিকশিত হতে পারছে? ভূমি ও ভাষার পাটাতন থেকে যদি আমরা এই প্রশ্ন হাজির করি তাহলে কী দেখবো? আজ দেশের নানাপ্রান্তে ভূমিও ক্ষতবিক্ষত এবং ভাষাও রক্তাক্ত। বহু ভাষা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে কিংবা বহু ভূমি উন্নয়ন বাহাদুরিতে নিহত হয়ে ভাষা—বিকাশে সহযোগী হতে পারেনি। ভূমির নানা রূপ ও ব্যাঞ্জনা থাকলেও যদি কেবল কৃষি ও জুম জমিনের প্রসঙ্গও টানি তাহলে কী দেখবো? রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর দেশে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। কৃষিজমি হ্রাসের এই নিদারুণ ধারা কেবলমাত্র খাদ্য উৎপাদন, অর্থনীতি কিংবা মানবিক উন্নয়নের সাথেই জড়িত নয়; বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে ভাষা মুমূর্ষু হওয়ার নানা ঘাতপ্রতিঘাত। নদী অববাহিকা, হাওর, বাওড়, বিল, বরেন্দ্র, চর, গড়, টিলা, পাহাড়, অরণ্য কী উপকূলের কৃষিজমি ও ভাষার পরিবর্তন এবং নিরন্তর রূপান্তর খেয়াল করলে বিষয়টি আন্দাজ করা যায়। চলতি আলাপখানি ভাষা ও ভূমির পরস্পরনির্ভরশীল সম্পর্ক এবং পরিবর্তনশীলতা নিয়ে। আমরা ভূমি ও ভাষার সুরক্ষা চাই, কিন্তু কখনোই আমরা এদের জটিল সম্পর্ককে স্বীকৃতি ও মযার্দা দিয়ে সামগ্রিকভাবে উভয়ের সুরক্ষাবলয় মজবুত করিনি। আমাদের তৎপরতাগুলো প্রায়শই খন্ডবিখন্ড, আমরা আলাদাভাবে কখনো ভাষার সুরক্ষা চাই আবার কখনো আলাদাভাবে ভূমি রক্ষা করতে চাই। ভূমির বদল ঘটলে ভাষা বদলে যায়, বদলে যাওয়া ভাষার সাথে আগের ভূমির সম্পর্কের ভিন্নতা তৈরি হয়। আর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে মানুষের গল্প বলবার আদি কারিগরিতে। আমরা কৃষিজমিনের রাজনৈতিক, প্রতিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা চাই। কারণ আমরা আমাদের সকল মাতৃভাষার সামগ্রিক সুরক্ষাবলয় মজবুত করতে চাই। ভূমি ও ভাষার ঐতিহাসিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ভাষাপ্রশ্নকে জোরালো করবার আহবান জানায় চলতি আলাপ।
বদলাচ্ছে ভূমি, বদলাচ্ছে ভাষা
বলা হয়, ভূমি হলো এক মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদ যা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, শিল্প, ভোগবিলাস, স্বাস্থ্য রক্ষার উপকরণ ইত্যাদি সব কিছুরই উৎস। কৃষিজমি কোনোভাবেই কেবলমাত্র খাদ্যশস্য উৎপাদনের জায়গা নয়। এটি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় বাস্তুসংস্থান এবং এখানে নানা প্রাণী ও উদ্ভিদের যৌথ বসবাসের ভেতর দিয়ে এক জটিল প্রতিবেশব্যবস্থা চালু থাকে। কৃষিজমি জীবন্ত, এর প্রাণ আছে। এটি নানা অণুজীব, পতঙ্গ, কেঁচো, কাঁকড়া, শামুক, সাপ, ছোট পাখি, গুল্ম ও বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের আবাস ও বিচরণস্থল কৃষিজমি। কৃষিজমি একইসাথে কোনো গ্রামীণ সমাজের বসতিস্থাপনের ইতিহাস এবং কৃষিসভ্যতার এক জীবন্ত দলিল। এটি সামাজিক সংহতি ও নানা বর্গ—শ্রেণির ঐক্যের প্রতীক। কৃষিজমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা প্রকাশ করে। এক এক অঞ্চলের কষিজমি এক এক ঋতু মওসুমে এক এক রঙ ও ব্যাঞ্জনা নিয়ে মূর্ত হয়। কখনোবা ধানের সবুজ প্রান্তর, কখনো হলুদ সরিষার ক্ষেত, কখনো জুমের মিশ্র ফসল আবার কখনোবা রসুনের জমি। আর কৃষিজমিনের এই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা জমিনের সাথে সম্পর্কিত মানুষের ভাষিক সীমানাকে প্রভাবিত করে। প্রস্তাবিত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ২০২১’ উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের যে স্থানে কৃষি জমি রহিয়াছে, তাহা এই আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা করিতে হইবে এবং কোনভাবেই তাহার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না। কিন্তু তাই কী ঘটছে? প্রতিদিন চোখের সামনে—পেছনে দিন—দুপুরে খুন হচ্ছে কৃষিজমি, নির্দয়ভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। কোনো ন্যায়বিচার নেই, কোনো সুরাহা নেই। অথচ কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তনের সাথে বদলাতে থাকে ভাষার পত্র—বিটপ—মূল। ভূমিপ্রশ্নকে আড়ালে রেখে আমরা মাতৃভাষা সুরক্ষার লোকদেখানো ফেনা তুলি ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকাশিত কৃষি ডাইরি (২০১১) থেকে দেখা যায় ১৯৭৬ সনে দেশে কৃষিজমি ছিল ৯.৩৯ মিলিয়ন হেক্টর। ১৯৮০—৮১ সনে ৯.৩৮, ১৯৮৫—৮৬ সনে ৯.৪৪, ১৯৯০—৯১ সনে ৯.৭২, ১৯৯৫—৯৬ সনে ৮.৭২, ২০০০—০১ সনে ৮.৪০, ২০০৫—০৬ সনে ৮.৪২ এবং ২০১০—১১ সনে ৮.৫২মিলিয়ন হেক্টর। আরেক গবেষণা জানায়, গত ৩৪ বছরে দেশে ০.৬৬ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি কমেছে। জলবায়ু, পানিসম্পদ, ভূমিরূপ, মাটি, উদ্ভিদবৈচিত্র্য, তৃণভূমি কী অরণ্য সবই ভূমির অংশ। আর এসব ঘিরেই গড়ে ওঠে ভাষার পরিসর ও সীমানা। কিন্তু কৃষিজমিনের ক্ষয়ে এই ভাষিক সীমানা বদলে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় কৃষি জমির ধরণগুলো এক নয়। মহামতি খনার বচনে আছে, রোদে ধান ছায়ায় পান। তার মানে কোনো কৃষি জমিনে রোদ পড়ে, আবার কোনোটি ছায়াময় জমিন। জমির ধরণ বুঝে এক এক জমিনে এক এক ফসল। এক এক ফসল বা চাষপদ্ধতি মানে ভাষার নানা উপাদান। শব্দভান্ড, রূপকল্প ও বাক্যব্যঞ্জনা। হাওরাঞ্চলে বসতবাড়ি বাগানকে বলে ‘বিছরা’, মধুপুর গড়াঞ্চলে নিচু জমিকে বলে ‘বাইদ’ এবং উঁচু জমিকে ‘চালা’, বরেন্দ্র অঞ্চলের ঢেউখেলানো জমিকে স্থানীয়ভাবে বলে ‘গ্যালারি জমি’, মানিকগঞ্জে উঁচু জমিকে বলে কান্দা জমি, সিলেটের খাসি আদিবাসীরা কৃষিজ বাগানকে বলেন ‘জুম’। দেশব্যাপি কৃষিজমির এই আঞ্চলিক ও বাস্তুতন্ত্রগত ভিন্নতা কমছে, পিটিয়ে ভেঙে চুরমার করে একচেহারা করা হচ্ছে সব জমি। বদলে যাচ্ছে জমিনের সাথে সম্পর্কিত ভাষা।
বাংলাদেশে ভাসমান জমি গোপালগঞ্জের বিলাঞ্চলে ‘গাউতা’ এবং পিরোজপুর—বরগুণা অঞ্চলে ‘ধাপ চাষ’ নামে পরিচিত। সিলেটের দুই টিলার মাঝের জমিকে আদিবাসী লালেং (পাত্র) ভাষায় বলে গুল। এই জমিগুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে খুব ভাল আঠালো বিন্নি ধান আবাদ হয়। পাহাড়ি এলাকার জুমজমিনগুলো কেবল চাষ বা উৎপাদন নয়, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বিকাশের সাথেও জড়িত। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে একটি পাহাড়ের নাম ে¤্রা ভাষায় শোংনাম (ভূতের পাহাড়)। এর নানাভাগে নানা ফসল ফলে। কিন্তু করপোরেট পর্যটন বাণিজ্য এই পাহাড়ের শ্রেণি পরিবর্তন করে না দিতে চায় ম্যারিয়ট হোটেল। কক্সবাজারের টেকনাফসহ সমুদ্র উপকূলে জোয়ার প্লাবিত কৃষিজমি এবং নারিকেল জিঞ্জিরা বা সেন্টমার্টিনসহ সমুদ্র দ্বীপসমূহের ভূমিবৈচিত্র্যের সাথে এখানকার জনগোষ্ঠীর ভাষা মিশে আছে। শংখ বা সাঙ্গুসহ পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি নদী তীরের ঢালু জমি, ঝালকাঠির বিশঘর কুরিয়ানাসহ বরগুণা, পিরোজপুরের পেয়ারা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতল অঞ্চলের তুলা চাষের জমি, ফুল চাষের জমি, চলনবিলের জলমগ্ন জমি, সিলেটের আদিবাসী খাসিদের পানজুম, টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারস ও মিশ্রফসল চাষের চালা জমি, রাঙামাটির সাজেকের লুসাই আদিবাসীদের চা ও কমলা বাগান, দিনাজপুরের লিচু বাগান, হাওরাঞ্চলের বিছরা ক্ষেত, পানবরজ, সাতক্ষীরা—খুলনার কনকনা পদ্ধতিতে মিষ্টিপানির আধার তৈরি করে চাষকৃত জমি, দেশজুড়ে টানি ও ছেমা জমিন, উত্তর—পূবার্ঞ্চলের মেঘালয় পাহাড় পাদদেশের সীমান্ত জমি, চরাঞ্চলের বালুময় ভূমির সাথে বিন্যস্ত ও বিস্তৃত হওয়া ভাষিক পরিসরগুলো আজ নানাভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত। ভাষা বদলে যাওয়ার শতসহ¯্র কারণের সাথে ভূমির বদল কিংবা ভূমির পরিবর্তনও এক অন্যতম কারণ, যা, আমরা ভাষাপ্রশ্নের মূল ময়দানে কখনোই হাজির করছি না।
ভূমি ও ভাষার সম্পর্ক
রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ কিংবা নওগাঁর গ্রামেগঞ্জে ঘুরলে দেয়াল কি দোকানে নানা ধরণের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। দুইশ বছর আগে হলে হয়তো এই বিজ্ঞাপনের ভাষা বোঝা সম্ভব ছিল না। এখনো বুঝতে বেহুঁশ হতে হয়। বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে ‘উঁচু নিচু ডাঙ্গা জমি ভেকু মেশিনে কেটে সমান করা হয়’। মানে হলো বরেন্দ্র অঞ্চলের ঢেউখেলানো স্তরে স্তরে সাজানো আদি জমি মেশিনে কেটে সমান করা হচ্ছে এবং মূলত বোরো মওসুমের উফশী ধান লাগানোর জন্য বানানো হচ্ছে বা বাণিজ্যিক ফসলের বাগান। ভূমির এই শ্রেণি পরিবর্তনে ভাষার ক্ষেত্রে কেমন বদল ঘটছে তা বোঝার জন্য আমাদের ঝিনাপাড়া যেতে হবে। রাজশাহীর তানোরের বাধাইড়ের এক খরাপীড়িত প্রাচীন গ্রাম। প্রতিদিন পাতাল কী আসমানের পানি হারাচ্ছে। মাটিতে নেই আর্দ্রতা, বদলাচ্ছে কৃষিজীবন। চুমার করে সমান হচ্ছে স্তরবিন্যস্ত জমি ও নিখোঁজ হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাভূমি খাঁড়ি। আমরা ‘বাতাল’ নামে একটি প্রাচীন শব্দ খুঁজে পেলাম। মাটির উপযুক্ত আর্দ্রতা বা জো বোঝাতে গ্রামের মানুষের ভাষায় আগে এই শব্দ ও ধারণাটি প্রচলিত ছিল। আরো একটি প্রাচীন শব্দ ও ধারণা পাওয়া গেল, ‘লেলপা’। খাঁড়ির গভীর অংশে আগে বাবলা, খয়ের, শেওড়া, জাওয়া ও ভালকা বাঁশ দিয়ে কাঠা তৈরি হতো শুষ্ক মওসুমে যেন মাছেরা এখানে থাকতে পারে। এখানেই কিছুদিন পর তৈরি হতো আঠালো থকথকে ‘লেলপা’, আর এটি নির্দেশ করে মাছ ও জলাভূমির সুস্বাস্থ্য। গ্রামের শিশু, কিশোর ও তরুণদের আলাপ করে তাদের শব্দভান্ডে ‘বাতাল’ ও ‘লেলপা’ পাওয়া গেল না। এমনকি এসব ধারণাও তাদের কাছে স্পষ্ট না। বরং তাদের গরিষ্ঠভাগের কাছে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন বা জলাভূমি নিখোঁজ হওয়ার কোনো যাতনা বা মানে নেই। টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে মান্দি গ্রামগুলোই এখানকার আদি জনবসতি। মূলত হাবাহুয়া (জুমআবাদ) করে এখানে মান্দিসভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। ১৯৫০ সনে রাষ্ট্র এই অঞ্চলে জুমচাষ নিষিদ্ধ করে। ভূমির শ্রেণি প্রতিদিন বদলাতে থাকে, বদলাতে থাকে শালবনের আবেং মান্দিদের আচিক ভাষা। রাষ্ট্র, বনবিভাগ ও বাঙালি উপনিবেশিকতায় শালবনের ভূমি দখলের প্রতিটি পযার্য়ে প্রবল প্রতাপে আচিক ভাষায় ঢুকতে থাকে বাংলা শব্দ ও ধারণা। হ.গিচাক, হা.গিসিম, হানচেং, হা.গুবক, হা.খিল ও হা.রংখেক মাটির এই আদি মান্দি শ্রেণিকরণ চলতি সময়ে মধুপুরের আচিক ভাষায় জীবন্ত নেই।
ভূমি, ভাষা ও ভিত্তি
বাংলাদেশে বাঙালির চাইতে আদিবাসী সমাজ কার্যত ভূমিহীন। আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে সবচে বেশি অন্যায়ের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ভূমি দখল ও অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে আছে ভাষার বিলুপ্তি ও ওপর থেকে চাপানো পারিবর্তন। কাপ্তাই জলবিদ্যুত উন্নয়ন প্রকল্প কেবল লাখো মানুষকে উদ্বাস্তু করেনি বা জন্মমাটি তলিয়ে দেয়নি, এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা—ভূগোলেও ঘটেছে পরিবর্তন। আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সনে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। সেইসব আদিবাসী জাতির মাতৃভাষাগুলো বেশি বিপন্ন যারা ভূমিগতভাবে বেশি প্রান্তিক এবং যাদের ভূমি সবচেয়ে বেশি জবরদখল হয়েছে। ভাষা সুরক্ষা প্রশ্নে অবশ্যই আমাদের ভূমির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও জরুরি। ভূমি ও ভাষার জনভিত্তিকে জোরালো ও তৎপর করতে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন স্পষ্ট করা জরুরি।
গবেষক ও লেখক। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com