ভ্রমণ- চলতে পথে যেটুক দেখা

রোকেস লেইস
(লোকাল ট্রেন তবে বেশ পরিচ্ছন্নই মনে হলো। ফেরিওয়ালা বা অন্য কোনো উপদ্রব চোখে না পরলেও, হিজরা সাহায্য উঠাচ্ছে দেখলাম। অল্পক্ষণ মধ্যেই ‘জলপাইগুড়ি রোড’ স্টেশনে পৌঁছে যাই। স্টেশন থেকে বেরিয়ে টট’ নিয়ে রওয়ানা হলাম, ভালো কোথাও নাস্তা সারবো বলে রাখায়, ড্রাইভার একটি চাইনিজ রেস্তেরায় নিয়ে গেলো নাস্তা করাতে, নাস্তা দিতে যথেষ্টই দেরী করে ফেলায় পর্ব সেরেই, সোজা রেল স্টেশনে চলে যাই, গিয়ে জানলাম সেই ট্রেনটি এক্ষুণি চলে আসবে, এ অবস্থায় টট’ ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। ট্রেন আসলো তেমন ভিড় না থাকলেও প্যাসেঞ্জার যারাই ছিলেন বেশ চটপট উঠলো নামলো। অল্প সময়েই ট্রেন চলা শুরু করতেই ভিন্ন এক আবেশ মন জুড়ে, শিকড়ের স্পর্শের। মা’য়ের জন্ম যে মাটিতে তার ছোঁয়া পেতে চলেছি। সমবয়সী খালাতো ভাই, যার সাথে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পর দেখা হতে যাচ্ছে, ওর সাথে বাংলাদেশে দেখা হয়েছিলো, তাকে ছাড়া আর কাউকেই চিনি না, মোবাইলে কথা বলে জানিয়ে দিলাম ট্রেন ছেড়েছে। শিলিগুড়ি পৌঁছানোর পরদিনই পাসপোর্ট এর ফটোকপি জমা দিয়ে সিম কিনি। জানিয়ে ছিলো চারদিন পর এক্টিভেট হবে, সে অপেক্ষায় আছি। এদিকে আসার সময় অভিজ্ঞতার আলোকে বন্ধু রুমী ‘কাজে লাগবে নিয়ে যাও’ বলে সিমসহ মোবাইল ধরিয়ে দেয়, শুধু কাজেই লাগে নাই এই ক’দিন তো সর্ব যোগাযোগ রক্ষা হয় ঐ মোবাইলে, সাথে না নিলে খুবই অসুবিধায় পড়তে হতো। জানা যায় ইন্ডিয়া ভ্রমণে অনেককে, এই মোবাইল সার্ভিস দিয়ে আসছে। রোমিং থাকলেও বাংলাদেশে কথা হচ্ছিল না, নেট ব্যবহার করতে পারছিলাম না। যদিও বা বাংলাদেশে লাইন পাচ্ছিলাম, হ্যালো বলতেই শেষ, এতে সত্যিকার অর্থেই যোগাযোগহীন হয়ে পরি। ট্রেন অনেকগুলো স্টেশন ধরলো, আর মা’কে দেখাবো বলে সবগুলোরই ছবি নেয়ার চেষ্টা করলাম,অবশেষে সেই কাঙ্খিত ষ্টেশন কুচবিহার জেলার হলদিবাড়ি। কুচবিহার রাজ্যের এই হলদিবাড়ি’র গল্প ছোটবেলা থেকে এতো বেশী শুনেছি। নামতেই স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ কত যেনো আপন, মা’য়ের শৈশবের শহর । স্টেশনের বাইরে এসে টট’ ডাকলাম, এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ভিতরে ভিতরে, পানির ট্যাঙ্কি যাবো বলে উঠতে যাবো, পাল্টা প্রশ্নে দমে গেলাম, কোন্ পানির ট্যাঙ্কি। আবারো খালাতো ভাই আলম’কে ফোন করলাম,জানা গেলো পূর্বপাড়া, উঠে বসলাম। চলতে চলতে শহরটার এ’দিক ও’দিক দেখছি, আসলে দেখছি না যেনো খুঁজছি মা’য়ের ছেলেবেলা, গল্পে শোনা কিছু যদি দেখতে পাই। হঠাৎ চোখে পরলো মহাত্মা গান্ধীর বেশ বড় স্ট্যাচু, ড্রাইভার অনেকটাই এগিয়ে গেছে পিছাতে বললাম, ছবি নেবো। নেমে, বাবা মেয়ে মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছি, ড্রাইভার বললো আপনাদের ডাকছে। অবাক হলাম, এখানে কে ডাকতে পারে এই ভেবে। তাকাতেই দেখি একজন হাত ইশারা করছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ‘আলম’ এতোদিন পর দেখলেও চিনতে অসুবিধা হলো না, সুঠাম দেহটা তেমনি আছে। দাড়ি, ভুরি’র পরিবর্তন নেই তবে চেহারায় বয়সের ছাপ। কাছে আসতেই বুকে জড়িয়ে কুশলাদি বিনিময়। টট’ ছেড়ে ঘরে ঢুকে ওর বউ, একমাত্র মেয়ে,জামাই এদের সাথে পরিচয় হলো। প্রথমেই জানিয়ে দিলাম যে কোনো উপায়ে পৌনে পাঁচটার ফিরতি ট্রেন ধরতে হবে। আর,তার আগে হলদিবাড়ি এম.ই ঘুরে আসতে হবে। ইতিমধ্যে তার দু’ছেলের সাথেও আলাপ হলো। আলম নিজেই টট’ ডাকতে গেলো সময়ের ব্যাপারটা আঁচ করে। ওর বউ, মেয়ে ব্যস্ত খাওয়া তৈরি নিয়ে, বললাম ফেরার পথে হবে, সরবত খেয়ে বেরিয়ে পরলাম। উত্তেজনা না-কি চাঞ্চল্য, না অধিরতা-আকুলতা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এক ধরনের ব্যাকুলতা নিয়ে উদগ্রীব হয়ে দেখছি চারিধার। হ্যাঁ, সুন্দর পিচ ঢালা পথ ধরে সামনে চলেছি, রাস্তার দু’পাশে ফসলের ক্ষেত সবুজ ঝিরঝির হাওয়া সবই চির চেনা ‘একই আকাশ একই বাতাস…..’। yhngকিন্তু, কাঁটাতারের ওপারে বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, আর এপারে মা’য়ের জন্মভূমি ক্যামন যেনো অস্বাভাবিক, অগ্রহণীয়। ভিতর থেকে, বছর চল্লিশ এরও আগে পড়া কবিতার ক’টি লাইন আকস্মিক অনুরণিত হতে থাকলো, তারপর মন থেকে মুখে ১৯৪৭ সনে লেখা অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা “তেলের শিশি ভাঙ্গল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো/ তার বেলা?…. ” অনুভূতিটা প্রকাশ করা দূরহ , দুঃসাধ্য। ফটো তুলছি আলম বাধা দিলো, দেখালো বিএসএফ ডিউটি করছে একশ গজ দূর দূর। বললো, দেখতে পেলে মোবাইল নিয়ে নেবে। মাত্র ক’দিন আগেই ছিটমহল বেরুবাড়ি’তে কান্নার রুল উঠেছিল,তারই পাশ দিয়ে যাচ্ছি। এপারের অনেকেই শত বছরের ভিটেমাটি রেখে ওপারে গেছেন, আর ওপারের অনেকে জন্মের চেনা মাটি, আকাশ ছেড়ে এপারে চলে এসেছেন। আমি যাচ্ছি এমনি এক ইতিহাসের অন্ধকারের পরশ পেতে। হেমকুমারীতে পৌঁছে গেছি। শান্ত সবুজতায় স্নিগ্ধ মনোরম চারিধার, প্রায় জনমানব শূন্য ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। আমি যেনো দেখতে পাচ্ছি গ্রামের মেঠো পথ ধরে ফ্রক পরা দু’পাশে দু’টো বেনী দুলিয়ে বালিকারা ছুটে বেড়াচ্ছে, এদের মাঝেই আমার মা’য়ের বালিকা বেলা। টট’ থেকে নামছি মোবাইল বেজে উঠলো, যে’টা এই ক’দিন ধরে শুধুই ফটো তোলার কাজে ব্যবহার হচ্ছিলো। গ্রামীণ নাম্বার, পরিচিত; আমার খামার থেকে ফোন করেছে। ও’কে রাখতে বলে আমার ছেলেকে ফোন করলাম। বললাম, দাদি মা’কে দাও, তাৎক্ষণিক পেয়ে গেলাম আম্মাকে। এক পা দু’পা করে আমি যে বাড়িতে ঢুকছি আট দশক আগে এই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন আমার মা। আর কাকতালীয় যেনো এই মোবাইল সংযোগ, আম্মা’র আওয়াজ পেয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি, মা’ আমি তোমার জন্ম ভিটায় এইমাত্র ঢুকলাম। আম্মা বলে দিলো এ’টা দেখিস ও’টা দেখিস। আম্মা, আব্বা সর্বশেষ ১৯৯৯’তে গিয়েছিলেন। আলম ঐ বাড়ির লোকজনকে আমার পরিচয় দিচ্ছে, ঐ সময়ে আম্মার সাথে কথা শেষ করে বড় মামা’কে ট্রাই করছি, কিন্তু সংযোগ আর হলো না, নেট নেই। আম্মার সাথে কথা বলার জন্যই যেনো ঐশ্বরিক সেংশন/মন্জুরি পেয়েছিলাম। বাড়ির লোকেরা অত্যন্ত আন্তরিক, ঘরে বসে অনেক কথাই হলো। ক্ষিতিন্দ্র দেব সিংহ যার সাথে আমার নানা’র, বাড়ি বিনিময় হয়েছিলো, উনার উত্তরসূরী এ’রা। খবর পেয়ে দু’এক জন আসলেন। আলাপ হলো, পুরনো দিনের, আত্মীয়তার, বন্ধনের, বিচ্ছেদের। হেমকুমারী মা’য়ের দাদা’র, দাদা’র উদ্যোগে গড়ে উঠা প্রায় দুশত বৎসরের পুরাতন গ্রাম,ছায়ামায়া । ক্ষিতিশ দেব সিংহ, রমনী মোহন দেব সিংহ, হামিদুল মাষ্টার, আবুল কাশেম সরকার সকলেই অতি সাধারণ, ধুতি, লুঙ্গী, খালি গা’। কারো কাঁধে আবার গামছা ঝুলানো, গ্রামের সহজ সারল্যে নির্ভার মুখচ্ছবি, গ্রামের সবুজতায় নম্র নিষ্কলুষ, এঁরা সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। আর, শিক্ষাই যেনো এঁদের আরো বেশী দিয়েছে গ্রাম্যগরিমা। তারো চেয়ে বড় এঁরা সকলেই মানবিক মমত্বে যূথবদ্ধ,পরস্পর আবদ্ধ, ঋদ্ধ । অল্প কথায়, ভাগবাটোয়ারা বলতে এঁরা নিজেদের যা আছে, সবটুকু পরস্পর মিলেমিশে দিয়ে থুয়ে খাওয়া পড়াকেই বুঝালো, এঁদের ধর্ম বিশ্বাস নিজস্ব পরিমন্ডলে আচার পালনে নিবিষ্ট। পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতিতে মানব ধর্ম চর্চায় এঁরা স্বতঃস্ফূর্ত, অভ্যস্ত । সময় স্বল্প, তবু  হামিদুল মাষ্টারের বাড়িতে যেতেই হলো। কারণ আত্মীয়তা, তদুপরি মামাদের কারো কারো শৈশবসঙ্গী অতএব না বলার উপায় ছিলো না। আলম, হলদিবাড়িতে থাকলেও এখানে এই প্রথম আসলো, মাত্র পনের কিলোমিটার দূরে হেমকুমারীর এ বাড়িতে। সময়ের দিকে লক্ষ্য রেখেই আবারো আসবো কথা দিয়ে উঠতে হলো। বাড়ির সামনে জুম্মাঘর আর পাঠশালা দু’টোই এখন পাকা দালান, এগুলোর প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো মা’য়ের দাদা’রও দাদা আমেতুল্যা’র দুরদর্শীতায়, শিক্ষামনষ্কতায়, নামফলক সেটুকু ধারণ করে আছে । ১৮৬৭ সনে প্রতিষ্ঠা হয় আমেতুল্যা পাঠশালা,যা বর্তমানে গভর্নমেন্ট প্রাইমারী। ফিরতি পথে, যেনো কতো চেনা, কতকালের পরিচিত, কতো আপন ছেড়ে আসার করুণ অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখলো সারা পথ। আলমে’র বাসায় ফিরে আন্তরিক পরিবেশে খাওয়া পর্ব শেষ করেই, বেরিয়ে পরলাম হলদিবাড়ি’তে নানা’র বাসা, যা মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করে এসেছিলেন সে’টা দেখতে, বাইরে থেকেই দেখতে হলো। কারণ, হাত বদল হতে হতে সেখানে এখন অনেকগুলো পরিবার বসবাস করে, আর এদের কাছে আমার আবেগের কোনো গুরুত্ব নেই, আর অতীতও মূল্যহীন। তাই, ভিতরে ঢুকার চেষ্টা না করে সোজা চলে যাই স্বল্প দূরে মা’য়ের বান্ধবীর বাড়িতে। ঐ বাড়িতে ঢুকে পরিচয় দিতে না দিতেই এক অভূত দৃশ্য। আমার মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন মা’য়ের কাছে বহুবার গল্পে শোনা সুধা বুজান, মা’য়ের শৈশবের খেলার সাথী। কথায় কথায় জানা হলো আমার বা মেয়ের সাথে উনার কখনোই দেখা না হলেও, মেয়ের সাথে উনার অনেকবার কথা হয়েছে মুঠোফোনে, সে সুবাদে ওরা পূর্ব পরিচিত, পরিচয়ের মাত্রা কতোটা গভীর তা জড়িয়ে ধরে থাকা দেখলেই বোঝা যায়,এ যেনো জনম জনমের পরিচয়, বন্ধন । তাড়া আছে বলতেই স্নেহভরা মাতৃত্বের কড়া বকুনি শুনতে হলো’তবে আসলি কেনো’। থালা ভরা মিষ্টি আর নিজ হাতে বানানো পায়েস খাইয়ে, আবারো যাবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, অবশেষে ছাড়লেন। এবার আম্মার আপন ফুফুতো ভাই, আলমের আপন মামা শহীদুল মামার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম,পশ্চিমপাড়া পানির টেঙ্কী’র হদিসও জানা হলো, যার পাশেই মামার বাসা। উনারা আপন তিন ভাইয়ের মধ্যে উনিই ছোট, সৎ দু’ভাই সহ পিতৃ ভিটায় থেকে যান। বড় দু’ভাই ও এক বোন চলে আসেন এ’পারে, সেইই দেশ ভাগের আগে। বড় ভাই ডঃ শামছুল হক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রফেসর ছিলেন, ছিলেন বিভাগীয় প্রধান এবং ময়মনসিংহেই শেষ জীবন কাটান, অপর ভাই এড্ সিরাজুল হক ঢাকা জজ কোর্ট এবং হাইকোর্ট-এ প্র্যাকটিস করতেন, দু’জনই পরপারে চলে গেছেন। মামা বাসায় ছিলেন না, আছরের নামাজ পড়তে পাশের মসজিদে ছিলেন ; ওখানেই দেখা সেরে নেই। ইচ্ছে ছিলো মা’ যে স্কুল থেকে, এডুকেশন এন্ড পাবলিক হেলথ মিনিষ্টার কুচবিহার ষ্টেট এর অধীনে অনুষ্ঠিত ‘মিডিল ইংলিশ পাশ সার্টিফিকেট’ ১৯৪৮-৪৯- এ ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, সেই হলদিবাড়ি গার্লস এম,ই স্কুলটি দেখে আসবো, সময়ের কারণে দেখা হলো না । সাথে থাকা টট’তে স্টেশনে পৌঁছে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট নিলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেনও চলে আসায় আলমের নিকট থেকেও বিদায় নিতে হলো। সন্ধ্যার পরপর এনজিপি’তে নেমে এবার অটো চড়ে মার্কেটে চলে আসলাম। অটো হচ্ছে বেবী টেক্সি এর বড় সংস্করণ, যা শহরের মূল সড়ক সমূহে পাবলিক পরিবহণ করে, ভাড়াও যথেষ্টই কম। এক সাথে দশ জনকে বসতে হয়, ব্যবস্থাটা মোটেই শুভকর নয়। মার্কেটে নেমে, আবারো রতনের টট’ চড়েই শিবরাম পল্লীতে ফিরলাম। (চলবে)