ভ্রমণ-চলতে পথে যেটুক দেখা

রোকেস লেইস
দেশের লোক বিদেশে কতোটা আপন হয়ে উঠে। সে সংক্রান্তে সিলেট অঞ্চলের ঐ গানটি যথার্থ ‘ও আমার সিলটি ভাইসাব……’ ঠিক তেমনি এক অবস্থায় আমিও। শিলিগুড়ি ঢুকার পরদিন ওর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে, তার বিশেষ আকুতি কাকা আমাকে না দেখে যাবেন না। সে সুনামগঞ্জের ছেলে, দীর্ঘ দিন হয় মা ভাই সহ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, ক’দিন থাকলেও দেখা হলো না। তো, তাকে মুঠোফোনে জানালাম আগামী কাল সকালে চলে যাচ্ছি। শুনেই সে ক্যামন ব্যস্ত হয়ে উঠলো, তখন রাত দশটার উপরে সে আমার অবস্থান জেনে নিলো, বুঝতে পারলাম সে আসবে, তাই বাসার সামনে রাস্তায় হাঁটছি। কাছাকাছি এসে ফোন করলো। ভেসপা’টা দেখতে পাচ্ছি, লাইট পোষ্টের কাছে দাঁড়ালাম। সামনে এসে ভেসপা থেকে নেমেই ওরা দু’ভাই ভক্তি করলো, তপনকে চিনতে পারলাম সেও আমাকে চিনতে পেরেছে। ওদের বাবাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছিলো, বাবা বছর সাতেক চিকিৎসাধীন থেকে মারা গেলেন, ওদেরও আর ফেরা হয়নি। ওরা বাড়িঘর কিনে এখানেই স্থায়ী হয়। বাসায় নিতে পারলাম না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা হলো। ওর বাবা ছিলেন সুনামগঞ্জ এর খুবই পরিচিত একজন, ভালো ফুটবলার ছিলেন সে জন্য, তার চেয়েও বেশী উনার পেশার জন্য। ষাটের দশকে এখনকার মতো রেডিমেড সার্ট, পাঞ্জাবির আধিক্য ছিলো না, প্রায় সকলকেই তা তৈরি করে নিয়েই পরতে হতো, আর হাতে গোনা ক’জন টেইলারের একজন ছিলেন প্রিয়নাথ বাবু। আমি এদের আরেকটু বেশীই জানি, তপনের দাদা প্রভাত বাবু , ষাটের দশকে আমাদের বাসার কাঠের যাবতীয় কাজ উনিই করতেন। আব্বা’কে দেখতাম উনাকে খুবই শ্রদ্ধা করতে, আব্বা’র কাছে জেনেছিলাম আমার দাদা’র সময় থেকেই প্রভাত বাবুরা পারিবারিক ভাবে সম্পর্কিত। তপনতো পারলে, এখনি আমাকে ওর বাসায় ধরে নিয়ে যায়, আমাকে ওদের বাসায় নিতে না পারার মন খারাপ নিয়ে ছলছল চোখে দু’ভাই বিদায় নিলো। আসলে যে ক’দিন ছিলাম ঘুরাঘুরিতে থাকায় তপনকে সময় দিতে পারি নাই, মুঠোফোনে যদিও কথা হয়েছে সেও কাজ ফেলে আসতে পারে নাই। যাক, দেখা না হলে ছেলেটার জন্য কষ্টের হতো, আর আমিও পেতাম না বিদেশে দেশী কাউকে পাওয়ার অপার্থিব অনুভূতি। ভোর হতেই বিদায়ের প্রস্তুতি চলছিলো, আমাদের নয় ; সবিতা’র। সব দায় দায়িত্ব ব্যস্ততা সবই ওর, নাস্তা তৈরী করলো খাওয়ালো। আবার, রাস্তায় খিদা লাগবে খেতে হবে, সে মতো বাটি ভরে ভরে নিজ দায়িত্বে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো। এতোটাই আন্তরিকতা আর দাবী নিয়ে করছিলো যে, মোটেই না-বলার উপায় ছিলো না। এতো কিছুর পরও তার সে-কি আপসোস, দাদা এমন সময় আসলেন কিছুই করতে পারলাম না। রতন যথাসময়ে টট’ নিয়ে প্রস্তুত। বরাবরের মতো মানিক ষ্টেশন পর্যন্ত এসে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো, এই ক’দিন কিছুই করতে না পারার আক্ষেপ আর আপশোস নিয়েই বিদায় দিলো। গরীবরথ’ এক্সপ্রেস নাম শুনেই মেয়ে ক্ষেপে ছিলো, বাস্তবে দেখা গেলো নামটা গরীব হলেও সেন্ট্রাল এ,সি ছাড়াও সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা রয়েছে এবং গতি সীমাও ১০০ কিলো মিটারের উপরে, শুধু ভাড়াটাই যথেষ্ট কম। আসলে, গরীবরাও যাতে স্বল্প ব্যয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগে চলাচল করতে পারে, সেই বিবেচনায় গরীবরথ’। যথা সময়ে, ঠিক আটটায়ই ট্রেন ছাড়লো। কোলকাতা থেকে আসা এল,আই, সি গ্রুপের উনিশ জন শিলং যাচ্ছেন, বেশীর ভাগই মহিলা, এরা এক সাথে কাজ করেন আর বছরের কোনো এক সময়, এক সাথে দল বেঁধে ঘুরতে বেরিয়ে পরেন। রাতের ঘুম সেরে কেউ কেউ এবার উঠে বসছেন, মেয়ের সাথে কথা হলো দল নেতার স্ত্রী’র। বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছি শুনে গভীর আগ্রহ নিয়েই এ’টা ও’টা জানতে চাইছেন। একটু পর পাশের কোপ থেকে দলনেতা এসে স্ত্রী’র কাছে আমাদের পরিচয় পান। উনি এসে সরাসরি জানতে চাইলেন বাংলাদেশে যাওয়া যাবে কি-না? জানতে চাইলাম কেনো নয়! কথা হলে, বোঝা গেলো বাংলাদেশ সম্পর্কে রং মেসেজ (ভুল বার্তা) পাচ্ছেন উনারা। খোলামেলা আলোচনায় বাংলাদেশ নিয়ে ওদের আগ্রহ লক্ষ্য করলাম, দলে ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের লোকজন এদের কারো বা পিতৃভূমি কারো বা মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং সকলেই অকপটে নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন মন পরে আছে বাংলাদেশে। কেউ কেউ এক দু’বার ঘুরেও গিয়েছেন। ট্রেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে, বৃষ্টি রোদের আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে। একটা, দু’টো ষ্টেশনে থামলো স্বল্প ক্ষণের জন্য। খাওয়ার সময় হলে, সবিতা’র দেওয়া আয়োজনে তৃপ্তি মত খাওয়া সারলাম। 13820311_866259683479787_21কামরূপ জেলায় ঢুকে পরেছি অল্প সময় মধ্যেই ব্রহ্মপুত্র নদ পার হবো। ১৯৫৮ সনে কাজ শুরু হয়ে ১৯৬২ সনে যান চলাচল শুরু হয়, সরাইঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের উপর নির্মিত প্রথম সেতুতে। সেতুটির বিশেষত্ব এ’টি দ্বিতল যা’তে একই সময়ে ট্রেন, বাস চলতে পারে। সেতুটি নির্মাণে ব্যবহৃত সকল মালামাল, নির্মাণ শ্রমিক ও প্রকৌশলী ভারতীয় ছিলেন বলে জানা যায় অর্থাৎ শতভাগ দেশীয়। বছর তিনেক আগে কামরূপ-কামাখ্যা মন্দির ও পোয়ামক্কা মসজিদ দেখতে যাওয়ার সময় এই সেতুর উপর অংশ দিয়ে জীপে গিয়েছি, ফেরার সময় আমরা যখন উপর অংশে পার হচ্ছি তখন নীচ দিয়ে ট্রেনও গোয়াহাটি আসছিলো, ব্যপারটা বেশ উপভোগ করেছিলাম। আর, আজ নীচ দিয়ে পার হয়ে যাবো। মানিক বলে দিয়েছিলো কামারূপ জংশনে কোনো কারণে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেলে ঘন্টা দু’ঘন্টা বিলম্ব হতে পারে। সেক্ষেত্রে নেমে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শও ছিলো তার, সাথে আরেকটা পরামর্শও ছিলো সহজে কাউকে বিশ্বাস করবেন না। প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা একশতে একশ। অত্যন্ত ব্যস্ত জংশন, ক্ষণে ক্ষণে ট্রেন আসছে যাচ্ছে। আমরা যখন বুঝতে পারলাম ততক্ষণে যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে গেছে, তাই আর রিস্ক না নিয়ে বসেই থাকলাম। যাহোক, এক ঘন্টা পর গৌহাটি বা গোয়াহাটি ষ্টেশনে নামলাম, গোয়া>সুপারি, হাটি>হাট অর্থাৎ সুপারি বাজার। নির্ভরতার মানুষ কাছের মানুষ, যাকে ক’দিন আগেই হোটেলের ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছিলাম, তিনি জরুরী প্রয়োজনে শিলং থাকায় ঝামেলা হয়ে যায়। জানাই ছিলো গোয়াহাটিতে হোটেল পাওয়া বিদেশীদের জন্য বেশ কষ্টকর। সে জন্যই শিলং-এও যোগাযোগ রেখেছিলাম, অগত্যা সমস্যা হলে সরাসরি শিলং চলে যাবো। এমনিতেই এক ঘণ্টা বিলম্ব অর্থাৎ চারটা পেরিয়ে গেছে। হোটেলে সিট পাওয়ার বিষয়টি আরো জটিল হয়ে গেলো পরদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি জি গোয়াহাটি আসছেন। তাই, শহরে নিরাপত্তা ও বহিরাগতদের আধিক্য। শিলং যাওয়ার গাড়ি খুঁজতে গেলাম এখানেও সমস্যায় পড়তে হলো। প্রায় তিন শতাধিক স্থানীয় জীপ ও কার রিকুইজিশন হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি যথেষ্টই জটিল। যাও দু’একটা গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে বহুগুন বেশী ভাড়া হাঁকছে, গাড়ির কন্ডিশনও খুব সুবিধার নয়। বেশ চিন্তায়ই পড়ে গেলাম, সন্ধ্যা হয় হয় আকাশের অবস্থাও খুব ভালো না, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এমনি সময়ে টেক্সি স্ট্যান্ড এর ছেলেটি ডেকে একটি কার দেখিয়ে দিলো শিলং যাবে, কাছে গিয়ে কথা বললাম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দু’শ রুপী বেশী, কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম। সাথে সাথেই আরো দু’জন যাত্রী উঠতেই ছেড়ে দিলো। রাস্তাটি পরিচিত বছর তিনেক হয় ঘুরে গিয়েছি, তবে ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পরলো। মসৃণতো বটেই চার লেনও হয়ে গেছে, একশত তিন কিলোমিটার। অল্প সময় মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হলো, খুব জুড়ালো নয়। পাশে বসা ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতেই জানা গেলো সিলট’ উনাদের আদি নিবাস, দাদা মশাই এখানে এসেছিলেন, পুলিশ বাজারে ব্যবসা আছে। শিলং রওয়ানা হয়েছি যার ভরসায়, সে ব্যস্ত হয়ে একটু পরপর মুঠোফোনে খবর নিচ্ছে আর সোজা তার বাসায় যেতে বলছে। ঐ বাসা শিলং-এ একটুকরো সুনামগঞ্জ, একটুকরো বাংলাদেশ। আর, বাসার যিনি গিন্নিমা সে সুনামগঞ্জের মেয়ে, সারাবেলা হাসি খুশী। শত ব্যস্ততার মাঝে নিজে হাসছে আর সামনে যারা আছে সকলকে হাসিতে মাতিয়ে রাখছে। সে তার বাবার এই গুণটা হুবহু ধরে রেখেছে, অমিয় চক্রবর্তীর মেয়ে পম্পা। তো সাহস করে তাকে বললাম, আপাততঃ কোথাও উঠি, সকালে তোর বাসায় আসছিরে মা। এবার, সত্যি সত্যি ক্ষেপে গিয়ে ‘ওরে মুখ-পোড়া ওরেরে বাঁদর / গালি ভরা মা’র অমনি আদর……..’ কথা না বাড়িয়ে বললাম আসছি। এরই মধ্যে টেক্সি স্টেন্ড-এ পৌছে গেছি, ড্রাইভার সেখানেই নামিয়ে দিলো। অনেক অনুরোধ করলেও ড্রাইভার ‘এক কথার লোক’ কোনভাবেই আর যেতে রাজি হলো না। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে, স্থানীয় টেক্সি পেয়ে গেলাম লাবাং যেতে হবে; বাসার কাছে থেমে পথচারী মহিলাকে জিজ্ঞাসা করছি, ওমনি মেয়ে এসে হাজির, ‘মামা আইচ্ছ নিবা’। এবার বিস্ময়ের পালা শুরু, পম্পা আর আমার মেয়ে একজন আরেক জনের গলাগলি দেখে, এরা এতো পরিচিত হয় কিভাবে? জানাগেলো পম্পা’ যখনই সুনামগঞ্জ এসেছে আমাদের বাসায় জম্পেস আড্ডা হয়েছে, সকল পিচ্চি আর আম্মার সাথে। আর আম্মাতো তার সকল সময়ে সকল প্রিয়দের অন্যতম। ঐ আড্ডা কাহিনী আমার জানা ছিলো না। সে সূত্রতো আছেই, তা ছাড়াও ওর মেয়ে আর আমার মেয়ে একই বিষয়ে একই ইয়ারে পড়ার কারণে নিয়মিত মুঠোফোনে যোগাযোগ আছে। আমার জন্য সহজ হলো পরিচয় করিয়ে দিতে হলো না। ঘরে ঢুকতেই রান্না চলছে গল্প চলছে, আর একটু পর পর জামাই বাবাজিকে ফোন করছে চলে আসার জন্য। ইতিপূর্বে যখন গিয়েছি জামাই বাবাজির সাথে দেখা হয় নাই। যাহোক, অল্পক্ষণ মধ্যেই সুঠাম, দীর্ঘদেহী আপাতঃ গম্ভীর জামাই বাবাজি এসে উপস্থিত, পরিচয় হলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা চলছে খেতে বসেও কথা হলো, এভাবে রাত মাত্র দু’টো অবধি বিরামহীন। প্রথম আলাপেই দেহের মতোই বিশাল মনের একজন প্রাণ খোলা সহজ মানুষকে জানা হলো। আর যেনো, কতো চেনা কতো জানা হয়ে গেলাম, হয়ে গেলাম অতি কাছের মামু’। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার এজিএম এর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাংসারিক ও সামাজিক দায়িত্ব সচেতন মানুষ ‘কিশোর’। শিল্প সংস্কৃতি বোদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষক। পরদিন অফিস থাকায় পম্পার তাগিদে গল্পে ভঙ্গ দিতে হলো। ভোরে হাঁটতে যাওয়া কিশোরের নিত্য অভ্যাস। স্কুল থেকে জাতীয় পর্যায়, প্রায় সর্বস্তরেই ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলাতে সর্বোচ্চ স্থান অর্জনের ঈর্ষণীয় গৌরবগাঁথা রয়েছে এই ক্রিড়াবিদের। রাতের তৃপ্তির ঘুম সেরে পম্পা’র রসালো গল্প আর গরম গরম চা নাস্তা দিয়ে দিন শুরু হলো। একনাগাড়ে গোটা দশেক ভাষায় সে অনর্গল বলতে তো পারেই, সাথে মুখভঙ্গি অঙ্গভঙ্গির ক্যারিসমায় চরিত্র চিত্রণে এমন আবহ ফুটিয়ে তোলে যাতে অতি গুরুগম্ভীর লোকেরও না হেসে উপায় থাকে না। ছোট ছোট চেনা জানা বিষয়গুলো পম্পার বর্ণনায় উপস্থাপনায় এতোটাই শৈল্পিক আর কৌতুকময় হয়ে উঠে যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরতে বাধ্য।