রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বছর পার/ বিশ্বকণ্ঠ উচ্চকিত হোক অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১ বছর পূর্ণ হয়েছে গত শুক্রবার। গত বছরের ওই দিনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিলেন শক্তিধর রাশিয়া স্বল্প ক্ষমতার ইউক্রেনকে সহজেই পরাজিত করে ফেলবে। তাই অল্প দিনেই যুদ্ধ শেষ হবে। রাশিয়ারও এমনই পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু আজ যুদ্ধের এক বছর অতিক্রমের পরও বলার কোনো উপায় নেই কখন থামবে এই মহাবিপর্যয়কর যুদ্ধ উন্মাদনা। মূলত এই যুদ্ধ আর রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বৈশ্বিক প্রভাব বলয়ের মাতব্বরদের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে এটি। স্পষ্টত রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের নামে এখন যুদ্ধ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। সমর্থন, অস্ত্র, সমরকৌশল, অর্থ ও অন্যান্য যাবতীয় সহায়তা ইউক্রেন পাচ্ছে ওই জোটভুক্ত দেশগুলো থেকে। তাই যুদ্ধ থামানোর কোনো উপায় এখন আর ইউক্রেনের হাতে নেই। এই আধিপত্যবাদী যুদ্ধের খেসারত দিচ্ছে পুরো বিশ্ব নানাভাবে। রাশিয়া যে মাঝপথে থামবে না তা বেশ বুঝা যায় প্রেসিডেন্ট পুতিনের বক্তব্য থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে বিশ্ব আধিপত্য থেকে রাশিয়ার বিদায়ের পর মার্কিন নেতৃত্বে যে একমুখী প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছিলো রাশিয়া সেটি ভাঙতে বদ্ধপরিকর। হয় ধ্বংস নয় জয়, এই মন্ত্রকে সার বিবেচনা করে রাশিয়া এর শেষ দেখতে চাচ্ছে। উভয় মাতব্বরের সরাসরি প্রভাবপুষ্ঠ গুটিকয় দেশ ছাড়া বাকি বিশ্ব মনেপ্রাণে চাইছে বন্ধ হোক এই যুদ্ধ। আলোচনার মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনার কার্যকর কৌশল খোঁজার তাগিদ দিচ্ছে সকল দেশ। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বেশ বুঝা যাচ্ছেÑ এই শান্তির বাণী তাদের কাছে নিতান্তই পরিহাস বিবেচিত হচ্ছে।
এই যুদ্ধের ফলে কার কী লাভ হলো? আসুন দেখি পরিসংখ্যান। এই যুদ্ধে সামরিক বেসামরিক মিলিয়ে ২ লাখ ২১ হাজার লোকের প্রাণ গেছে উভয় দেশের। শরণার্থী হয়েছেন ৮০ লাখ ইউক্রেনিয়ান। এই যুদ্ধ চালাতে গিয়ে রাশিয়া প্রতিদিন খরচ করছে ১০০ কোটি ডলার। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর ৩৫ কোটি মানুষ পড়েছে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। বিশ্ব অর্থনতিক প্রবৃদ্ধি গত তিন দশকের মধ্যে তৃতীয় সর্বনি¤œ অবস্থানে চলে গেছে। দেশে দেশে তৈরি হয়েছে মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্যঘাটতি, উৎপাদন ও বিপণন সংকট। এককথায় পুরো বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে দিয়েছে এই যুদ্ধ। অথচ আমেরিকা ও রাশিয়া সবকিছু উপেক্ষা করে এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এ থেকে বুঝা যায় সা¤্রাজ্যবাদ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, বাজার দখল ও মুনাফা আহরণ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। মূলত চলমান এই যুদ্ধের মধ্যে কোনো আদর্শবাদিতা নেই। তাই বিশ্ববাসী এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
এই দুই দেশের চাইতে বহুদূরে অবস্থান করা সত্বেও বাংলাদেশ এর অভিঘাতের বাইরে নয়। আমাদের উৎপাদন, অর্থনীতি, রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সবকিছুকে তছনছ করে দিচ্ছে এই যুদ্ধ। উভয় মাতব্বর নিজ পক্ষভুক্ত করতে বাংলাদেশের উপর তৈরি করেছে নানামুখী চাপ। এই চাপ মোকাবিলা করেই নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে কৌশলী ভূমিকায় থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিরপেক্ষ। তবে এই অবস্থান বজায় রাখতে যে অনেক বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্ববাসীর মতো আমরাও চাই অবসান হোক এই যুদ্ধের। পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসুক। বন্ধ হোক আধিপত্য বিস্তারের অন্যায় সহিংসতা। পৃথিবীটা মানুষের। মানুষই আদিম পৃথিবীকে একটু একটু করে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাই মানুষকে আজও সমান দায়িত্ব নিতে হবে শান্তির পক্ষে আর যুদ্ধের বিপক্ষে। বিশ্বকণ্ঠ যত উচ্চকিত হবে তত বাড়বে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সর্বনাশা কা-।