মোহাম্মদ সাদিক
পৃথিবীতে যে চারটি মৌলিক মহাকাব্যের পরিচয় পাই তার মধ্যে ‘মহাভারত’ অন্যতম। সংস্কৃতে রচিত এই মহাকাব্য পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অনেকে এসব অনুবাদকে অনুবাদ না বলে রূপান্তর হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। দীর্ঘ এ মহাকাব্যের বিভিন্ন পর্বের অসাধারণ সমন্বয় সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়নি। কখনও কখনও বিশেষ বিশেষ পর্ব Ñ অবলম্বনে মহাভারত অনুদিত অথবা রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলায় যাঁরা মহাভারত রচনার প্রয়াস পেয়েছেন, তাঁদের একটি দীর্ঘ তালিকা ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে অবলোকন করা যায়-
‘বাংলা দেশের অনেক কবি মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন। তার মধ্যে যে সমস্ত কবিদের এবং তাঁদের কাব্য সম্পর্কে জানা যায় তাঁদের নাম নি¤েœ দেওয়া হলো-
১. মহাভারতের প্রথম অনুবাদ করেন সঞ্জয়
২. কবীন্দ্র পরমেশ্বর
৩. শ্রীকর নন্দীর অশ্বমেধ পর্ব
৪. বিজয় পণ্ডিতের মহাভারত
৫. সারলা দাসের বিরাট পর্ব
৬. দৈবকী নন্দনের কর্ণ পর্ব
৭. দ্বিজ অভিরামের অশ্বমেধ পর্ব
৮. রঘুনাথের অশ্বমেধ পর্ব
৯. রামচন্দ্র খাঁর অশ্বমেধ পর্ব
১০. দ্বিজ হরিদাসের অশ্বমেধ পর্ব
১১. ঘনশ্যাম দাসের অশ্বমেধ পর্ব
১২. নিত্যানন্দ দাসের মহাভারত
১৩. কাশীদাসের মহাভারত
১৪. চন্দন দাসের অশ্বমেধ পর্ব
১৫. বিশারদের মহাভারত
১৬. দ্বৈপায়ন দাসের আশ্চর্য্য পর্বাদি
১৭. নন্দরাম দাসের দ্রোণ পর্বাদি
১৮. দ্বিজ শ্রীনাথের মহাভারত
১৯. কৃষ্ণানন্দ বসুর শাস্তি পর্ব
২০. দ্বিজ কৃষ্ণরামের অশ্বমেধ পর্ব
২১. অনন্ত মিশ্রের অশ্বমেধ পর্ব
২২. দ্বিজ গোবর্দ্ধনের গদা পর্ব
২৩. রামলোচনের নারী পর্ব
২৪. রাজারাম দত্তের দ-ী পর্ব
২৫. মহীন্দ্রের দণ্ডী পর্ব
২৬. উপাকান্তের দণ্ডী পর্ব
২৭. রাজীব সেনের উদ্যোগ পর্ব
২৮. কুমুদ দত্তের স্বর্গারোহণ পর্ব
২৯. জয়ন্তী দেবের স্বর্গারোহণ পর্ব
৩০. বিদ্যাবাগীশ ব্রহ্মচারীর গীতার অনুবাদ
৩১. ভারত সাবিত্রী
৩২. রাজেন্দ্রদাসের শকুন্তলা উপাখ্যান
৩৩. গঙ্গাদাস সেনের মহাভারত
৩৪. ষষ্ঠীবরের স্বর্গারোহণ পর্ব
৩৫. কবিচন্দ্রের মহাভারত
৩৬. ভবানী দাসের রামরত্ন গীতা’
কিন্তু এক কথায় মহাভারতের প্রথম বাংলা অনুবাদ বা রূপান্তর মহাকবি সঞ্জয় কর্তৃক সম্পন্ন হয়েছে, একথা বলার পূর্বে অন্যান্য মতামত যাচাই করে দেখা যায়। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলা পিডিয়া’-
‘ভারতের প্রায় সকল প্রাদেশিক ভাষায় মহাভারতের অনুবাদ হয়েছে। বাংলা ভাষায়ও হয়েছে, তবে বাংলা মহাভারত রচয়িতার নিজস্ব জীবনবোধ ও সমাজচেতনা এবং রচনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্যের কারণে তা মৌলিক কাব্যের মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলা মহাভারতের রচয়িতা একাধিক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি নিজের মতো করে মহাভারত রচনা করেছেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিত কবীন্দ্র মহাভারত বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মহাভারত। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খানের নির্দেশে তাঁর সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে সংক্ষিপ্তাকারে এই অষ্টাদশপর্ব মহাভারত রচনা করেন। এজন্য এর আরেক নাম হয় পরাগলী মহাভারত। অন্য একটি মতে সঞ্জয় রচিত মহাভারত প্রথম বাংলা মহাভারত।’
এই ‘অন্য একটি মতে’-র সঙ্গে অন্যান্য মতামতগুলো যাচাই করে দেখা যেতে পারে। অধিকন্তু মহাকবি সঞ্জয় লাউড় নিবাসী ছিলেন এরকম তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার লাউড় অথবা লাউড়ের গড় এক প্রাচীন জনপদ। এই জনপদ বিবিধ কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। প্রাচীন বৃহত্তর সিলেটে যে তিনটি রাজ্যের সংবাদ পাওয়া যায় তার মধ্যে জৈন্তিয়া, গৌড় এবং লাউড় Ñ নামে তিনটি রাজ্যের কথা জানা যায়। বর্তমান বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ যাচাই করলে এই তিনটি রাজ্যের অবস্থান একই সমতলে নির্ণীত হয়। এ তিনটি রাজ্যের বিভিন্ন রাজার নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বর্ণিত হলেও লাউড়ের রাজা ভগদত্ত, গৌড়ের রাজা গৌড় গোবিন্দ এবং জৈন্তিয়ার রাণী প্রমিলার নাম ব্যাপকভাবে প্রচারিত। উপরন্তু রাজা ভগদত্ত ও জৈন্তার রাণী প্রমিলার নাম মহাভারতে উল্লেখিত হওয়ায় এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। এ বিবেচনায় মহাভারত, মহাকবি সঞ্জয় এবং লাউড় আমাদের আগ্রহের বিষয়। লাউড় এখন আপাত একটি সাধারণ মানের স্থান মনে হয় বলে অনেকে মত দিয়েছেন-
‘আজকের লাউড় দেখে অনুমান করার কোন উপায় নেই যে এটি এককালে একটি বিশাল রাজ্যের রাজধানী ও অনেক ইতিহাস সৃষ্টিকারী নগরী ছিল। আজকের লাউড় এক নিস্তব্ধ ও ছিন্নভিন্ন এক ম্রিয়মান এলাকা যা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। লাউড় রাজাদের বংশ বলে যারা দাবী করেন তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ আজো লাউড় এলাকায় রয়েছেন। তাছাড়া জগন্নাথপুরে এ বংশের উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করেন এমন পরিবারও আছেন।’
কিন্তু লাউড় সম্পর্কে বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রী পদ্মনাথ ভট্টাচার্য ১৯৩৭ সালে The Journal of the Assam Research Society তে এক নিবন্ধে বলেন-
`The whilom kingdom of Laur lay in the north-western part of the district of Sylhet and was almost co-extensive with the present Sunamgonj, Subdivision. We have no accurate history of this kingdom, but from the biography of Adwaita Probhu – an associate of Sri Caitanya – we learn that there was a King named Divya Sinha who reigned in Laur when adwaita was a boy and lived with his father the minister, of Divya Sinha. Adwaita’s birth date was 1356 Sak-1434 A.D. So we may safely premise that Divya Sinha flourished during the first half of the 15th century. We know further that a biographer of Adwaita, named Isana Nagara, finished his work-Adwaita Prakar at Navagram, the capital of Laur in Sak 1490-1568 A.D. The descendants of Isana also lived in Laur until the kingdom with its capital was destroyed by incessant raids of the khasis-the denizens of the hills north of Laur.’
লাউড়ের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন এ রকম একজন গবেষক তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেন-
`The palace or the `Haweli’ undoubtedly holds immense possibilities and prospects for Bangladesh and the author of this paper firmly believes that it can unfurl some new or unexplored areas of research and expertise with the underlying facts and information found about the ancient civilization of Bangladesh. It can add new dimension in the thesaurus of ancient conservable civilization like `Mahasthan Gar’ or Lalmai-Maynamati’ or even `Mohenjo daro and Harappa’ civilization. Moreover, this can be turned into an ideal research lab for the archeologists, researchers, conservationists, environmentalists and think tanks of the country who perpetually hover for innovation, exploration and creation. The `Haweli’ can also decipher a new and unknown chapter about the culture and heritage of our race paving ways and means for the anthropologists to go ahead with newer findings.’’
এখন মহাকবি সঞ্জয়, তাঁর মহাভারত এবং তাঁর জন্মস্থান নিয়ে বিদ্বানদের মতামত পর্যালোচনা করা যায়। ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রী সুকুমার সেন ‘তথা কথিত সঞ্জয়’ বলে একজন কবির উল্লেখ করেছেন-
‘সপ্তদশ শতাব্দের রচনা বলিয়া আমরা এখন তিনটি রচনাগুচ্ছকে ধরিতে পারি। দুইটি পশ্চিমবঙ্গেরÑকাশীরাম প্রমুখের ও নিত্যানন্দ ঘোষের, একটি পূর্ববঙ্গের তথাকথিত ‘সঞ্জয়’ এর। প্রথম ও শেষ রচনাগুচ্ছ দুইটিকে ‘ভারত-পাঞ্চালী সংহিতা’ বলাই সঙ্গত।’
সুকুমার সেনের নি¤œবর্ণিত উক্তিটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ-
‘দুইটি পশ্চিমবঙ্গের কাশীরাম প্রমুখের ও নিত্যানন্দ ঘোষের একটি পূর্ববঙ্গের তথাকথিত ‘সঞ্জয়’ এর।’
পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের এই বিভাজন দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকেও বিভাজিত করেছে কী-না জানি না। কিন্তু এই ‘তথাকথিত’ শব্দটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।
মহাভারত রচনার আদি কবি হিসেবে কবীন্দ্র পরমেশ্বরের নাম উল্লেখ করা হয়। কাশীরাম দাসের মহাভারতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কবীন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারত’ বাংলায় রূপান্তর করেছেন বলে জানা যায় ঃ
‘বাংলার সুলতান হুসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম জয় করেন এবং সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তাঁর সভাকবি ছিলেন পরমেশ্বর। কবীন্দ্র বোধ হয় তাঁর উপাধি। পরাগল খাঁ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং হিন্দুদের গ্রন্থাদির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। একদা তিনি তাঁর সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে ডেকে এমনভাবে মহাভারত লিখতে বললেন, যাতে তিনি একদিনের মধ্যে সমগ্র মহাভারতটি শুনতে সমর্থ হন। তাঁর নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর খুব সংক্ষেপে মহাভারতের অনুবাদ করেন। তাঁর গ্রন্থ মূলের অতি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, কিন্তু প্রধান ঘটনা প্রায় কিছুই বাদ পড়ে নি। তত্ত্বকথা মুসলমান লস্করের মনোরঞ্জন করতে পারবে না আশঙ্কা করে পরমেশ্বর শুধু কাহিনীটি অনুসরণ করেছেন, কিন্তু মূল্যবান তত্ত্বকথা বেমালুম বাদ দিয়ে গেছেন। পুঁথিপত্র বিচার করলে পরমেশ্বরকেই মহাভারতের প্রথম অনুবাদক বলা যেতে পারে।’
‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে শ্রী অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় মহাকবি সঞ্জয় কে অন্তত ‘তথাকথিত’ হিসেবে চিহ্নিত করেননি। তিনি তাঁকে একজন পৃথক কবি বলে গণ্য করেছেন-
‘সঞ্জয় বলে আর একজন কবির মহাভারত পাওয়া গেছে। কেউ কেউ মনে করেন সঞ্জয় বলে কোন আলাদা কবি ছিলেন না। পরমেশ্বরের কাব্যই সঞ্জয়ের মহাভারত বলে পুঁথির লিপিকারগণ গুলিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য সঞ্জয়ের মহাভারতের সঙ্গে পরমেশ্বরের রচনার বহু সাদৃশ্য আছে, যার ফলে তাঁকে পৃথক কবি বলে গ্রহণ করতে কারও কারও আপত্তি হবার কথা। উপরন্তু সঞ্জয় নামীয় কোন কবি যদি সত্যই মহাভারত অনুবাদ করে থাকেন তবে তিনি নিজের ভণিতা সম্বন্ধে এত দ্বিধা রাখলেন কেন বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর ভণিতাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি অনেক সময় পৌরাণিক মহাভারতের সঞ্জয়ের নামের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছেন। যাই হোক তাঁর মহাভারতের পুঁথিপত্র দেখে আমাদের বিশ্বাস হয়েছে যে, এই নামে ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে কোন লেখক বর্তমান ছিলেন।’
মহাকবি সঞ্জয় ও তার মহাভারত নিয়ে ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ বলেন-
‘সঞ্জয়ই প্রথম সংস্কৃত থেকে মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন।’
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। এ বিষয়ে তাঁর মতামত নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য-
‘কবীন্দ্র-রচিত মহাভারত হইতে আর একখানি প্রাচীন মহাভারত পাওয়া গিয়াছে, তাহা সঞ্জয়-রচিত। ইহার ঐতিহাসিক কোন তত্ত্ব পাওয়া গেল না ; কিন্তু এই পুস্তক নানা কারণে সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন বলিয়া বোধ হইতেছে। কবীন্দ্র-রচিত প্রাচীন পুঁথি যেখানেই পাওয়া যাইতেছে, তৎসঙ্গে মূল-পুঁথির হস্তলিপি অপেক্ষা প্রাচীন হস্তাক্ষরযুক্ত দুই চারিখানা সঞ্জয়-ভারতের পৃষ্ঠাও সংলগ্ন দেখা গিয়াছে, সুতরাং সঞ্জয়ের মহাভারতের পর কবীন্দ্রের অনুবাদ প্রচলিত হইয়াছিল, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।’
‘কবীন্দ্র-রচিত ভারতের প্রচার অপেক্ষা সঞ্জয়ের ভারতের প্রচার অনেক বেশী ; সঞ্জয়-রচিত মহাভারত বিক্রমপুর, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, রাজশাহী প্রভৃতি সর্ব্বস্থলেই পাওয়া যাইতেছে, সুতরাং এই গ্রন্থের প্রচার একরূপ সমস্ত পূর্ব্ববঙ্গময় বলা যাইতে পারে।’
এ বিষয়ে ডক্টর মুনীন্দ্রকুমার ঘোষ তার ‘কবি সঞ্জয় বিরচিত মহাভারত’ গ্রন্থে প্রথমবার বিস্তারিত আলোচনা করেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় শ্রী বিজন বিহারী ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ-
‘বর্তমান গ্রন্থের সম্পাদক অসংখ্য পুঁথি হইতে অজস্র ভণিতা উদ্ধার করিয়া তাঁহার প্রতিপাদ্য প্রতিপাদন করিয়াছেন। তাহা সংক্ষেপে এইরূপ-
১. ‘সঞ্জয়’ নামে বাংলা মহাভারত রচয়িতা একজন প্রাচীন কবি ছিলেন।
২. ‘সঞ্জয়’ নামটি কবিনাম। পিতৃদত্ত নামও হইতে পারে।
৩. ‘সঞ্জয়’ ভরদ্বাজগোত্রীয় ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।
৪. ‘সঞ্জয়’ বাংলা মহাভারতের আদিকবি।
সঞ্জয়ের জন্মস্থান সম্পর্কে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নাই কিন্তু সম্পাদকের অনুমান ‘লাউড়’ কবির জন্মভূমি।’
ডক্টর ঘোষ গভীর অভিনিবেশ নিয়ে মহাকবি সঞ্জয়ের মহাভারতের বিভিন্ন পুঁথির পাঠ থেকে তা সম্পাদনা করেছেন এবং এ গ্রন্থের ভূমিকাংশে মহাকবি সঞ্জয় Ñ তাঁর সমসাময়িক কবি এবং তাঁদের কাজের মূল্যায়ন করেছেন একনিষ্ঠ গভীরতায়। শুধু পারিপার্শি¦ক বিচারে নয় ভাষা তাত্ত্বিক বিচার এবং মহাভারতের রূপান্তর বা অনুবাদের বিভিন্ন কাঠামো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেমহাকবি সঞ্জয়, তাঁর কর্মকাল এবং বিভিন্ন পুঁথির পর্যালোচনায় এ বিষয়ে উপসংহারে আসার প্রয়াস পেয়েছেন।
ভণিতার সূত্র ধরে, মুনীন্দ্র ঘোষ কবির মৌলিকত্ব যাচাই করা প্রয়াস পেয়েছেন ঃ
‘ভারতের পুন্য কথা সঞ্জএ কহিল পুথা
ব্যাসদেব করিল রচন’
এছাড়া,
‘ব্যাসের কবিত্ত পুথা সঞ্জএ কহিল কথা
বনপর্ব্বে উত্তম কথন ।।
অথবা,
‘মহাভারতের Ñ এই বন পর্ব্ব পুথা।
সঞ্জয়ে পয়ার কৈল ব্যাসের কবিতা।’
এবং,
‘সৈত্যবতি সুত জান মহামুনি ব্যাস।
স্লোকবন্ধে ভারথ জে করিল প্রকাস।।
সেইসব কথা তবে প্রবন্ধে পয়ার।
সঞ্জএ কহিল তারে লোক তরিবার।।’
এসব উদ্ধৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপসংহার রচিত হলো ঃ
‘ভণিতা বিচারে বলা যায় –
[ক] কবি সঞ্জয় ‘পুরাণস্লোক’ (সংস্কৃত) মহাভারত সুগম পয়ারে (বাঙলা ভাষায়) অনুবাদ করেন যাহাতে ‘সর্ব্বলোকে’ বুঝিতে পারেন।
[খ] কবি সঞ্জয় ব্যাসদেবের কবিত্বের উল্লেখ করিয়া বলেন যে তাঁহার ‘স্লোকবন্ধ’ হইতে তিনি ‘পদবন্ধে’ রচনা করেন। পূর্বে অপর কোন কবি নিশ্চয়ই বাঙলা ভাষায় এই কার্য করেন নাই, কেননা ‘লোকের সুগম’ করিবার কথা তিনি বার বার উল্লেখ করেন।
[গ] তিনি ‘পুস্তক অনুসারে’ অর্থাৎ সংস্কৃত মহাভারত অনুসরণ করিয়া তাহা সর্বলোকের সহজবোধ্য করিবার জন্য রচনা করেন ‘পাচালিক্রমে’।
[ঘ] তাঁহার মহাভারতকে তিনি ‘ভারত পয়ার’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
[ঙ] তাঁহার কাব্যের তিনি ‘কোমল’, ‘মধুর’, ‘মধুর সুবাস’ প্রভৃতি বিশেষণ প্রয়োগ করিয়াছেন সম্ভবত- ইহা বাঙলা ভাষায় রচিত বলিয়া, সুতরাং মনে হয় ইহার পূর্বে ‘কঠোর’ সংস্কৃত-আশ্রয় ব্যতীত মহাভারত ছিল না।’
এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, যখন আমরা পাঠ করি
‘সঞ্জয় বাঙলা মহাভারতের প্রথম কবি, তবে তাঁহার আবির্ভাবকাল নিরূপণ করিবার কোন উপায় নাই। এই পর্যন্ত বলা যায় যে কবীন্দ্র পরমেশ্বরের পূর্ববর্তী কবি হিসাবে তাঁহার কাল হুসেন শাহের রাজত্বকালের (১৪৯৪ খ্রীঃ- ১৫২০ খ্রীঃ) পূর্ববর্তী হইবে। কেননা পরাগল খান হুসেন শাহের চট্টগ্রামস্থ সেনাপতি ছিলেন এবং তাঁহারই নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারত রচনা করেন। এই প্রমাণে বিচার করিলে বলা যায়, সঞ্জয়ের কাল পঞ্চাদশ শতাব্দীর প্রথামার্ধের পরে হইতে পারে না। সম্ভবতঃ কয়েকজন সুধীব্যক্তি এই জন্যেই সঞ্জয়কে কৃক্তিবাসের সমসাময়িক বলিয়া অনুমান করিয়াছেন।’
মহাকবি সঞ্জয়ের মহাভারতে Ñ প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তকে ‘লাউড় ঈশ্বর’ বলে সম্বোধন করেছেন। লাউড়ের প্রতি সঞ্জয়ের শুধু পক্ষপাত ছিল তা নয়, লাউড়ের রাজা ভগদত্তের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অর্জুনের হাতে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পাই। এরই ধারাবাহিকতায় Ñ রাজা ভগদত্তের পুত্র বজ্রদত্ত কর্তৃক অর্জুনের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া প্রতিহত করার বর্ণনা পাওয়া যায় ঃ
‘অঙ্গবীর পড়িল সকলে দিল ভঙ্গ।
ত্বরিত গমন সব ভীমের আতঙ্ক।।
তাহা দেখি ভগদত্ত লাউড়ইস্বর।
চড়ি সুপ্রস্তিক হস্তী ধাইল সত্বর।।’
এছাড়াও
‘তার পাছে ভগদত্ত বিক্রমে বিসাল।
ধনু ধরি বৃদ্ধ রাজা মারি বাহুতাল।।
কাটর সমান ধনু তোলে নৃপবর।
তার উর্দ্ধে না পারিল লাউড় ইস্বর।।
পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে ভগদত্তের পুত্র বজ্রদত্ত অর্জুনের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া প্রতিহত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন ঃ
‘ভগদত্ত রাজ্যে গিআ অশ্ব প্রবেশিল।
বজ্রদত্ত নামে বীর সে অশ্ব ধরিল।।
সে যে মহা বলবন্ত ভগদত্তসুত।
অর্জ্জুন সহিতে যুদ্ধ করিল অদ্ভূত।।’
এখানে ‘ভগদত্ত রাজ্য’ বলতে কবি প্রাগজ্যোতিষপুরের লাউড়কে বুঝিয়েছেন বলে মনে করি। কারণ ভগদত্ত মানে ‘লাউড়-ইশ্বর’। মুনীন্দ্র কুমার ঘোষের মতে ঃ
‘কবি সঞ্জয়ের নিকট মহাভারতীয় চরিত্র, ভগদত্ত, প্রাগজ্যোতিষপুরের অধিপতি এবং সেই সঙ্গে লাউড়ের অধিপতি। এই লাউড় মহাভারতোক্ত কোন স্থান নয়। ইহা শ্রীহট্ট জেলাস্থ সুনামগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত একটি প্রসিদ্ধ স্থানমাত্র। অচ্যুতরচণ তত্ত্বনিধি মহাশয়ের, শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে, পাওয়া যায় যে, শ্রীহট্ট প্রাচীন কালে প্রাগজ্যোতিষপুরের অধীন ছিল। কবি সঞ্জয় সেই জন্যেই ভগদত্তকে প্রাগজ্যোতিষপুরের অধিপতি তথা শ্রীহট্টের তথা লাউড়ের অধিপতি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। সুতরাং কবির এই উক্তি ভৌগোলিক কিংবা ঐতিহাসিক অসঙ্গতি নয়। এইরূপ একটি অপৌরাণিক সামান্য জনপদের প্রতি কবির পক্ষপাতিত্ব নিশ্চয়ই জনপদটির প্রতি তাঁহার মমত্ববোধের পরিচায়ক। কবি লাউড়ের সঙ্গে মহাভারতীয় চরিত্র ভগদত্তের সম্পর্ক স্থাপন করিয়া তথা মহাভারতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করিয়া লাউড়কে গৌরবান্বিত করিয়াছেন। এইজন্যে মনে হয় সম্ভবতঃলাউড় কবির জন্মভূমি।’
এবং উপসংহারে এই মহাজনের মত-
‘লাউড়ের ভরদ্বাজ গোত্রীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণবংশ একটি সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত-বংশ। এই বংশ অলঙ্কৃত করিয়াছেন অদ্বৈতাচার্য, কুবেরাচার্য, নরসিংহ নাড়িয়াল প্রভৃতি প-িতবর্গ। সংস্কৃত ভাষা হইতে বাঙলা ভাষায় মহাভারতের আদি-অনুবাদকের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে যে বুৎপত্তি’ প্রয়োজন তাহা সঞ্জয়ের বংশগত ঐতিহ্যে ছিল। সঞ্জয় লাউড়ের এই ভরদ্বাজগোত্রীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন।’
লাউড়, সুনামগঞ্জ, সিলেট, প্রাগজ্যোতিষপুর Ñ এসব স্থানগুলো সঞ্জয়ের মহাভারতে একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। ডক্টর প্রদীপ ভট্টাচার্য বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন-
‘A resident of Laur in the Sunamganj subdiviision of Shrihatta district in East Bengal, he belonged to the Bharadvaja gotra. An interesting point is that he praises Bhagadatta as the ruler of Laur and also calls him ruler of Bengal, though the Mahabharata does not do so, because Srihatta was at one time part of Pragjyotispura.
প্রাগজ্যোতিষপুরের এই লাউড় বর্তমান বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার এক সমৃদ্ধ জনপদ। তাই আমাদের বিশ্বাস, বাংলায় মহাভারতের আদি অনুবাদক সুনামগঞ্জ জেলার লাউড়ের সন্তান মহাকবি সঞ্জয়ের মাধ্যমে এতদঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস আলোকিত হয়ে আছে।
ত থ্য প ঞ্জি
ড. কাজী দীন মুহম্মদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃ. ২৮৩-২৮৪
বাংলাপিডিয়া, খ- ৮, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, চৈত্র ১৪০৯/মার্চ ২০০৩, পৃ. ৫৯
আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন, সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, জালালাবাদ এসোসিয়েশন, ১৯৯৫, পৃ. ১৮
[1]Pandit Padmanath Bhattacharya Vidyavinod, RUINS IN LAUR, The Journal of the Assam Research Society,
Vol. IV. January 1937,No-4
[1]Md. Mokhtar Ahmed, In Pursuit of A New Horizon in Tourism : Revisiting The Archive of An Ancient But Rich Civilization at Tahirpur (“Hawelli”), Sunamganj, Lok Proshason Samoeeky, No:56, September 2012, P. 77
শ্রী সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ইষ্টার্ণ পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৬৩, পৃ. ১০৫-১০৬
শ্রী অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, মডার্ণ হক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ, পৃ ঃ ৫৯
পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০
ড. কাজী দীন মুহম্মদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃ ঃ ২৮৪
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য / গৌড়ীয় যুগ, পৃ. ১৫৪
পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৪
ডক্টর মুনীন্দ্রকুমার ঘোষ, কবি সঞ্জয় বিরচিত মহাভারত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৯, ভূমিকা পৃ. ঝ
পূর্বোক্ত, ভূমিকা পৃ. ৬৬
পূর্বোক্ত, ভূমিকা পৃ. ২৫
পূর্বোক্ত, ভূমিকা পৃ. ১৫৩
পূর্বোক্ত, ভূমিকা পৃ. ১২৮
পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৯
[1]7. Then his wise son, Bhagadatta by name, whose shoulder was girt with the mantle of far-reaching glory, and who by the multitude of his good qualities won the affections of the (whole) world, carried upon himself the burden (of the government) of the country with propriety and much prosperity.
8. Then the mighty Vajradatta, having like Vajrin (i.e., Indra) conquered his encmies, being in beauty like a large diamond, and enjoying the reputation of having achieved the conquest of the world through his own honesty and energy, obtained that kingdom of his brother, just as fire (attains) brilliancy on the setting on the sun. Sir Edward Gait, A HISTORY OF ASSAM, Surjeet Publications, Eight Indian Reprint 2015, Appendix P. 423
ডক্টর মুনীন্দ্রকুমার ঘোষ, কবি সঞ্জয় বিরচিত মহাভারত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৯, অশ্বমেধ পর্ব পৃ. ৬০১
পূর্বোক্ত, ভূমিকা পৃ. ১২৯
পূর্বোক্ত, ভূমিকা পৃ. ১২৯-১৩০
[1]Dr. Pradip Bhattacharya, The First Bengali Mahabharata in Verse and in prose, www. boloji.com / index.cfm?md=Context&sd=Articles&ArticleID=7371, visitedon 23 July 2017.