স্টাফ রিপোর্টার
বাংলা সাহিত্যাকাশে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবকে বলা যায় অগ্নিবীণা হাতে ধূমকেতুর মতো প্রকাশ। তিনি নিজেই নিজেকে বলেছেন, ‘আমি চির-বিদ্রোহী-বীর/আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির’। তাই তাঁর উপাধি বিদ্রোহী কবি। আবার বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।’ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছেন ঠিকই কিন্তু প্রেমময় নজরুলও হিমালয়সম শুভ্র। আজ সেই দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মজয়ন্তী।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের গতিপথ পাল্টে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধারা তৈরি করেন। উন্নত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন সাম্য আর মানবতা। ধ্যান-জ্ঞান, নিঃশ্বাস-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনায় তিনি সম্প্রীতির কবি, অসাম্প্রদায়িক মেরুদ-। বাংলার সাহিত্যাকাশে দোর্দ- প্রতাপে আত্মপ্রকাশ করেন কবি নজরুল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলেছেন-
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
মূলত তিনি বিদ্রোহী কিন্তু তাঁর প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আয়নায়।’ পৃথিবীতে এমন কয়জন আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন?
বাংলা কবিতায় নজরুলের আর্বিভাব একেবারেই উল্কার মত। হঠাৎ করে একদিন তিনি বাংলা সাহিত্যে আর্বিভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে কীভাবে রাঙিয়ে গেলেন অথবা উজ্জ্বল করে দিলেন তা নিয়ে এখনো গবেষণা হতে পারে। কোন সঞ্জীবনী মন্ত্রে তিনি উচ্চকন্ঠে বলতে পারেন ‘মহা-বিদ্রোহী রণÑক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দলÑরোল আকাশেÑবাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণÑভূমে রণিবে নাÑ’।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণÑভূমে রণা বন্ধ হয়নি কিংবা উৎপীড়িতের ক্রন্দলÑরোলও কখনো থামেনি। আর সেই কারণেও নজরুল আমাদের কাছে এখনো প্রাসঙ্গিক। আসলে বিদ্রোহী কবি যেমন ছিলেন নির্ভিক, তেমনি এই প্রেমিক কবি ছিলেন রোমান্টিক। রোমান্টিকতার আতিশয্য ও অভিমানে ভরা তার অনেক গান বাঙালির হৃদয় রাজ্যে বিচরন করছে।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল।
নজরুলের লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ, নেই আদিজন গোষ্ঠীর প্রতি কোন তুচ্ছতাবোধ-
গাহি সাম্যের গান।
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান। ..
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মানুষ’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের পথ নির্দেশ করেছেন। যে পথ শোষণ-বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। আজকের সভ্যতার যে ক্রমোন্নতি এর মূলে রয়েছে মানুষেরই অবদান। অথচ সেই মানুষই নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছে। ‘¯্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। ধুলিমাখা পাপলিপ্ত, অসহায় দুখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে, এই ধূলার নিচে স্বর্গ টেনে আনবে, এ আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।’ সমাজ ও দেশকে সচেতন করতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সংকীর্ণতার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন।
কবি বলেছিলেনÑ ‘ব্রাহ্মণ পাদরির রাজত্ব গিয়াছে। গুরু-পুরোহিত, খলিফা, পোপ নির্বংশ প্রায়। ক্ষাত্র স¤্রাট ও সা¤্রাজ্য সব ধ্বংস হয়ে পড়েছে। রাজা আছেন নামে মাত্র। আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এখন বৈশ্যর রাজত্ব। এবার শূদ্রের পালা। এবার সমাজের প্রয়োজনে শূদ্র নয় শূদ্রের প্রয়োজনে সমাজ চলবে’। (লাঙল-নজরুল রচনাবলি, ৪র্থ খ-, বাংলা একাডেমি)
তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। মানবতার প্রতি তীব্র দরদি এমন কবি খুঁজে মেলাও ভার। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান’ উচ্চারণকারী কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন অন্তরে ধারণ করেছেন ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কা’বা নাই।’ নজরুলের প্রকাশিত দ্বিপাক্ষিক পত্রিকা ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন ‘সবচেয়ে বড় ধর্ম হলো মানবতা।’ ১৯২৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নজরুল মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ, যুদ্ধ, দারিদ্র্য দেখে তিনি বলেছেন,‘এই হৃদয়েই মন্দির-মসজিদ-গীর্জা। হৃদয় থেকে বড় কোন মন্দির বা উপাসনালয় নাই। তাই যখন খন্ডিতভাবে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাঁকে অপমানিতই করা হয়। তাঁকে গ্রহণ করতে হবে সমগ্র দৃষ্টি দিয়ে।
নজরুলের সকল অসাম্যর বিরুদ্ধে আত্মার জাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুল সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ‘…যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’ মানবতাকে জাগ্রত করতে নজরুল ধুমকেতুর মতো মতো আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আর এখনও ধ্রুবতারার মতো দিক নির্দেশ করে চলেছেন।
- সুরমার ভাঙন/ বিলীনের পথে জালালপুর
- ‘আমি করিম বাবার ছেলেরে দেখতে এসেছি’