বিশেষ প্রতিনিধি
সমবায় সমিতির নাম ভাঙিয়ে দাদন ব্যবসা করার অভিযোগ ওঠেছে দোয়ারাবাজারের ‘সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লি.’ এর সভাপতির বিরুদ্ধে। এই সমিতির সভাপতির অগঠনতান্ত্রিক ও অমানবিক আচরণে প্রতিষ্ঠাকালিন সদস্যরাও সমিতি ছেড়ে চলে গেছেন। সম্প্রতি একজন প্রাথমিক শিক্ষিকা সমিতির সভাপতি কর্তৃক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। দুই লাখ টাকা ঋণ গ্রহণের পর সুদসহ আসল এক লাখ টাকা পরিশোধ করার পরও এখন পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে ওই টাকা পরিশোধের জন্য আইনি নোটিশ দেয়া হয়েছে। ওই শিক্ষিকার মেয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট ঘটনার প্রতিকার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রবিবার প্রতারণার অভিযোগ তদন্ত করেছেন। ‘দোয়ারাবাজার সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লি.’ এর সভাপতি অভিযুক্ত রিংকু দেব অবশ্য বলেছেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়, নিয়মের বাইরে তিনি বা তার সমিতি কোন অর্থ লেনদেন করছে না।
উপজেলার রাকেশ চন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সুদেবী রানী সরকারের মেয়ে প্রিয়াংকা রানী দাস দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, তার বাবা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব প্রিয় মোহন দাস হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করলে তিন সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তার মা সুদেবী রানী সরকার। ভাই বোনদের পড়াশুনা, সংসার খরচ চালানো ছাড়াও মা’র চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তার মা। শেষে মান্নারগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রভা রানী করের সহযোগিতায় দোয়ারাবাজার সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লি.’ এর অফিসে আসেন তিনি।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে সমিতির সভাপতি রিংকু দেব অগ্রণী ব্যাংকের দোয়ারাবাজার শাখার দুটি চেক নিয়ে তার মাকে মাসে শতকরা সাত টাকা সুদে দুই লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা নগদ তুলে দেন। ওই সময় ২০ হাজার টাকা সমিতির তহবিলে তার নামে জমা রাখা হয়েছে বলে জানান। উত্তোলনের পরপরই মান্নারগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রভা রানী কর এই টাকা থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে যান। ওই এক লাখ টাকার সুদ ও আসল তিনি দেবেন বলে টাকা নেবার সময় বলেছিলেন।
২০২১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে তার মা সুদেবী রানী সরকার নিজের ভাগের এক লক্ষ টাকার সুদসহ আসল পরিশোধ করেন। কিছুদিন পর রিংকু দেব তার মায়ের কাছে উকিল নোটিশ পাঠান ঋণের কিস্তি দেবার জন্য। ওইসময় মাকে সঙ্গে নিয়ে সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে ১৫ হাজার টাকা সুদের কিস্তি দিয়ে আসেন তারা।
এরমধ্যেই ২০২২’এর ডিসেম্বর মাসে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় সুপ্রভা রানী করের সঙ্গে টাকার বিষয়ে কথা বার্তা হয় তাদের। তিনি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক লাখ পরিশোধ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর তার কলেজ পড়–য়া ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রিংকু দেবকে অনুরোধ করে তারা জানিয়ে আসে, সুপ্রভা রানী করের কাছ থেকে টাকা পাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করবে। বিনয়ের সঙ্গে রিংকু দেবকে এরা জানায়, বাবাকে হারিয়েছি, অসুস্থ মাকে হারাতে চাই না, দয়া করে টাকার চাপ দিবেন না।
এর কয়েকদিন পরই তার মাকে খবর দিয়ে নিয়ে সাদা স্টাম্পে স্বাক্ষর রাখেন রিংকু দেব। এখন বলছেন, তার মায়ের কাছে তিনি পাঁচ লাখ টাকা পান। উকিল নোটিশও পাঠিয়েছেন তিনি। এই অবস্থায় তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই বিষয়ে সুষ্ঠু প্রতিকারের জন্য দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত আবেদন জানিয়েছে তারা।
সুদেবী রানী সরকারের মেয়ে প্রিয়াংকা রানী দাস এই প্রতিবেদককে বললেন, বাবাকে হারিয়ে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার মায়ের ব্যাংক ঋণ আছে। তাঁর একার রোজগারে শহরের বাড়ী ভাড়া ও সংসার চলছে না। আমরা দুই ভাই বোন টিউশনি করে সংসারের খরচ চালাতে মাকে সহযোগিতা করছি। এই অবস্থায় আমাদের উপর এমন অমানসিক নির্যাতনে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি।
প্রিয়াংকার লিখিত অভিযোগ যাচাই করার সময় দোয়ারাবাজারের একাধিক বাসিন্দা সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতির কর্ণধার রিংকু দেবের চড়া সুদের ব্যবসার আরও নানা তথ্য জানালেন।
দোয়ারাবাজার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক প্রিয়তোষ দাস চ-ি বললেন, বার বছর আগে শুরুর দিকে ‘দোয়ারাবাজার সনাতন শ্রমজীবী সমিতি’র নাম ছিল ‘সনাতন যুব ফোরাম’। আমার বোনসহ আত্মীয় স্বজন এই সমিতির সদস্য ছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের গরীব অসহায় মানুষকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে নিয়ে এই সংগঠন যাত্রা করলেও কিছুদিন যাবার পরই অনেকে হতাশ হয়ে সংগঠন ছাড়েন। সভাপতি রিংকু কুমার দেব ও তার ভাই সেন্টু কুমার দেব এই সংগঠনের নামে দাদন ব্যবসা শুরু করেন। অন্যরা এই অবস্থা দেখে সংগঠন ছাড়তে বাধ্য হন। রিংকু-সেন্টুরা তখন ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে আশপাশের গ্রামের গরীব মানুষকে সদস্য করতে থাকে। এই অসৎ অমানবিক ব্যবসা দেখে আমাদের আত্মীয় স্বজনসহ সকলে সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসেন।
স্থানীয় বাসিন্দা বাবুল দাস বললেন, শুরুতে এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বি কন্যা দায়গ্রস্তকে সহায়তা করা। সহায় সম্বলহীন কেউ মারা গেলে তার সন্তানদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া। আমি ছিলাম সহসভাপতি। এক হাজার টাকা দিয়ে অনেকে সদস্য হয়েছিলেন। পরে সংগঠনের টাকা সুদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে অনেকেই সংগঠন ছেড়ে দেয়। আমার জানামতে এলাকার কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া অনেক তরুণ এই সংগঠনের সদস্য ছিল। এরা সকলেই সংগঠন ছেড়েছে। শুরুর দিকে সদস্য থাকা তনয় চক্রবর্তী, তাপস চন্দ্র দাস, ইপলু রায়, অঞ্জন চন্দ্র দাস, বাবুল চন্দ্র দাস, অনুপ চন্দ্র রায়, ইমন চক্রবর্তী, প্রণয় চক্রবর্তী ও তন্ময় চক্রবর্তী এই সংগঠন ছেড়ে গেছেন।
সংগঠন ছেড়ে যাওয়া সদস্য প্রণয় চক্রবর্তী বললেন, নিয়ম অনুযায়ী সংগঠন পরিচালিত না হওয়ায় সংগঠন ছেড়েছেন তিনি। এখন সংগঠনের নামে সভাপতি সুদের ব্যবসা করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন বলে শুনেছেন তিনি।
স্থানীয় সালিসকারক আব্দুল হান্নান বললেন, এর আগেও রিংকু কুমার দেব এর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল এলাকার অন্য একজনের। তারা সেটি মিমাংসা করে দিয়েছেন।
প্রিয়াংকার লিখিত অভিযোগে তার মায়ের ঋণ নেবার সময় মান্নারগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রভা রানী কর তার মায়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন দাবি করলেও, সুপ্রভা রানী কর সেটি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এসব বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফ মুর্শেদ মিশু বললেন, শিক্ষিকা সুদেবী রানী সরকারের মেয়ের একটি লিখিত আবেদন পেয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা সমাজ সেবা অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনও তদন্ত রিপোর্ট পান নি।
উপজেলা সমবায় অফিসার মো. মোফাজ্জল হোসেন বললেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে প্রিয়াংকা রানী দাসের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের ডেকে রবিবার কথা বলেছেন তিনি। এসময় রিংকু দেব এর কাছ থেকে প্রিয়াংকার মা সুদেবী রানী সরকার পাঁচ লাখ টাকা নেবার যথেষ্ট ডকুমেন্ট তিনি পান নি। রিংকু দেবের অভিযোগেরও অনেক বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ তিনি পান নি। এ বিষয়ে শীঘ্রই রিপোর্ট দেবেন তিনি।
সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি রিংকু কুমার দেব তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রসঙ্গে বললেন, অভিযোগের কোনটাই সত্য নয়। সুদেবী রানী সরকার সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি থেকে নয়, আমার ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে পাঁচ লাখ টাকা বিনা সুদে চেক দিয়ে হাওলাত নিয়েছেন। প্রথম আমি তার কাছ থেকে স্টাম্পে স্বাক্ষর নেই নি। তিনি যখন কথা দিয়ে কথা কয়েকবার রাখতে পারেন নি, তখন স্টাম্পে সবকিছু লিখে স্বাক্ষর নিয়েছি। দোয়ারাবাজার সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি একটি স্বনামধন্য সংগঠন দাবি করে তিনি জানালেন, এই সংগঠন ইতিমধ্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। সংগঠন থেকে যারা ছেড়ে গেছেন, তারা রেজিস্ট্রেশন করার আগে ছিলেন, রেজিস্ট্রেশন করার পর তারা স্বেচ্ছায় সংগঠন ছেড়ে চলে গেছেন। সংগঠন সম্পুর্ণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা বশির আহমদ বললেন, দাদন ব্যবসার কোন বৈধতা নেই। ব্যক্তিগতভাবে ঋণ দিয়ে লাভ নেবারও সুযোগ নেই। রেজিস্টার্ড সমবায় সমিতির বেশিরভাগ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালা মোতাবেক ঋণ দেওয়া নেওয়া হয়ে থাকে। দোয়ারাবাজার সনাতন শ্রমজীবী সমবায় সমিতি’র সভাপতি বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ উপজেলা সমবায় অফিসার তদন্ত করছেন। তদন্তের পর এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
- ভাঙছে নদী, সড়কে ঝুঁকি
- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের মাল্টি পারপাস সেন্টার পরিদর্শন