মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ
জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের হাওর বেসিন এলাকার মাঝে সুনামগঞ্জ অন্যতম। এই অঞ্চল বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে। সুবিশাল হাওরের জলরাশির মাঝে দ্বীপ সদৃশ বাড়ি ঘর গুলোতে স্থবির হয়ে যায় জীবনের গতিশীলতা। বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার জনমানুষের জীবনমান উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক উত্তরণ এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গঠন। এই উন্নত স্বনিভর বাংলাদেশ গঠনের পূর্ব শর্ত সবার জন্য গুনগতমান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। একই সাথে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অভিপ্রায় টেকসই উন্নয়ন অভিলক্ষ্য বাস্তবায়নের অন্যতম মাইলফলক হলো “লক্ষ্য-৪” বা “সবার জন্য গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা”। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম হল “শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি”। দেশের অন্যান্য এলাকার থেকে হাওর এলাকায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, বরং একটা চ্যালেঞ্জ। এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রথাগত ধ্যান-ধারণা, আর্থ সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি অনেক অনুঘটক গণমুখী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে বাধা হিসেবে কাজ করে আসছে। হাওর এলাকায় স্বল্পকালীন কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাতের প্রচেষ্টা থেকেই এ লেখার প্রেরণা। কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে আসার পথে প্রধান বাধা তাদের অভিভাবকদের অনিচ্ছা। শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে আনার জন্য প্রয়োজন, অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার নিকট ও সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করা। প্রয়োজন বোধে তাদেরকে দৃশ্যমান উদ্দীপকের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করা। এই এলাকা থেকে যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সম্মানজনক আসনে সমাহীন আছেন তাদের মাধ্যমে অভিভাবকগণকে উজ্জ্বীবিত করা। শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য তখনই উদ্বেলিত হয়, যখন বিদ্যালয়ে খেলার পরিবেশে তারা
নতুন কিছু শিখতে পারে। শিক্ষক শুধু গুরুজন হিসেবেই নয়, শিশুদের সংস্পর্শে আসেন পরম হিতৈষী এবং বন্ধুবৎসল হিসেবে। তাই শিক্ষার হার উন্নীতকরণে প্রয়োজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং শিক্ষা গ্রহণের সার্বিক পরিবেশ রূপান্তর। প্রয়োজন শিক্ষকদেরকে অভিনব উপায়ে শিশুদের শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রতিটি শিশুর চাহিদা ভিন্ন রূপে বুঝতে পারার মানসিকতা তৈরি। দূর্গম এলাকায় শিশুদের শিক্ষায় প্রধান বাঁধা প্রাকৃতিক দূর্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি। তাই ঋতুর পরিবর্তনের সাথে শিক্ষায় যেন কোনো বাঁধা না আসে, সেজন্য তাদের প্রয়োজন সহজ ও বিকল্প যাতায়াতের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষাকে তাদের দুয়ারে পৌছে দেয়ার। শিক্ষা শুধু জীবন গড়ার জন্যই নয়, মেধা-মনন-সত্ত্বাকে প্রভাবান্বিত করার জন্যও। আমাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ- এসকল আমাদের জাতিসত্ত্বার অংশ। এগুলোকে যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট যথাযথভাবে তুলে ধরা না যায়, তাহলে তারা কোনো দিনই জানবে না তাদের পূর্বপুরুষ কতটা আত্মত্যাগের দ্বারা তাদের জন্য স্বাধীন এই দেশ রেখে গিয়েছেন। ফলে তারা কোনো দিনই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় উদ্যম ও প্রত্যয় পাবে না। সুনামগঞ্জে প্রেক্ষাপটে তাই প্রতিটি শিক্ষাপীঠে ছড়িয়ে দিতে হবে স্বাধীনতার গৌরব স্পৃহা। শিশুদের জন্য খেলনা সামগ্রী ও উপকরণ, সহজপাঠ্য বই, আহারের ব্যবস্থা, বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষা-উপকরণ, স্কুলের ইউনিফর্ম এসকলই শিক্ষার প্রকৃত বিকাশে অন্যতম প্রয়োজনীয়তা। শহর এলাকার বিদ্যাপীঠ সমূহের সাথে দূর্গম এলাকার বিদ্যালয় সমূহের শিক্ষার মান বৈষম্য একটি বড় ধরণের প্রতিকুলতা হিসেবে বিবেচ্য। প্রয়োজন সকল ধরণের বৈষম্য দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়া। হাওর এলাকার উন্নয়ন বাস্তবায়নে গুণগত শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজন জনগণ, জনপ্রতিনিধি, সরকার, এনজিও, দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষক সহ সকল অংশীদারের সম অংশগ্রহণ। কাউকে বাদ দিয়ে কারো প্রাধিকার এই ক্ষেত্রে তৈরি করে সুদূর প্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবের। হাওরবাসীর উন্নয়নে বর্তমান সময়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন চিন্তাভাবনা-উদ্যোগ ও প্রয়াস অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সরকারের আন্তরিকতায় বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঝরে পড়ার হারও হ্রাস পাচ্ছে এবং শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা রাখা যায়, সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনে সুনামগঞ্জের তরুণ প্রজন্ম অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখবে।
- নদী রক্ষার অভিযান অব্যাহত থাকবে-পরিকল্পনামন্ত্রী
- বর্ষায় জলাবদ্ধতা আর শুকনায় ধুলা