হাওর রক্ষা বাঁধ/ বর্ধিত সময়েও শেষ হয়নি কাজ

বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে
‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’। জামালগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধের কাজের গতিপ্রকৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চয়নকৃত চরণের মতোই অতৃপ্তি আর শঙ্কায় ভরপুর। অতিরিক্ত সময়ের শেষভাগে এসেও কোন কোন বাঁধে মাটি ফেলতে দেখা গেছে। অনেক বাঁধে দূর্বা-দুরমুশের অনেক কাজ বাকি আছে। ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারে এখনও বাঁশ-বস্তা দেওয়ার কাজ শেষ হয় নি। পুরো পাগনা হাওর ঘুরে এমন অবস্থাই দেখা গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা দ্রুত সময়েই অবশিষ্ট কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন।
সম্প্রতি (১৫ ফেব্রুয়ারি) পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম সুনামগঞ্জে হাওর পরিদর্শনে এসে নির্ধারিত ২৮ ফেব্রুয়ারির বদলে ৭ মার্চ বাঁধের কাজের সময়সীমা বর্ধিত করেন। ওই সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। মন্ত্রীর এ হুঁশিয়ারি’র টনক নড়েনি পিআইসি সংশ্লিষ্টদের। বর্ধিত সময় শেষে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় হাওর পারে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৬ মার্চ (সোমবার) পাগনা হাওর সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বর্ধিত সময় শেষে বাঁধে এখনও মাটি পড়ছে। বাঁধ টেকসইয়ে অধিকাংশ বাঁধেই লাগানো হয়নি দূর্বা। অনেক বাঁধে দুরমুশের কাজও বাকি আছে। ৫৮ ও ৫৯ নম্বর পিআইসিভুক্ত পাগনা হাওরের সবচেয়ে বিপজ্জনক বৌগলাখালি ক্লোজারে মাটি ও দুরমুশের কাজ শেষ হলেও বাঁধ মজবুতকরণে বাঁশ, বস্তা, জিও টেক্স পড়েনি। এর মধ্যে ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৮, ৪৯, ৫০ নম্বরসহ অনেক বাঁধে দূর্বা লাগায়নি পিআইসিরা। ৪৭ নম্বর বাঁধে মাটি ফেলতে এখনও ভেকো উঠানামা করছে। এরপরের কয়েকটি বাঁধ আছে যেগুলোতে দূর্বা-দুরমুশ কিছুই হয়নি। এছাড়া পাগনা হাওরের ৫৫ নম্বর পিআইসিভুক্ত আরেক ঝুঁকিপূর্ণ স্পট উজ্জ্বলপুরের সুরমা নদী তীরবর্তী ভাঙ্গায় মাটি পড়লেও বাঁধ টেকসইয়ে অনেক কাজই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। শুধু উজ্জ্বলপুরের ভাঙ্গাই নয় পাগনা হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ কোন স্পটেই বস্তা বাঁশের আড় দিতে দেখা যায় নি। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, দিরাই, ধর্মপাশা ও নেত্রকোনার কালিয়াজুরি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত বিশাল হাওরটি শেষ সময়ে এসেও অরক্ষিতই মনে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, হালি হাওরের ৩৫ নম্বর পিআইসিভুক্ত বিপজ্জনক ভাঙ্গা ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন বাঁধে এখনও মাটি ফেলা হচ্ছে। হালিসহ শনি ও মহালিয়া হাওরের অনেক বাঁধে ড্রেসিং-দূর্বা লাগানোর কাজ শেষ হয়নি। গত মৌসুমে ৩৬টি প্রকল্পে ৫ কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা থেকে চলতি মৌসুমে ৬১টি পিআইসির অনুকূলে ১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বেড়ে বরাদ্দ ও প্রকল্প দ্বিগুণ হলেও কাজ এগুচ্ছে সেই পুরোনো তালে। প্রকল্প বাড়িয়ে কেবল সরকারি অর্থ লোপাটের সুযোগই সৃষ্টি করা হয়েছে। কার্যত কৃষকের কোন উপকার হচ্ছে কিনা প্রশ্ন হাওরপাড়ের মানুষের।
উজ্জ্বলপুর ভাঙ্গার ৫৫ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব মাহবুবুল ইসলামকে দূর্বা-দুরমুশের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আগামী দুই দিনের মধ্যে দূর্বা লাগাইতে লেবার লাগানি হইব। এইখানে দূর্বা নাই, একটু দূর থাইক্যা দূর্বা আনতে হয়, তাই দেরি হইতাছে।’
হালি হাওর পারের আছানপুর গ্রামের কৃষক মো. শাহীন মিয়া বলেন, আছানপুরের ভাঙ্গাত বস্তা দেওয়া হইতাছে। আর দুইদিন সময় লাগব। এইখানের কাজডা ভালো হইছে। বাঁন্ধের কিছু কিছু সাইডে এখনও কেউ কেউ ড্রেসিং করতাছে, দূর্বা লাগাইতাছে। আর নির্ধারিত সময় বলতে অফিস আর হেরাই (পিআইসি) ভালা জানে, এইডা আমরা কি কইমু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেহেলী ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য জানিয়েছেন, প্রায় সব বাঁধে মাটির কাটা শেষ। তবে ঘনিয়ার বিলের কাছে এখনও মাটি কাটা চলছে। বলতে গেলে ড্রেসিং-দূর্বার কাজ এখনও অনেক বাঁধেই বাকি আছে। কিছু কিছু বাঁধে দূর্বা লাগালেও পানি না দেওয়ায় দূর্বা মরে যাচ্ছে। সময় বাড়াইয়া যদি কাজ শেষই না হইলো সময় বাড়ানোর দরকারটা কী। সময়মতো কাজ শেষ না হলে ক্ষতিটা তো কৃষকের হইব।
পাগনা হাওর থেকে ফিরে উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের আরও ৭ দিন সময় বাড়ানোর পরও কাজ হয়নি। এখনও মাটির কিছু কাজ এবং দূর্বা-দুরমুশের কাজ বাকি আছে। মূলত মনিটরিংয়ের অভাবে এমনটা হচ্ছে। বর্ধিত সময়ের পরও যাদের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার পাশাপাশি আগামী দিনে পিআইসি তালিকায় যুক্ত না করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কেন্দ্রীয় হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বললেন, বাঁধের কাজের যে অবস্থা তাতে সারা মার্চেও কাজ শেষ হবে কিনা সন্দেহ। বাঁধে এখনও মাটি, দূর্বা, দুরমুশের কাজই চলমান আছে তাহলে সময় বাড়িয়ে লাভটা কার হলো। মূলত পিআইসি ও পিআইসির অন্তরালের লোকদের সুযোগ-সুবিধা দিতেই সময় বাড়ানো হয়েছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, কৃষকের স্বার্থের কথা বলে বরাদ্দ প্রকল্প দুটোই বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এতে কৃষক উপকৃত হচ্ছে না, বরং সিন্ডিকেটধারী সুযোগসন্ধানীরা উপকৃত হচ্ছে। এখন অতিবৃষ্টি হলে কৃষকের মাথায় হাত উঠবে। তাহলে সরকারের বরাদ্দকৃত অঢেল অর্থ ছাড়ে উপকৃত হলো কারা?
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ বাপাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, আমাদের যে মূল মাটির কাজ সেটা শেষ হয়ে গেছে। আমরা মনে করি হাওর এখন ঝুঁকিমুক্ত। আর দূর্বা-দুরমুশের যে বিষয়টা বললেন সেটা ৮০ ভাগের মতো শেষ হয়েছে। ২০ ভাগ যেটা আছে, সেটা দ্রুতই শেষ হবে। বর্ধিত সময়ের ভেতরে মাটির মূল কাজটা তো হয়েই গেছে। বাকি কাজ দ্রুত শেষ করে ফেলতে পারব আমরা।