কুমার সৌরভ
অমিয়শঙ্কর চৌধুরীর ভাষ্য অনুসারে হাছন রাজা ‘প্রেম, বৈরাগ্য ও বিরহের মরমী পল্লীকবি’ [হাছন রাজার সঙ্গীতমালা-অমিয়শঙ্কর চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১]। মূলত তার কাব্যচর্চা বা সঙ্গীত সাধনা মানবমনের এই তিনটি ভাবপ্রপঞ্চ নিয়েই আবর্তিত হয়েছে। এরকম এক কবির কাব্যে ইহজাগতিকতা খুঁজার চেষ্টা এক পুকুর পানিতে লুক্কায়িত একটি ছোট্ট আধুলি পয়সা বের করে আনার মতই কঠিন কাজ। হাছন রাজাকে নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তাঁর কর্ম ও জীবনে সমকালীনতার প্রভাব বা তাঁর সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল, যা ইহজাগতিকতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত, সে নিয়ে কোনরূপ আলোচনা চোখে পড়ে না। নতুন করে এমন বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা তাই দুরূহ কাজ বটে। তাঁর গানের সম্ভার পর্যালোচনা করে যে কারও মনে হবে, তিনি বৈষয়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলোকে উপেক্ষা করে গেছেন। দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন কেবল সৃষ্টিকর্তার অপার করুণা লাভের দুর্মর ইচ্ছার উপর। তাই গান দিয়ে তাঁর ইহজাগতিক মতাদর্শ সম্পর্কে স্থির-নিশ্চিত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। বিভিন্ন আঙ্গিকে আলাপ-আলোচনা করে কেবল কিছু অনুমান করা যাবে। অন্য দিকে কাব্য সাধনার বাইরে তাঁর একটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ছিল। তিনি দুর্দ-প্রতাপে পরিচালনা করেছেন রামপাশা ও লক্ষ্মণশ্রীর দুইটি বৃহৎ জমিদারী। জমিদারী পরিচালনা করতে যেয়ে তাঁকে বহু বৈষয়িক সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। সেই ব্যক্তিগত জীবনে হাছন রাজার জাগতিক ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে সবচাইতে পরিপূর্ণ আকারে। একজন ব্যক্তির ভিতর এই দুই ভিন্নধর্মী চর্চার স্বরূপ জানতে পারলে তাঁকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিশেষায়িত করা সহজ হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তথ্যের অপর্যাপ্ততা। হাছন রাজার গান নিয়ে যত আলোচনা আছে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই জমিদারী পরিচালনার নানা বিষয়বৈচিত্র নিয়ে। যতটুকু আছে তাতে একধরণের একদেশদর্শিতা, প্রভাবদুষ্টতা, তথ্যের অপ্রতুলতা, তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে বিশ্লেষণের অভাব লক্ষণীয়। তাই হাছন রাজার গানে তাঁর ভাবালুতা-সমৃদ্ধ মনের জানালা খোঁজে নেয়া যতটা সহজ ততটাই কঠিন বৈষয়িক জীবনের দরজা খোলে সেটি কেমন তার স্থিরসিদ্ধান্তে পৌঁছা। আর এটা জানা কথাÑ ব্যক্তির অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে তাঁর জাগতিক মনোভাব বুঝতে সহজ হয়। এই জায়গায় পরিষ্কারভাবে তাঁর শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠে। ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থানই তাঁর সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণ করে। গানে যেমন ভাবের রাজা ছিলেন তেমনি জমিদার হিসাবে তিনি সেই বিভূষণ ঠিক কীভাবে বজায় রেখেছিলেন সেই কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজটি সামনের দিনে কোন গবেষক নিশ্চয়ই করবেন। করা সম্ভব। কারণ এ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করা অনিসন্ধিৎসুর জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। আমাদের পক্ষে এই ধরণের ছোট নিবন্ধের অক্লেশ সৌখিন চর্চায় তা উদঘাটনের দাবি তোলা কিংবা এ-রকম প্রয়াস চালানোর অর্থ হলÑ জলে না নেমে মাছ ধরার মত কল্পনাবিলাস। বলা বাহুল্য এরকম এক অর্বাচীন প্রয়াসের নিদর্শনই এই নিবন্ধ। ভবিষ্যতে হাছন রাজাকে নিয়ে বহুমাত্রিক উদ্ভাবন-উৎখনন হবে। তখন আর সবের সাথে এই বিষয়টিও দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে উঠবে।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২৪ জানুয়ারি ১৮৫৫ খ্রিস্টিয় সনে। মৃত্যুবরণ করেন ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সনে। তাঁর জীবৎকালের ৬৭ বছরই ছিল ব্রিটিশ পরাধীনতার সময়। দেশ ও মানুষ এই ব্রিটিশ শাসনাধীনের পরাধীনতার লজ্জায় থাকলেও অল্প কিছু মানুষ তখনও ব্রিটিশ বেনিয়া-শাসকদের তৈরি করা সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় কিছু পরিমাণে প্রভুত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। হাছন রাজা উত্তরাধিকারসূত্রে সেই অল্পসংখ্যক প্রভাবশালী দেশীয় ভাগ্যবানদের একজন। বিশ^নাথের রামপাশা ও সুনামগঞ্জ সদরের লক্ষ্মণশ্রীর দুইটি জমিদারি ছিল তাঁর। হাছন রাজার সামন্ততান্ত্রিক উত্তরাধিকত্বও বেশ পাকাপোক্ত। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর কথা থেকে জানা যায়, ‘কাজেই হাসন রাজার পরিবার যে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পূর্বেও চৌধুরী ছিলেন-সে সম্বন্ধে তর্কের কোন অবকাশ নেই।… চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে সকল জাতীয় লোকেরা জমির মালিক হয়ে পাইকারীভাবে চৌধুরী লিখতে আরম্ভ করলে আলী রেজা সিলেটের তদানীন্তন কালেক্টরের নিকট তার নামের পিছনে চৌধুরী লিখতে আপত্তি করেন। তাঁর এই অনিচ্ছার কারণ ছিল এই যে, একেবারে সাধারণ শ্রেণীর লোকেরাও ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে যখন চৌধুরী লিখতে শুরু করেছেÑ তখন তাঁর নামের সঙ্গে চৌধুরী যোগ করা নিতান্তই অপদস্ত করার নিদর্শন। কালেকটর তাঁকে আশ^াস দেন, অতঃপর তাঁর নামের আগে দেওয়ান লিখা হবে।’ [দেওয়ান হাসন রাজা- অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, প্রসঙ্গ হাসন রাজা, ড. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ- ৩৪-৩৫]। সামন্তসুলভ আভিজাত্যের এরকম পারিবারিক চর্চার সংযুক্তি ছিল হাছন চরিত্রে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি পিতৃহীন হওয়ায় অল্প বয়সেই জমিদারির বিত্তবৈভবের মালিকানা তাঁর হাতে চলে আসে। এরকম এক সামন্ততান্ত্রিক পরম্পরার কারণে জন্ম থেকেই নিজেকে সাধারণের চাইতে আলাদা ও মনোস্তাত্ত্বিকভাবে অভিজাত ভাবার সুযোগটিও ছিল তাঁর করায়ত্ত্ব। তাঁকে কখনও অভাব অনটনের কদর্য চেহারা দেখতে হয় নি। সমাজে ব্রিটিশ শাসন শোষণের ফলে যে সামাজিক ভারসাম্যহীনতা, অর্থনৈতিক অসাম্য তৈরি হয়েছিল হাছন রাজার উপর তার কোন আঁচ লাগে নি। অর্থাৎ সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্বগুলো, বিশেষ করে নি¤œশ্রেণির সাথে উচ্চশ্রেণির যে দ্বন্দ্ব সেখানে ব্যক্তি হাছন রাজা প্রভুত্বসুলভ উদারতার বাইরে আর কিছু করেছিলেন বলে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীণ যে বিদ্রোহ ও লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস তৈরি হতে চলেছিল সে সময়, নিজের সামন্ততান্ত্রিক অবস্থানের কারণে সে-সবের সাথেও তাঁর কোন সম্পর্ক তৈরির কারণ ছিল না। তৎকালে সমাজ-মানসে যে আধুনিক চিন্তার সূত্রপাত ঘটে গিয়েছিল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব অথবা অনাগ্রহের কারণে সে-সম্পর্কেও হাছন উদাসীন থেকেছেন। তিনি নিজের পরিপাশর্^ ও গ্রামীণ সমাজের লোকায়ত দর্শন দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছেন। ফলে হাছন মানসে যেমন সমাজে বিরাজমান অন্যায্যতা ও অন্যায়-উৎপীড়নের দিকটি কোন প্রভাব ফেলে নি তেমনি ব্রিটিশবিরোধী প্রবল সংগ্রামের বিষয়টিও উপেক্ষিত ছিল। এমন মানস গঠনের ফলে সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্বগুলো তাঁকে তেমন করে প্রভাবিত করতে পারেনি। মনে রাখতে হবে তিনি শোষিত-নির্যাতিত সাধারণ জনগোষ্ঠীর কোন প্রতিনিধি ছিলেন না। এরকম হওয়ার কোন বাসনাও ছিল না। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন সামন্তবাদী আভিজাত্য ও বিপুল সম্পদভান্ডার। তিনি ছিলেন সমাজের উপরের শ্রেণির লোক। তার মনোজগত তৈরি হয়েছিল শাসক ও জমিদার রূপে, যেখানে প্রজাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের কোন ঠাঁই ছিল না। সাধারণ মানুষকে তিনি দেখেছেন নিজের প্রজা রূপে, অর্থাৎ তিনি নিজে ছিলেন প্রভু ও শাসক। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিটি খ-িত। এই দেখায় প্রচলিত শ্রেণি-বিরোধের স্বরূপ বুঝা যায় না। বুঝলেও থাকে উপেক্ষিত। তাদের কষ্ট বেদনা নিজের কষ্ট বেদনা রূপে যাকে আধুনিক পরিভাষায় সমানুভূতি (ঊসঢ়ধঃযু) বলে, সেই রূপে আলোড়ন তুলে না। তাই তাঁর গানে সাধারণের কান্না আর কষ্টের কথা উঠে আসে নি। উঠে আসে নি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিতরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ, টানাপোড়েনের কোন কথা। এটা হাছনের অবস্থানগত অসহায়ত্ব। অন্যদিকে তিনি এমন চর্চায় উৎসাহীও ছিলেন না। তাঁর জীবনের দর্শন এমন ছিল না। তিনি জমিদারীর বাইরে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে বেশি ভেবেছেন। আর ভেবেছেন প্রেমের তনুমন উজাড় করা আবেগ নিয়ে। তাই তার গানে এই দুই অনুষঙ্গই উঠে এসেছে ঘুরেফিরে বারে বারে।
ব্যক্তির মানস গঠনের বিষয় কিছুটা ঐতিহাসিক। এখানে তার অতীত ইতিহাসের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকে। হাছন রাজার পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিলেন। তাও বেশি দিন আগের নয়। হাছন রাজার উর্দ্ধক্রমের চার পুরুষে ধর্মান্তর ঘটেছিল। বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব নামক ওই ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হয়ে বাবু খান নাম ধারণ করে এই বংশের ইসলামী ধারা পত্তন করেন। বাবু খানের পুত্র আনোয়ার খান, আনোয়ার খানের ঔরসজাত আলী রেজা। এই আলী রেজারই পুত্র হলেন হাছন রাজা। ধর্মান্তর ঘটলেও মানুষের সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় না। বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেবের পরম্পরায় যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল তাই ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যেও সঞ্চারিত হবে, এও মানুষেরই সহজাত বৈশিষ্ট্য। অমিয়শঙ্কর চৌধুরীও বলছেন, ‘আবার আমরা জানি হাছন রাজার পূর্বপুরুষরা ছিলেন হিন্দু। তাই দেখছি হাছন মানসে বনেদী ঐতিহ্যে প্রাপ্ত নানা ধ্যান ধারণার উপাদান ক্রীয়াশীল ছিল। আর ছিল পূর্বপুরুষের ধারায় প্রাপ্ত হিন্দু সমাজের নানাবিধ দার্শনিক বিষয়সমূহ।’ [হাছন রাজার সঙ্গীতমালা, অমিয়শঙ্কর চৌধুরী, পৃষ্ঠা-৩৬]। হাছন রাজার এই মানস সমন্বয়ের। এই মানস আত্মীকরণের এবং সংযুক্তির। তাঁর ব্যক্তি জীবনীকাররা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কোন নিদর্শনের কথা উল্লেখ করেননি। বরং তার উদারতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার নানা গল্প প্রচারিত হয়েছে। হাছন রাজা সম্পর্কে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাতকারী প্রভাতকুমার শর্মার লিখায় এরূপ অজস্র ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যা ব্যক্তি হাছন রাজার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রমানসকে ফুটিয়ে তুলে। শ্রী শর্মা তাই বলেছেন, ‘পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাহা প্রাচ্যশিক্ষার গুণে ধর্মপ্রাণতার ও ধর্মোদারতার ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইত, হাসন রাজাতে তাহাই অশিক্ষার ফলে প্রতিভার খেয়ালের মত ফুটিয়া উঠিত।’ [মরমি কবি হাসন রাজা- প্রভাতকুমার শর্মা, প্রসঙ্গ হাসন রাজা, ড. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ- ২১] অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফও একই ধরণের মন্তব্য করেছেন বলে আমরা দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন- ‘তবে হাসন রাজা যে অত্যন্ত উদার মতাবলম্বী ছিলেন সে সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত। আমি প্রাচীন বিশ্বস্ত লোকের বাচনিক জানতে পেরেছি- কালীপুর মৌজা পত্তনের পূর্বে হাসন রাজা ভবিষ্যৎ বসতকারীদের দ্বারা কালীপূজা করিয়েছিলেন এবং এ পূজা উপলক্ষে সাতশত টাকা প্রজাদের দান করিয়াছিলেন।’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৯] । হাছন প্রকৃত অর্থে ছিলেন ধর্মীয় সমন্বয়বাদী এক লৌকিক কবি। তিনি এক গানে বলছেন, ‘আমি যাইমুরে আল্লার সঙ্গে।/ ও আমি যাইমুরে আল্লার সঙ্গে’ তো আরেক গানে বলছেন, ‘দয়াল কানাই, দয়াল কানাইরে/ পার করিয়া দাও কাঙ্গালীরে।’ রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেনÑ ‘আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমান মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, উপরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্যে, বাউল সম্প্রদায়ের সেই শিক্ষা দেখি,- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করে নি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাঁধে নি।’ [মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন (সংগৃহীত ও সম্পাদিত) হারামণি লোকসঙ্গীত সংগ্রহ) গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]। হাছন রাজা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ কথিত অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস মিলন-সাধক। কি ব্যক্তি জীবনে কি কাব্যসাধনায়, সর্বত্র তাঁর এই চিৎপ্রকর্ষতা উজ্জ্বল। নানা ধর্ম-বর্ণ, মত-পথ বিভাজিত হিংসা-অসাম্য-অন্যায্যতা পীড়িত বিশ্বে এমন উদার ও সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি হাছন রাজার জাগতিক উপলব্ধির মহত্তর উদাহরণ হতে পারে।
হাছন রাজার গানের প্রধান ধারাটি আবর্তিত হয়েছে জীবাত্মার সাথে পরামাত্মার মিলনাকাক্সক্ষার আকুতিতে, যেখানে পার্থিব জীবনকে অসার হিসাবে বর্ণনা করে তিনি পারমার্থিক চিরশান্তির সন্ধানে ব্রতী ছিলেন। হাছন যখন বলেন- ‘তুমি কে আর আমি কে তাই ত বুঝি নারে/এক বিনে দ্বিতীয় আমি অন্য কিছু দেখি নারে’ তখন আমরা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যে অখ- সত্ত্বার একটি অনুভূতি পাই সেখানে বিভেদের কোন জায়গা নেই। জাগতিক সমস্ত কিছু ভুলে কবি যখন ‘আমি আমার পরিচয় করিয়াছি/ সবই তুমি আমিত্ব ছাড়িয়ে দিয়েছি’ বলেন তখন ব্যক্তি হাছন রাজাকে জগৎ এর সীমাবদ্ধতায় নিয়ে আসা এক ধরণের ভ্রান্তিবিলাস মনে হতে পারেই। আবার উপর্যুক্ত কথাগুলোর শাব্দিক অর্থকে যদি আমরা জাগতিক নিয়ম দিয়ে বিবেচনা করি তাহলে ঠিকই আরেক ধরনের উপলব্ধি আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যাবে। তিনি ব্যক্তি সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়েছেন গানের চরণে চরণে। ব্যক্তির পরিবর্তে সমষ্টি তথা সারা পৃথিবী ব্যাপী মানবগোষ্ঠীর যে সাধারণ চাহিদাÑ যাবতীয় ভেদরেখার অবলোপন ঘটিয়ে বিশ^নাগরিক হয়ে যাওয়া, তার সাথেও সাযূজ্যপূর্ণ করা যেতে পারে। দুনিয়াদারিতে এই ‘আমি’ ই হল যত সর্বনাশের মূল। আমি মানেই অন্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। আমি থেকেই আমার অধীনে অন্যকে নিয়ে আসার আকর্ষণ তৈরি হয়। এমন আমিত্ববোধ তাড়িত হয়েই পৃথিবীর শক্তিমত্ত মানুষগুলো নিরীহ আর-সব মানুষকে পদানত রাখার কৌশল তৈরি করে। এ-ভাবে মানুষের সাথে সামাজিক সম্পদাদিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ‘আমি’ রূপ মানুষের খবরদারি। দুনিয়া ভাগ হয়ে পড়ে আমি আর তুমিতে। সেই যে ভাগ হল সেই বিচ্ছিন্নতা রূপান্তর ঘটিয়ে ঘটিয়ে চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বদলিয়ে বদলিয়ে এখনও বহাল তবিয়তে টিকে আছে। এ সর্বনাশা আমি-আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেতে ভাববাদী বা বস্তুবাদী দার্শনিকেরা কম চিন্তা করেননি। তাঁদের আমিত্ব ঘুচানোর চিন্তন-ধারা আজও সমান সক্রিয়। ভাববাদীদের একাংশ ব্যক্তির ভিতরের অহংভাবকে নির্মূল করে দিয়ে আত্মাকে পরমাত্মার সাথে মিলিয়ে নেয়ার জন্য নিজের সত্ত্বাকে ভুলতে চেয়েছেন। বস্তুবাদীরা মানুষে মানুষে যত বৈষম্য তার অবলোপন চেয়েছেন যুগে যুগে। তারা সকল মানুষের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন মতবাদ তৈরি করেছেন। হাছন রাজাও আমি রূপ সত্ত্বাকে বিসর্জন দেয়ার আকুতি জানিয়েছেন তার গানে, সর্বগ্রাসী লোভ ও হিংসার দুনিয়ায় এমন ভাবনা-প্রকাশের গুরুত্ব কম নয়।
তাঁর রচিত সঙ্গীতসম্ভার থেকে নির্বাচিত কিছু গানের মরমী ভাবটিকে মন থেকে সরিয়ে ফেলে শাব্দিক অর্থদ্যোতকাকে গ্রহণ করলে যে-ভাবের সন্ধান মিলে তাতে চরমভাবে দুনিয়াবি বাস্তবতার সন্ধান মিলে। তিনি যখন বলেন- ‘প্রেমের মানুষ নয় যারা, হাছন রাজার গান শুনিস না তোরা।।/ অপ্রেমিক তো মানুষ নয়রে জীবিত থাকতে সে মরা।।’ তখন এ কথা বলার উপায় থাকে না যে হাছন রাজা মননের ভিতর থেকে জগৎ-সংসারকে একেবারে বিদায় করে দিয়েছেন। বরং তিনি সেইসব অপ্রেমিক একদেশদর্শী স্থবির ভাবনার প্রতিনিধিদের সাবধান করে দিয়েছেন তাঁর গান না শুনার জন্য কারণ তার গানের রস আস্বাদনের জন্য দরকার ভালবাসায় পূর্ণ এক মন। এই ভালোবাসাকে যদি আমরা মানুষের মধ্যে সতত প্রবাহিত চিরন্তন মিলনমুখী আবেগানুভূতি বলি তাহলে অত্যুক্তি করা হবে না নিশ্চয়ই। একই ধরণের ভাবের সন্ধান পাই তার আরও গানে। যেমনÑ ‘প্রেমের বাজারে বিকে মাণিক ও সোনা রে।/ যেই জন চিনিয়া কিনে, লভ্য হয় তিন দুনা রে ॥’ এও প্রেমিক হাছন রাজার জীবনরস আস্বাদনের দুর্নিবার আকুতির আরেক পরিচয়। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি প্রচ- ভোগী ছিলেন বলে জানা যায়। জমিদারির প্রাচুর্য, সামন্ততান্ত্রিক বিলাস-বিহ্বলতা তাঁকে ভীষণভাবে প্রেমাসক্ত করে ফেলে। তিনি গেয়ে উঠেন, ‘নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে,/ নিশা লাগিলরে,/ হাছন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে।’ হাছনজানের মুখ কল্পনা করে তিনি আকুল হয়ে উঠেন এই বলে, ‘ছট ফট করে হাছন, দেখিয়া চান্দ মুখ ॥/হাছন জানের মুখ দেখি, জন্মের গেল দুঃখ ॥/ হাছনজানের রূপটা দেখি, ফালদি ফালদি উঠে।/ চিড়াবারা হাছন রাজার বুকের মাঝে কুটে ॥’ হাছন রাজার এই প্রেমাসক্ত রূপটিও ইহজাগতিক কামনা বাসনার মানবীয় চরিত্র বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত।
এর আগে বলা হয়েছে ব্যক্তিস্বরূপের প্রকৃতি জানতে ব্যক্তি মানুষকে সামগ্রিকভাবে জানতে হয়। অন্ধের হস্তি দর্শনের মত দেখলে চলে না। হাছন রাজার গানে যে ভাবাদর্শের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত জীবনানুশীলনে তার প্রতিফলন কতটুকু তাও জানা অতিআবশ্যক। তাঁর জাগতিক ভাবনা-চিন্তা অনুসন্ধান জরুরি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল- হাছন রাজাকে নিয়ে এ যাবৎ যত কাজ হয়েছে, সবই তাঁর কাব্যচর্চার দশদিক নিয়ে। আর কিছু হয়েছে তাঁর ব্যক্তি-জীবন নিয়ে, যা মূলত তাঁর আত্মীয়-স্বজন-শুভানুধ্যায়ীদের দ্বারা সৃজনকৃত। এতে তাঁকে মানবিক, উদার ও মহৎপ্রাণ জমিদার রূপে চিত্রিত করার প্রবণতা আছে। এটি হয়। ইতিহাসচর্চার এই সীমাবদ্ধতা দূর হওয়ার নয়। ইতিহাস কখনও ব্যক্তি বা শ্রেণি-নিরপেক্ষ হতে পারে কি-না তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। আর যাকে নিয়ে এই চর্চা তিনি যদি সামাজিকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী হন তখন তাঁর গুণচর্চার বাইরে আর তেমন কিছু আশা করা বাঞ্ছিতও নয়। বীরের বীরত্বগাঁথা প্রচারই ইতিহাসের কাজ নয় বলে অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু তার উপায় কই? ইতিহাস তৈরির জন্য প্রয়োজন ঐতিহাসিক উপাদান। প্রয়োজন ঘটনার সূত্র। দরকার প্রাসঙ্গিক বয়ান। হাছন রাজার ক্ষেত্রে সেই উপাদান-সূত্র-বয়ান সংগ্রহ আজ আর সম্ভব নয়। তাই প্রচলিত বয়ান এবং ঐতিহাসিক পটভূমি থেকেই অনুমানে পৌঁছাতে হবে। হাছন রাজার বংশধর সামারীন দেওয়ানকে ধন্যবাদ দিতে হয় এ কারণে যে, তিনি ‘হাসন রাজা-জীবন ও কর্ম’ নামক বইয়ে একজন সমগ্র হাছন রাজাকে অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। বংশধর হওয়ার সুবাদে সংগত কারণেই তিনি হাছন রাজার আলোকময় দিকগুলো উন্মোচনেই প্রয়াসী থেকেছেন। এরপরেও বলা যেতে পারে ব্যক্তি হাছন রাজাকে জানতে এই বইটিই এখন পর্যন্ত উৎকৃষ্ট। বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি হাছন রাজার সমাজ চেতনা ও রাজনৈতিক ভাবনা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। এখানে হাছন রাজার রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার কিছু বিষয় তিনি উল্লেখ করেছেন। বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় বলা আছে, ‘হাসন রাজার কনিষ্ট পুত্র দেওয়ান আফতাবুর রাজা একদিন এক আলাপমুহূর্তে নিজ পুত্রকে বলছিলেন, হাসন রাজা সাহেব একটি অখ- ভারতে বিশ^াসী ছিলেন। বাবা সর্বভারতজুড়ে হিন্দু মুসলমানের মাঝে একটি নাড়ির বন্ধন খুঁজে নিতে উৎসুক ছিলেন। তিনি এও জানতেন যে, এই পাড়াগাঁয়ে বাস করে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না। আফতাবুর রাজার ভাষ্যেÑ আমার বাবা তাঁর জীবনের শেষ ক’টি বছর আমার সাথেই কাটিয়েছিলেন, তাই তাঁর কাছ থেকে তাঁর নিজের অনেক মত ও পথের কথা জানার সুযোগ হয়েছিল। বাবা বলতেন, এই মুহূর্তে ব্রিটিশ রাজত্ব আমাদেরকে পরাধীন করে রেখেছে সত্য, কিন্তু এ কথাও সত্য যে, সারা ভারতকে এক করেও রেখেছে। আল্লাহ জানে এরা এদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আমাদের সারা ভারতের কী অবস্থা হবে।’ এই বয়ান থেকে বুঝা যায় তিনি কার্যত ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন না। যেমন অপরাপর জমিদার-ভূস্বামীরাও ব্রিটিশ-অনুরক্ত ছিলেন, তিনিও তেমন। তবে হাছন রাজার এই ব্রিটিশপ্রীতির পিছনে অখ- ভারতের সত্ত্বা অটুট থাকার একটি আকাক্সক্ষা বিদ্যমান ছিল বলে আমরা বুঝতে পারি। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, ব্রিটিশরা চলে গেলে ভারত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, যা পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু তিনি কেন অখ- ভারত-সত্ত্বায় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন? কী তার বস্তুগত বা ভাবগত তাৎপর্য? এর কোন স্বতঃসিদ্ধ উত্তর নেই। একটি উত্তর হতে পারে এরকমÑ ব্রিটিশ রাজত্বের স্বদেশীয় বিত্তবান-অভিজাত শ্রেণি দেশীয় আমজনতার শাসনের চেয়ে নীলরাজরক্তধারা প্রবাহিত ব্রিটিশ রাজ অধীনে থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। আরেকটি হলোÑ ব্রিটিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার আওতায় ভূস্বামী-জমিদাররা রাজ্যের ভিতরে আরেকটি ছোট আকারের রাজ্যের অধিপতি হওয়ার সুখ পেয়েছিলেন। জমিদারদের ভূমিকা সম্পর্কে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সনে ঘোষণা করেন- ‘… এর ফলে এমন এক বিপুল সংখ্যক ধনী ভূস্বামী শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে যারা ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষভাবে আগ্রহশীল এবং জনগণের উপর যাদের অখ- প্রভুত্ব বজায় আছে।’ [চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক- বদরুদ্দীন উমর, বদরুদ্দীন উমর রচনা সংগ্রহ (২), শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠাÑ৩০]। তৃতীয় আরেকটি কারণ আমরা অনুমান করতে পারি যেটি হাছন রাজার ভাবালুতার সাথে সম্পর্কিত। হাছন রাজা যে মরমী সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন সেখানে তিনি সমগ্র বিশ^ব্রহ্মা-কে একটি অখ- সত্ত্বা রূপে চিন্তা করতেন। অমিয়শঙ্কর চৌধুরী যেমন হাছন-মূল্যায়ন করেছেন এই বলে যে, ‘এইভাবে কবি বহুর মধ্যে আপনাকে আর আপনার মধ্যে বহুকে উপলব্ধি করে, নিজ ক্ষুদ্র আমিত্বকে বৃহত্তর আমিত্বে উত্তীর্ণ করে দিয়ে চিরন্তন রসের লোকে আমাদের হাত ধরে নিয়ে গিয়েছেন।’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৫]। সমগ্রতার মধ্যে মুক্তির যে আকাক্সক্ষা হাছন পোষণ করতেন সেখানে বিচ্ছিন্নতা বা খ-িত হওয়া কাম্য নয়। তাই কি তিনি অখ- ভারত সত্ত্বায় আস্থা রেখেছিলেন? এরও উত্তর হয়ত জানা যাবে অনাগত কালে।
সামারীন দেওয়ান তাঁর গ্রন্থের ওই অধ্যায়ে হাছন রাজাকে সাম্যবাদের মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী বলে প্রমাণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মার্কসের এই ঈর্ষা-বিদ্বেষময় শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্বের খবরটি হাসন রাজার কাছে এসে পৌঁছেছিল কিনা আমরা তা জানি না, তবে তার জীবনচলা পথ থেকে ঐটুকু জানা যায় যে, মার্কসের সাম্যের মূলমন্ত্র তার মনে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হয়েছিল।’ [হাসন রাজা, জীবন ও কর্ম- সামারীন দেওয়ান, মাওলাব্রাদার্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৮৪]। সামারীন দেওয়ানের এই মন্তব্যের মধ্যে আবেগ-বাহুল্য রয়েছে। কারণ মার্কসীয় সাম্যবাদে বিশ্বাস স্থাপনের একটা বস্তুবাদী দর্শন রয়েছে। হাছন রাজা ছিলেন ভাববাদী দর্শনাশ্রিত যা তাঁর রচনাসমগ্রের শব্দে শব্দে উপস্থিত। তিনি মার্কসীয় বস্তুবাদী দর্শনে যে আস্থাশীল ছিলেন না তা বলতে খুব বেশি পর্যালোচনার প্রয়োজন পড়ে না। আস্থাশীল থাকার কোন কারণও নেই কারণ মার্কসের রচিত গ্রন্থাবলী বা মার্কসবাদী দর্শনের আওতায় তৎপরবর্তী রুশ বিপ্লবের কোন খবর হাছন রাজা অব্ধি পৌঁছেছিল কি-না তার কোন তথ্য নেই। না পৌঁছারই কথা। এটা এমন এক তত্ত্ব যা চর্চা, অনুশীলন, আত্মস্থকরণ, বিশ্বাসস্থাপন, শ্রেণিচ্যুতি প্রভৃতি সচেতন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। হাছন-জীবনে এরকম কোন জায়গা ছিল না। তবে সাম্যবাদের অর্থ যদি উদার মানবিকতাবাদ ধরা হয় তবে হাছন রাজার জীবনে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি প্রজাদের প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন বলে বিভিন্ন লেখক তাঁর জীবনের বহু ঘটনা দিয়ে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। স্থানীয়ভাবে এই অঞ্চলের মানুষ হাছন রাজার পরিবারের এমন উদারতা, সহিষ্ণুতা ও মানবতার কথা এখনও স্বীকার করেন। হাছন রাজার গীতি সংগ্রহকারদের অন্যতম আব্দুল হাই হাছন রাজার উদার ও মানবিক দিকটির পরিচয় তোলে ধরেছেন এ-ভাবে যে, ‘অর্থের সঞ্চয় তাঁহার প্রকৃতি বিরুদ্ধ ছিল। হাতের বাড়তি টাকা পয়সা সব সময় তিনি দান খয়রাতে ব্যয় করতেন। দানশীলতায় তিনি ছিলেন অনন্য। টাকা-পয়সা, অন্ন-বস্ত্র ছাড়াও তিনি সময় সময় হাতি-ঘোড়া পর্যন্ত দান করিতেন। অভাবগ্রস্ত ও নিঃসম্বল ভদ্রজনকে তিনি অনেক জমিজমা দান করিয়া গিয়াছেন।’ [হাসন রাজার ‘সৌখিন বাহার’ গ্রন্থ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, আব্দুল হাই, সময়ের স্মৃতিতে বহুমাত্রিক প্রতিভা মুহাম্মদ আব্দুল হাই, ইমানুজ্জামন মহী সম্পিিদত, পৃষ্ঠা-৪০৩]। হাছন রাজার এই উদারতা তাঁর মনের দ্বৈধ ভাবের প্রকাশ। ব্যক্তি মাত্রই নিজ কর্ম দিয়ে কাল নির্বিশেষে একটা অমুছনীয় ছাপ রেখে যেতে চায়। হাছন রাজার জমিদার মনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই মানবদরদী-পশু-পাখি দরদী মনের যে পরিচয় মিলে তাঁর স্মৃতিচারকদের কথায় তার উৎস মানব চেতনার দ্বন্দ্বময় অভিব্যক্তির মাঝে। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘মানুষের সত্তায় দ্বৈধ আছে। বাহ্যজগতের সংস্পর্শে মানুষের চেতনার যে অভিব্যক্তি, তা দ্বন্দ্বময়। যে ব্যক্তি পাষ- বলে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়, তারও অন্তর নির্দ্বন্দ্ব থাকে না। যিনি মহামানবরূপে নন্দিত ও বন্দিত হন, তার চেতনায়ও দ্বন্দ্ব থাকে। প্রতিটি মানবীয় তাড়নাই প্রকৃতপক্ষে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির অন্বয় ও দ্বন্দ্ব।’ [আদর্শের স্বরূপ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, দেশকাল পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২১]। স্বামী বিবেকানন্দ প্রবৃত্তিকে বলেছেন ‘সেই দিকে আবর্তিত হওয়া’, সেই দিক হলÑ সংসার। আর নিবৃত্তি হলÑসেদিক হতে নিবৃত্ত হওয়া। তিনি বলেছেন, ‘এই প্রবৃত্তির প্রকৃতি সব কিছু আঁকড়াইয়া ধরা। সর্বদাই সব জিনিস এই ‘আমি’-রূপ কেন্দ্রে জড়ো করা। ইহাই প্রবৃত্তিÑ ইহাই মনুষ্যমাত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা, চারিদিক হইতে যাহা কিছু সব গ্রহণ করা এবং এক কেন্দ্রের চারিদিকে জড়ো করা। সেই কেন্দ্রে তাহার নিজের মধুর ‘আমি’। যখন এই প্রবণতা ভাঙিতে থাকে, যখন নিবৃত্তি বা ‘সেইদিক হইতে চলিয়া যাওয়ার ভাব’ আসে, তখনই নীতি এবং ধর্ম আরম্ভ হয়। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি উভয়ই কর্ম। প্রথমটি অসৎ কর্ম, দ্বিতীয়টি সৎ কর্ম। এই নিবৃত্তিই সকল নীতি এবং ধর্মের মূল ভিত্তি।’[স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, প্রথম খ-, পিডিএফ পৃষ্ঠা-১৩৯, যঃঃঢ়ং//নহ.স.রিশরংড়ঁৎপব.ড়ৎম/রিশর/] । হাছন রাজা প্রতিনিয়ত মনের দ্বৈত ভাব অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন, সেখানে তাঁর নিবৃত্তির প্রাবাল্য ছিল বলেই তিনি প্রজাপীড়ক জমিদারের চেহারা পালটিয়ে প্রজা-বান্ধব চেহারা ফুটিয়ে তোলতে পেরেছিলেন এবং তাঁর এই নিবৃত্তিতে ফিরে আসার প্রধান জায়গা হলÑ সঙ্গীত। যেখানে তিনি অকপটে বলতে পারেনÑ ‘এই যে দেখ আশয় বিষয়, করিতেছ বাহাদুরী।/সব ছাড়ি যাইবায় হাছন রাজা একাশ^রীরে ॥/ আবাল কাল গেল খেলে, যৌবন গেল মেলে।/ বৃদ্ধ কাল সাক্ষাৎ এবে রহিলে বেভুলে ॥/ ছাড় ছাড় হাছন রাজা, এই ভবের আশ।/ একমনে চিন্তা করিয়ে হও তাঁর দাস ॥’। প্রথম জীবনের বিষয়ী প্রবৃত্তিতে অনুতপ্ত হয়ে এই নিবৃত্তির প্রতি চরম আসক্তিই ছিল পরিণত হাছন-মন। একে কোন বস্তুবাদী দর্শন দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
ব্যাখা করা সম্ভব নয় এ কারণে যে, ‘যে- জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য এবং যে- জীবন জন্ম ও মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ, সেই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে উৎকণ্ঠাকেই বলা যায় ইহজাগতিকতা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এ এক সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরলোক ও পরকাল সম্পর্কে কিংবা অতিপ্রাকৃত ও আত্মা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা প্রশ্রয় পায় না। পৃথিবী ক্ষুদ্র আর বিপুলা হোক, জীবন পদ্মপত্রে নীর হোক আর জীবকোষের সমাহার হোক, এই পৃথিবীতে সুখদুঃখ-বিরহমিলন-পরিপূর্ণ মানবজীবনের সাধনাই ইহজাগতিকতার মূল কথা।’ (ইহজাগতিকতা, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইহজাগতিকতার সংকট ও আনিসুজ্জামান, রাজীব সরকার, দৈনিক প্রথম আলো ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। আগের অনুচ্ছেদসমূহে কথিত মানব চেতনার দ্বৈধ কিংবা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যে নীতিশাস্ত্র, ইহজাগতিকতার নীতিশাস্ত্র এরচাইতে ভিন্নতর। কিন্তু তাই বলে কি ব্যক্তির কর্ম ও চিন্তা-চেতনা কখনও বস্তু নিরপেক্ষ বা ইহজাগতিকতার প্রভাবমুক্ত থাকা আদৌ সম্ভব? সময়, স্থান, পরিবেশ ও ব্যবস্থার ভিতর যে ব্যক্তির বসবাস তিনি কীভাবে এ-সবের অস্তিত্ব অস্বীকার করবেন? যতই কেউ ইহজাগতিকতা থেকে মুক্ত থাকার আকুলতায় ব্যাকুল হোন না কেন তিনি চলমান বাস্তবতার মধ্যে থেকেই এই সাধনায় নিরত থাকেন। সুতরাং সমকালীন সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতগুলোকে উপেক্ষা করে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আর হাছন রাজার মত সংসারী মানুষের দ্বারা তো এ একেবারেই অসম্ভব। তিনি সমাজে বাস করে এর অসংগতিগুলো দেখেছেন। তিনি দেখেছেন মূর্খতা ও ভ-ামির উপস্থিতি। সুতরাং তাঁর চিন্তা-চেতনাকে যে তা ব্যাপকভাবে নাড়া দিবে তা স্বাভাবিক। তিনি যখন বলেনÑ ‘আমি করি মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না।/কিরা দেই কছম দেই আমার বই হাতে নিবে না’ তখন আমরা বুঝতে পারি সমাজের সেই অন্ধকার জায়গায় তিনি আঘাত হেনেেেছন যেখানে সত্য সুন্দর ও ভালবাসাকে অন্ধতা দিয়ে আঁধার কালো করে রাখা হয়। তিনি যখন গেয়ে উঠেনÑ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন।/সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলায় মূলধন ॥/আর দৈ বলিয়া চুন গুলিয়া খাইল কতকজন।’ তখন নিজের আক্ষেপ যন্ত্রণা ও বেপথু চলাফেরার ইহজাগতিক আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্রন্দন-কাতরতা সহজেই বুঝা যায়। হাছন যখন আবার গলা ছাড়েন এই বলে, ‘নিশা লাগিলরে বাঁকা দুই নয়নে,/নিশা লাগিলরে,/হাছন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে।/ ছটফট করে হাছন দেখিয়া চান্দ মুখ,/ হাছন জানের মুখ দেখি জনমের গেল দুঃখ।’ তখন এই বাণীর মধ্য দিয়ে ইহজাগতিক মানবমনের চিরন্তন কামনা-বাসনার দিকটি ফুটে উঠে। সংসার জীবনের পিছুটান মানুষের নিবৃত্তির দিকে যাত্রার জন্য অন্তরায়, এও হাছন রাজা বুঝেছিলেন জাগতিক অভিজ্ঞতা দিয়েই। তাই তিনি গানের বাণীতে বলেছেনÑ‘হাছন রাজায় বলে ও আল্লা ঠেকাইলায় ভবের জঞ্জালে।/বেবুলে মজাইলায় মোরে এই ভবের খেলে ॥/বন্ধের সনে প্রেম করিবার বড় ছিল আশা।/ভবের জঞ্জালে ফেলে করিলে দুর্দশা ॥/স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ী পুত্র হইল খিল।/কেমনে করিবায় হাছন বন্ধের সনে মিল ॥’
হাছন রাজা একেবারে মাটির ভাষায় গান রচনা করেছেন। তিনি জীবনও কাটিয়েছেন অতিসাধারণভাবে। ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাজার’ বলে যে সাধক হাছন জাগতিক মোহ থেকে মুক্তি লাভের সাধনায় ব্যাপৃত হয়েছিলেন তিনি সত্যিকার অর্থেই গ্রামীণ পরিবেশের এক সাধারণ ঘরে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় তিনি অনায়াসে কলকাতায় থাকতে পারতেন যেমন থেকেছেন আরও কত পূর্ববঙ্গীয় জমিদার-ভূস্বামীরা। তিনি তা করেন নি। নিদেনপক্ষে লক্ষ্মণশ্রীতে তিনি প্রাচীন জমিদারি কায়দার সুরম্য ভবনাদি নির্মাণ করে ঠাঁটবাট দেখানোর চেষ্টা করতে পারতেন। তাও করেন নি। মাটির কাছাকাছি থাকার এই মনন তার বৈরাগ্যসাধনার ফল। অন্যদিকে সহজ-সরল জীবন যাপনের এই বোধ তাঁর ভারতীয় প্রাচীন দর্শন-উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত। এখানে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল। এই ঢেউয়ের ফেনিল উচ্ছা¦াস থেকে তৈরি হয় সাহিত্যের নানা উপকরণ। কি হিন্দু কি মুসলামনÑ উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ই এই ভক্তি আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন নিজেদের সর্বমানবিক বিশ^াস দিয়ে। সুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘ব্রাত্য, মন্ত্র বর্জিত লালন ফকির’ প্রবন্ধে এমন কথাই বলেছেনÑ‘আমাদের সমাজে নিজেদেরই একটা অন্তর্শ্চেতনাময় উৎস আছে, মুক্ত ভাবনার জানালা আছে, মানবিক বিশ^াসের ভিত আছে। তার অনুসন্ধান পাওয়া যায় লোক ধর্মে, হিন্দু মুসলমানের সমন্বিত লোক জীবনে, আউল-বাউল-দরবেশ-কর্তাভজা-সাহেব ধনীদের ক্রিয়া করণে।’ [হাছন রাজার সঙ্গীতমালা-অমিয়শঙ্কর চৌধুরী, পৃষ্ঠা-৩৭]। নিশ্চিতভাবেই আমাদের সমাজে প্রবহমান ওই লোকায়ত ধারাটিই হাছন রাজাকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর গানে একেবারেই সহজ কথা, নিতান্তই লক্ষ্মণশ্রীর মানুষের মুখে ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দাবলী বিশেষ অর্থদ্যোতকতা নিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি কঠিন শব্দ দিয়ে জটিল তত্ত্ব প্রচারের দিকে ধাবিত হন নি। বরং জটিল তত্ত্বকে সহজ কথায় ধরতে চেয়েছেন। তিনি যখন বলেনÑ ‘আরে ও মন নায়ের মাঝি, কি হইয়াছে তুমার আজি,/অরে মন নায়ের মাঝি।/ ঠিক করিয়া হাইল ধর না, দাড়ি মাল্লা কেও নয় রাজি।/নায়ের মাঝি হইয়া তুমি, কর বাজীগরের বাজী ॥/ এর লাগিয়া তেক্ত হইয়া, রইছে তুমার বাবাজী।/ছাড় ছাড় চক্কর মক্কর, মনরে দুরাচার পাপী।’ তখন এর ভাব ও রস আস্বাদনে গ্রামের নিরক্ষর কৃষক কিংবা জেলে কারোরই কোন অসুবিধা হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবকে তিনি পুষিয়ে নিয়েছিলেন লোকায়ত শিক্ষা, অভীক্ষা, মনোশ্চেতনা ও সরল জীবন দর্শন দিয়ে। তার গানের এই সহজ সরল ভাবটি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেঁড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এই ভাব-প্রকাশ-বৈশিষ্ট্যের সরলতার কারণেই তাঁর গান আজও মানুষের রস-তৃষ্ণা মেটাতে সহায়ক হয়। নিজেকে ইহজাগতিকতার দুনিয়ায় তিনি এভাবে অমর করে রেখেছেন।
হাছন রাজা বস্তুতপক্ষে নিজের কাব্যসাধনায় কখনও জাগতিক বিষয়-বৃত্তিকে সামনে নিয়ে আসেন নি। তিনি সমকালীন সামাজিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধেও অবস্থান গ্রহণ করেন নি নিজের শ্রেণিগত আভিজাত্যের সীমাবদ্ধতার কারণে। তিনি সেইভাবে সমাজের ভিতরকার দারিদ্র্যতা, জীবন সংগ্রাম, শোষণ-শাসনের বিভৎস চেহারা দেখেন নি। তিনি সে-রকম চেষ্টা করেছেন বলেও জানা যায় না। বরং ব্যক্তিজীবনে তার বৈষয়িক সফলতা অর্জনের কীর্তি সুবিদিত। তার সম্পর্কে যে গুটিকয় লিখা রয়েছে সেখানে তাঁর জমিদার জীবনের অতি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের কিছু দিক উঠে এসেছে বলে আমরা দেখতে পাই। এরকম কয়েকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ক. তাঁর অল্প বয়সে জামিদারির দায়িত্ব গ্রহণ সম্পর্কে আবু সাঈদ জুবেরী লিখেছেন, ‘কিন্তু সবার ধারণা পাল্টে দিলেন তিনি। কাজ করতে লাগলেন পাগলের মত। প্রমাণ করে ছাড়লেন, আনাড়ি হাতও শ্রম ও সাধনায় কর্মঠ মানুষের সমান যোগ্য হতে পারে। রাজ্যের এলোমেলো অবস্থাকে গুছিয়ে ফেললেন কয়েকদিনের মধ্যেই। জায়গা জমির পরিমাণ আরো বাড়ালেন। জমিদারির আয়ের প্রতি ভীষণ কড়া-নজর দিলেন, তাতে খুব কাজও হতে লাগলো, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাজ্যের আয় বেড়ে হলো প্রায় দ্বিগুণ।’[হাসন রাজা, আবু সাঈদ জুবেরী, প্রসঙ্গ হাসন রাজা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৮০]। খ. ‘এ সম্বন্ধে আমি তাঁর জীবনী আলোচনা করে যা জানতে পেরেছিÑতিনি যৌবনে অত্যন্ত বিলাসী ছিলেন। জমিদার হিসাবে তিনি অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর ছিলেন। তবে জীবনের সূচনা থেকেই তিনি অত্যন্ত দানশীল প্রকৃতির লোক ছিলেন।’ দেওয়ান হাসন রাজা, অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, প্রসঙ্গ হাসন রাজা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৪১]। গ. ‘কিন্তু নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে সম্মান বজায় রেখে তিনি জমিদারি রক্ষা করেছিলেন। জমিদারি খুব একটা বাড়াতে না পারলেও, হাছনরাজা সুপরিচালনার দ্বারা যেটুকু সম্পত্তি ছিল সেটুকু ভালভাবে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছিলেন এবং তিনি এ বিষয়ে অনেকটা সফলও হয়েছিলেন।’ [অমিয়শঙ্কর চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩]। ঘ. ‘বর্ষার সময় সুনামগঞ্জ বাজারের রাস্তা অত্যন্ত কর্দমাক্ত হতো। হাসন রাজা অনেক সময় লোকের কাঁধে চড়ে বাজারে ভ্রমণ করতেন। একজন শক্তিশালী যুবকের কাঁধের দুই দিকে পা ছড়িয়ে বসতেন ও দুইদিকে দুইজন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে চলতেন।’ [আমাদের কালের কথা, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৪৩]। হাছন রাজার বংশধর সামারীন দেওয়ান অবশ্য তাঁর বৈষয়িক প্রবৃত্তির বিষয়টি যেমন অস্বীকার করেছেন তেমনি তাঁর সম্পর্কে কথিত নিষ্ঠুর ও বিলাসী চরিত্রকে উদার, দানশীল, সর্বমানবিক বৈশিষ্ট্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি নিজের ‘হাসন রাজা, জীবন ও কর্ম’ বইয়ে বংশস্থ বহু জনের মতামত, ঘটনা ও বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এই বিষয়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে চৌধুরী মুফাদ আহমদ বেশ আগেই লিখেছিলেন, ‘যে কারও জীবন আলোচনায় তাকে সর্বদোষমুক্ত করে দেবতায় পর্যায়ে ফেলার চেষ্টা করলে সে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য লুপ্ত হয়ে যায় এবং তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে না।’ [মরমী কবি হাসন রাজা, চৌধুরী মুফাদ আহমদ, প্রসঙ্গ হাসন রাজা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৩৮]। মূলত ব্যক্তির আলোচনায় এসব উপাদান যা অনেকক্ষেত্রে স্ববিরোধী মনে হতে পারে, মনে হতে পারে পরিবেশিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অগ্রহণীয়, এর সবগুলো বিবেচনায় নিয়েই ব্যক্তির স্বরূপ নির্ধারণের কাজটি করে থাকেন ইতিহাসবিদরা। তবে সহায়ক হত যদি হাছন রাজার গান রচনার কালানুক্রমিক বর্ণনা পাওয়া যেত তাহলে তার মনন পরিক্রমণের যাত্রাপথটি বুঝা সহজ হত। আমাদের দুর্ভাগ্য বা লোকসাহিত্যের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অনুসারে সে-রকম সুযোগ নেই। হাছন গবেষকদের কেউও এ বিষয়ে আলোকপাত করেন নি। একটিই তথ্য পাওয়া যায় হাছন উদাস, যেটি হাছন রাজার প্রথম গীত-সংকলন, সেটি হাছন রাজার জীবিতাবস্থায়ই প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও এর কোন কপি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তবে ধারণা করা যায় তাঁর মরমী ভাবানুকূল গানগুলো পরিণত বয়সে লেখা, যেখানে তাঁর প্রথম জীবনের ভোগবাদিতার জন্য প্রচ- আক্ষেপাকুতি বিদ্যমান। গানের চরণে তাঁর আক্ষেপের প্রকাশ এরকমÑ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম।/ না কইলাম তার কাম।/ বৃথা কাজে হাছন রাজায় দিন গুয়াইলাম ॥/ ভবের কাজে মত্ত হইয়া দিন গেল গইয়া।/ আপন কার্য্য না করিলাম রহিলাম ভুলিয়া।’ গানের এই চরণগুলো স্পষ্টই তার প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত্তিতে ফেরার সময়ে রচিত। সঙ্গীতের রসিক ছিলেন প্রথম জীবন থেকেই তিনি, একথা জানা যায় তাঁর সম্পর্কে লিখিত বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে। এই সঙ্গীতরসিকজন নিশ্চয়ই যৌবনেও গান রচনা করেছেন। সেগুলো হয়ত তাঁর মানবীর প্রতি মানবের ভালবাসার উচ্ছ্বলতা-ব্যাকুলতামুখর পদরচনা। অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, এই নিবন্ধকার হাছন রাজার গানের আদি রূপ নিশ্চিত হতে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছেন। হাছন উদাসের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবিতাবস্থায় (সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে)। তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী হাছন উদাসের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে (১৯২৬-১৯২৭ খ্রিস্টিয় সন)। অমিয়শঙ্কর চৌধুরী ‘হাছন রাজার সঙ্গীতমালা’ গ্রন্থে হাছন রাজার ৩৪৫ টি গান সংকলিত করেছেন। শ্রী অমিয়শঙ্কর গ্রন্থের ২২৩ থেকে ২৩৭ পৃষ্ঠায় হাছন উদাসের প্রথম সংস্করণ ও দ্বিতীয় সংস্করণে মুদ্রিত গানগুলোর বর্ণনাক্রমিক সূচি পরিবেশন করেছেন। অনেকগুলো গানের ক্ষেত্রে তিনি প্রথম সংস্করণ ও দ্বিতীয় সংস্করণের বাণী পাশাপাশি পরিবেশন করেছেন। সেখানে আমরা দেখতে পাই প্রথম সংস্করণ ও দ্বিতীয় সংস্করণের একই গানের মধ্যে শব্দগত ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে। পর্যবেক্ষণে মনে হয়, দ্বিতীয় সংস্করণে কোন কোন গানের কিছু শব্দকে পরিমার্জন করে ‘শুদ্ধ’ করার সচেতন প্রয়াস কাজ করেছিল। এতে করে হাছন রাজার গানে আদি ও অকৃত্রিম শব্দ-সঞ্চারিত আঞ্চলিক উচ্চারণ রীতির ফলে যে ব্যঞ্জনা তৈরি হয় তা কিছুটা ক্ষুণœ হয় কি-না সেই প্রশ্ন এসে যায়। লৌকিক গানের ক্ষেত্রে গলা বদল হতে হতে এর লিপ্যান্তর বা শব্দ, বাক্য পরিবর্তন হওয়ার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকত্ব নেই। কিন্তু গীতিকার জীবিতকালে যে রীতিতে গান সংকলিত করেছেন তার পরিবর্তন কাম্য কি-না তার উত্তর সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা দিতে পারবেন। হাছন রাজার গানের বাণী পরিবর্তনের এই ধারা এখনও প্রবহমান। শিল্পী বিশেষ নিজের ইচ্ছামত হাছন রাজার গানের শব্দ বা বাক্য পরিবর্তন করে নিজের মত গীত করার প্রবণতাও রয়েছে। বিষয়টি হাছন-গবেষক আব্দুল হাইকেও উদ্বিগ্ন করে তোলেছিল। পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ফলে হাছন রাজার গানের মূল আবেদন ও ভাব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করে তিনি বলেছিলেন, ‘কবির দেহধারণের দু’বছর পরে মুদ্রিত ‘হাসন উদাসে’র অনেক গানেই আজ মূল পান্ডুলিপি সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এখানে সেখানে বিলক্ষণ গরমিল ধরা পড়ে। এ ধরনের গানগুলোকে ‘সংশোধিত গান’ বলা চলে।’ [হাসন রাজার গান ঃ শুদ্ধাশুদ্ধি প্রসঙ্গে হাছন পছন্দ, সময়ের স্মৃতিতে বহুমাত্রিক প্রতিভা আব্দুল হাই, ইমানুজ্জামান মহী সম্পাদিত, পৃষ্ঠা-৪০৫]। এই পরিবর্তনের ফলাফল কী হতে পারে সে-সম্পর্কে হাছন পছন্দের ( আব্দুল হাই সাহেবই হাছন পছন্দ ছদ্মনামে লিখতেন-নিবন্ধকার) অভিমত ছিলÑকোন কোন স্থানে মূল লেখার উপরে সম্পাদনার কাজ চলায় মরমী কবির বক্তব্যের অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও তাঁর চিন্তা-ভাবনা-দর্শন সম্পূর্ণ ওলটপালট হয়ে গেছে।’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪০৫]। যাহোক প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে কিছু কথা বলা হয়ে গেল। এ বিষয়ে আর কোন কথা বাড়াতে চাই না।
হাছন রাজার গানে প্রান্তজনের দন্দ্বের নিরসনমূলক ভাবপ্রসঙ্গ কিছু আশা করা সমীচীন নয়। কেন নয় সেটি উপরের বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হয়েছে। হাছন রাজার গানে কালের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা যায়নি। আর্তের হাহাকার তাঁকে ভাবাতে পারেনি। তবে একথা সত্য যে, হাছন রাজা নিজেকে প্রথম জীবনের ভোগবাদী জায়গা থেকে সৃষ্টিকর্তামুখীতায় পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন। তিনি অনিত্য জীবনকে নিত্যানন্দে রূপান্তরের সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি দারুণভাবে সফল একজন ব্যক্তি। ভোগ ও কামনা-বিলাসের জায়গা থেকে তিনি নিজেকে ত্যাগের সাধনায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। নিজের জীবনের এই উত্তরণকে আমরা তাঁর প্রবৃত্তি সত্ত্বার সাথে নিবৃত্তি সত্ত্বার অহির্নিশি দ্বন্দ্বময় ঘাত প্রতিঘাতের পর অবশেষে নিবৃত্তির জয়লাভ রূপে চিত্রিত করতে পারি। জীবনের এই বাঁকবদলের তাৎপর্যময় অভিক্ষেপণ, তাঁর কাব্য সাধনার বিচার ঠিক এই জায়গায়ই স্থির থাকবে।
তাঁর মৃত্যুর ১ শ’ বছর পর আজ তাঁর গান হাওরবাসীর হৃদয় ছাপিয়ে বিশ্ব-বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর গানের কথা সমস্ত বাঙালি মনে এক ধরনের প্রশান্তি বয়ে আনে। তাঁর এই অনবদ্য সঙ্গীতসম্ভার বাঙালির ভাবজগতের একান্ত সঙ্গী হতে পেরেছে। তাঁর গানের সুরেলা শব্দ ঝংকার এখনও কিছু মানুষের আনন্দের-শান্তির-আবেগের-বিরাগের সঙ্গী হয়। তাঁর সৃষ্টি কালোত্তীর্ণ হয়ে সকলকে আজও আনন্দে অথবা ভাবে, ভালবাসার ব্যাকুলতায়, সৃষ্টিকর্তার সাথে মিলিত হওয়ার বাসনায় আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ ও নানা বৈষম্যে পীড়িত বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় তাঁর গান এখনও মিলন ও সমন্বয়ের দিকে মানুষকে টানে। আমাদের অনুমানে এইটুকুই হাছন রাজাঁর কর্ম ও জীবনের ইহজাগতিক অর্জন।
লেখক: কবি ও গল্পকার।
- প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই গলা কেটে হত্যা করা হয় শ্যামাচরণকে
- জগন্নাথপুরে নৌকার সমর্থনে যুবলীগের প্রচার মিছিল