বিশ্বজিৎ রায়, হালি, শনি ও মহালিয়া থেকে ফিরে
জামালগঞ্জে মন্থর গতিতে এগুচ্ছে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও হাওরের অনেক বাঁধে এখনও পড়েনি এক ছটাক মাটি। যে কয়টিতে মাটি ফেলা শুরু হয়েছে তাতেও তেমন সন্তোষজনক অগ্রগতি নেই। মাটি ফেলায় মানা হচ্ছে না কোন নিয়মনীতি। বৃহস্পতিবার হালি, শনি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে এমন বাস্তবতা চোখে পড়েছে। তবে পাগনার হাওরে কাজের গতি কিছুটা ভালো দেখা গেছে।
হাওররক্ষা বাঁধের কাজে প্রকল্প বরাদ্দে অনিয়মের পাশাপাশি স্বজনপ্রীতির অভিযোগও আছে। বেশ চতুরতার সাথে এই উপজেলায় পিআইসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বাঁধের কাজে যুক্ত করা লোকের ঠিকানা। পিআইসি তালিকায় নামকাওয়াস্তে কৃষকের নাম থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাঁধের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
কৃষকের নাম করে হাওর থেকে দূরবর্তী স্থানের বাসিন্দা, অকৃষক এবং গেল ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া লোকদেরকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে বাঁধ রক্ষা কাজে। এই নিয়ে হাওরপাড়ে অসন্তোষও আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৃষকের বদলে বাঁধের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজনীতিক, সদ্য ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধি এবং হাওর থেকে অনেক দূরের অন্য পেশার লোকেরা। জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নে অবস্থিত হালির হাওরের ৯ নম্বর পিআইসির সভাপতি করা হয়েছে ফেনারবাঁক ইউনিয়নের শেষ সীমানায় অবস্থিত নিধিরপুর গ্রামের রেন্টু সরকারকে। এছাড়া এ প্রকল্পে রাখা হয়েছে একেক ইউনিয়নের একেক এলাকার একেকজনকে। মহালিয়ার ৪টি পিআইসিতে যদিও কাগজে কলমে হাওরপাড়ের কৃষকের নাম রয়েছে তবে ২টিতে সদ্য বিজয়ী এক জনপ্রতিনিধি ও অপর ২টিতে আছে হাওর থেকে দূরবর্তী স্থানের এক মধ্যস্বত্বভোগীর নাম। শনির হাওরেও প্রায় একই অবস্থা। অনেক পিআইসিতেই কৃষকের নাম করে সুযোগ নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আ.লীগ নেতা সহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠজনেরা বলে জানা গেছে।
হাওর ঘুরে দেখা যায়, গত বর্ষা মৌসুম অনেকটা শুষ্ক থাকায় শনির হাওরের বিপজ্জনক ক্লোজার হিসেবে পরিচিত লালুরগোয়ালা, হালি হাওরের সুন্দরপুর কালীবাড়ি ক্লোজার, মামুদপুরের ভাঙ্গা, ঘনিয়ার বিলের ভাঙ্গাসহ ছোটখাটো যেসব ক্লোজার ছিল প্রায় সবগুলোতে বেশির ভাগ মাটি অক্ষত আছে। এসব ক্লোজার ছাড়াও বেশকিছু বাঁধে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মাটি রয়ে গেছে। তারপরও সবকিছু মিলে বরাদ্দ এসেছে গত বছরের সমান। তবে মদনাকান্দি গ্রামের বিপরীতে মহালিয়া হাওরের নদীর তীরবর্তী অংশে একটি বিপজ্জনক ক্লোজারের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ঘনিয়ার বিলের বিপরীত পাড়ে শনির হাওর অংশে আরেকটি বড় ভাঙ্গন রয়েছে। এ দুটো ভাঙ্গনই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এই দুটি ক্লোজারেও কাজের গতি নাজুক।
জানা যায়, গেল মৌসুমে উপজেলার ৬ টি হাওরের ৪৪ টি পিআইসিতে বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৯১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। সেই বছর উপর্যুপরী বন্যায় বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরে কমেছে ৮টি পিআইসি। এবার ৩৬টি পিআইসিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। গেল বর্ষা মৌসুমে হাওরে তেমন পানি ছিল না, তবু বরাদ্দ এসেছে গত বছরের সমান। মনগড়া প্রাক্কলন করে এমন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন হাওড়পারের সচেতন মানুষেরা।
অপরদিকে, হাওর ঘুরে বাঁধ রক্ষা কাজ ৩০ ভাগও এগিয়েছে বলে মনে হয় নি। এর মাঝে কেটে গেছে নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় মাস। হালির হাওরের বদরপুর অংশ, মামুদপুরের ভাঙ্গা থেকে দুর্গাপুর অংশ, মদনাকান্দি পশ্চিমের একটি অংশ, হরিপুর থেকে আছানপুর ও হরিপুর থেকে সুন্দরপুরের ২টি অংশ, কালিবাড়ি থেকে উলুকান্দির মাঝ বরাবর ২টি অংশ এবং শনির হাওরের ৪টি পিআইসির মধ্যে ২টি ও মহালিয়ার ৪টির মধ্যে ১টি পিআইসিতে কেবল মাটি ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। অন্যসব বাঁধে কাজ শুরুর কোন আলামত চোখে পড়ে নি।
মাটি ফেলা শুরু হয়েছে এমন কয়টি বাঁধে নির্দেশিকা বোর্ড সাঁটানো থাকলেও বাকি কোন বাঁধে কাজ দূরের কথা নির্দেশিকা বোর্ড পর্যন্ত সাঁটানো হয়নি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে হাওরপাড়ের মানুষ।
২০১৭ সালের প্রলয়ঙ্করী হাওর বিপর্যয়ের পর টানা চার বছর প্রকৃতি অনুকূলে ছিল, যদি এই বছর প্রকৃতি বেঁকে বসে তাহলে হাওরে আবার বিপর্যয় নেমে আসবে। এজন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন হাওরপাড়ের বাসিন্দারা।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের ফেনারবাঁক ইউনিয়ন সভাপতি মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, এই বছর বরাদ্দ বেশিই মনে হচ্ছে। গত বর্ষায় তো তেমন পানি হয়নি, বাঁধও ভাঙ্গেনি। তারপরও বরাদ্দ গত বছরের সমান। এখন দেখা যাক কাজ কতটুকু হয়।
পিআইসি কাজে অভিজ্ঞতা রাখেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত দুই বছর আগে মাহমুদপুরের ভাঙ্গা থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৭ লাখ টাকা। কিন্তু এবার একই বাঁধে মাটি থাকার পরও বরাদ্দ এসেছে ১৫ লাখ টাকা। এভাবে কোথাও বরাদ্দ বেড়েছে কোথাও বরাদ্দ গত বছরের সমান থেকেছে।
হালির হাওরপাড়ের কৃষক রফিকুল ইসলাম তালুকদার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, প্রকৃত কৃষক যারা, কাজে অভিজ্ঞ যারা, তারা কাজ পায় না।
বেহেলী ইউনিয়নের নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত সামন্ত সরকার বলেন, আমাদের পুরো ইউনিয়নটাই হাওরবেষ্টিত। এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকাও হাওরের উপর নির্ভরশীল। ২০১৭ সালের পর গত কয়েক বছর ফলনও ভালো হয়েছে, প্রকৃতিও সুবিধা দিয়েছে। এবার প্রকৃতি বৈরি আচরণ করতে পারে। এটা মাথায় রেখে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি বিশ্বজিত দেব বলেন, বাঁধের একটি পয়েন্টে কাজ শুরু হলে এই অংশের পুরোটাই ধরে নেওয়া হয়। সে মোতাবেক ৩৬টি পিআইসির মধ্যে ২টি ছাড়া বাকি সবগুলোতেই কাজ শুরু হয়েছে। বরাদ্দের যে ব্যাপারটা সেটা প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়েছে। বরাদ্দ বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের শেষ মাথায় যে প্রকল্পটি আছে সেটি সব শেষে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কাছের কেউ এগিয়ে আসে নি বিধায় একটু দূর থেকে পিআইসি করা হয়েছে। তবে হালির হাওরে তার জমি আছে। তিনি জানালেন, কোথাও অনিয়ম করার সুযোগ নেই। কাজও সময়মতই শেষ করতে হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, জেলার ১১ উপজেলায় হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য গত বছর বরাদ্দ ছিল ১৩৯ কোটি টাকা। এবার বরাদ্দ ১২০ কোটি টাকা। মাটি কাটার খরচ ১০ শতাংশ হারে এবার বেড়েছে, তাহলে বরাদ্দ বেড়েছে বলা যাবে না। পানি কম হলেই বাঁধ ভাঙবে সেই ধারণাও সকল ক্ষেত্রে ঠিক নয়, বাঁধ কেটে দেওয়া হয়, ঢেউয়ে ভাঙে, নানা কারণেই বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রক্কলন তৈরির সময় একাধিকবার যাচাই করে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। জামালগঞ্জে হালি, শনি ও মহালিয়াতে দ্রুত কাজ করার জন্য তাগিদ দেব আমরা। পিআইসি তালিকায় গ্রামের নাম দেওয়া না হয়ে থাকলে, সেটি যুক্ত করে দেওয়া হবে।