এই পথচলা যেন শেষ না হয়

আমাদের প্রিয় জেলা সুনামগঞ্জ যখন ইতিহাসের সবচাইতে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে দিশেহারা তখন দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর নিয়মিত প্রকাশনার ১০ বছর অতিক্রম করে ১১ বছরে শুভ পদার্পন করল আজ। জেলাবাসীর অংশ হিসাবে আজ আমাদের মনে আনন্দ নেই, আছে কেবল সর্বস্ব হারানোর সর্বগ্রাসী বেদনা। বৈশাখে আকষ্মিক ঢলে বোরো ফসল হানি এবং আষাঢ়ে ভয়ংকর বন্যায় বসতঘর, ঘরগেরস্থালীসামগ্রী ডুবার এক ধ্বংসযজ্ঞ পেরিয়ে মানুষ আজ একেবারেই দিশেহারা। মানুষ এই মহাক্ষতি কত দিনে কত বছরে সামলে উঠতে পারবে আমরা জানি না। এরকম সময়ে বর্ষপূর্তির সবধরনের আয়োজন আমরা পরিত্যাগ করেছি। সামনে যখন সুদিন আসবে, মানুষ হাসবে, জীবন হবে সুখময়; সেদিন আমরাও আয়োজনের পসরা নিয়ে নিজেরা রঙিন হব, রঙিন করব পাঠকদের। হিসাবের একাদশ বর্ষ-প্রারম্ভে আমাদের সম্মানিত পাঠক সমাজ, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতাসহ সকলকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা।
২০১২ সনের ২০ মে তারিখ থেকে যখন আইন নির্ধারিত সময়সীমার ভিতরে আমরা পত্রিকার পরীক্ষামূলক অনিয়মিত সংখ্যাগুলো প্রকাশ শুরু করি, এরও মাস ছয়েক আগে থেকে যখন আমরা নিয়মিত প্রকাশনার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করছিলাম দিন-রাত পরিশ্রম করে, এরপর যখন ২০১১ সনের ৩০ জুলাই নিয়মিত প্রকাশনার শপথ নিয়ে যাত্রা শুরু করি; তখন থেকেই মনে-প্রাণে যে সৃষ্টির আনন্দ অনুভব করছিলাম আজও তা অব্যাহত আছে। এই আনন্দটুকুই আমাদের প্রধান পুঁজি। এই পুঁজি নিয়েই পথ চলা অবিরাম, অবিরত।
গত ক’বছর ধরে করোনার প্রকোপ, চলতি বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় উর্ধ্বগতির অভিঘাত পত্রিকা প্রকাশনাকেও কঠিন করে ফেলেছে। কাগজসহ প্রতিটি মুদ্রণসামগ্রীর অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির সাথে বিজ্ঞাপনস্বল্পতা আমাদের প্রতিদিন চোখ রাঙিয়ে চলেছে। অসীম ধৈর্য, অটুট মনোবল আর পাঠক আস্থাকে সম্বল করে এখন পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশনা বজায় রেখেছি। ভবিষ্যতে এই চেষ্টাই করে যাব। আমরা শুধু আপনাদের সমর্থন চাই।
যেকোনো দৈনিক পত্রিকার ১০ বছর পথ চলা সহজ কোনো ব্যাপার নয়, বিশেষ করে সুনামগঞ্জের মতো প্রান্তিক জেলায়। আমরা যখন পত্রিকা প্রকাশ শুরু করি তখন এই জেলায় কোনো দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশনার ইতিহাস ছিল না। বস্তুত ওই দৈনিক পত্রিকাহীন জেলায় একটি দৈনিক নিয়মিত প্রকাশনার দুরুহ কাজটি আমাদের শুরু করতে হয়েছে এবং আজ যখন আমরা ১০ বছর অতিক্রম করছি তখন জেলায় বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। এই জায়গায় আমাদের আত্মতৃপ্তি, সাহস করে যে কাজটি আমরা শুরু করেছিলাম পরবর্তীতে সেখান থেকে আরও অনেকে সাহসী হওয়ার রসদ খুঁজে নিয়েছেন। একটি নতুন পথ তৈরি করার যে তৃপ্তি সেটুকু নিয়ে আমরা আরও বহুদূর যেতে চাই।
মফস্বলের একটি জেলা শহর থেকে পত্রিকা প্রকাশের ঝঞ্ঝাট অনেক বেশি। বিশেষ করে সংবাদ প্রকাশের কারণে নানাজনের ভ্রুকুটি সহ্য করার অভিজ্ঞতা এই দশ বছরে আমাদের কম অর্জন হয়নি। সকলেই চান পত্রিকাটি কেবল তাদের পক্ষেই কথা বলুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একটি ঘটনাকে নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে পাঠকের নিকট হাজির করার দায়বদ্ধতার প্রশ্নে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই মৌলিক দায়িত্বশীলতা দেখাতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিয়তই অনেকের বাঁকা চোখ দেখতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার সময়ে যে আদর্শ আমরা ধারণ করেছিলাম-‘আঁধারচেরা আলোর ঝলক’, সেখান থেকে আমরা বিচ্যুত হইনি। তাই এসব ভ্রুকুটিকে আমরা পরম প্রাপ্য হিসাবে মনে করে এসেছি। আমাদের পরিতৃপ্তির জায়গা এখানেই যে, জেলা ও জেলার সাধারণ মানুষের স্বার্থের জায়গায়, ঘটনার প্রকৃত রূপ তুলে ধরা, তথ্যকে অপ/ভুল/মিথ্যা তথ্য দিয়ে আড়াল না করা, সাধারণের বঞ্চনা আর কষ্টের কথা সামনে আনা, সম্ভাবনা ও মেধাকে প্রচারের আলোয় আনতে আমরা বিশ্বস্ত ও কর্মিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতেও তাই করে যাব।
এই দশ বছরের পথ চলায় আমরা বহু মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছি। বহু জনের সক্রিয় সমর্থনে বলবান হয়েছি। আড়ালের কতিপয় শত্রুর পরিবর্তে বন্ধু স্বজন লাভ করেছি অনেক বেশি। তাঁরা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন বিপদে বিপাকে। তাঁরা প্রেরণার অনর্গল স্রোতধারা বইয়েছেন আমাদের মনে। আজকের শুভদিনে নামোল্লেখ না করে তাঁদের জানাই সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা।
আমাদের সম্পাদকীয় ও বার্তা বিভাগের সহকর্মীগণ, উপজেলা প্রতিনিধিবৃন্দ, কম্পিউটার ও প্রেস সেকশনের সহকর্মীবৃন্দ, বিপণনকর্মীগণ; যাঁরা পত্রিকার প্রাণবায়ু, এই পবিত্র ক্ষণে তাঁদের সকলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
সকলে ভাল থাকুন। দুর্যোগ কেটে সুদিন আসবেই। আমরা সেই আশায়ই পথ চলি। এই পথচলা যেন শেষ না হয়। ধন্যবাদ সকলকে।