বিশেষ প্রতিনিধি
‘ভাই ভাটি অঞ্চলে যারা আমরা কৃষি কাজ করি, তারারতো ডিজেল ছাড়া চলারঔ উপায় নাই, সেচ, ধান কাটার মেশিন, বেকু মেশিন হকলতাত (সবকিছুতেই) ডিজেল লাগে, অথচ. ডিজেল কিনতে নানা সমস্যা, খালি চুরি, খালি চুরি, পারলে একটু খবর নেইন না।’ এই কৃষকের মতে চুরি’ই ডিজেল বিক্রয়ের প্রধান ব্যবসা।
জামালগঞ্জের হালির হাওরপাড়ের এক কৃষক সোমবার সকালে এই প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে ডিজেল বিক্রয় নিয়ে অনুসন্ধানি প্রতিবেদন তৈরি করার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন এভাবেই। তার মতে ডিজেল বিক্রয়কারী ব্যবসায়ীদের অনেকেই দরিদ্র কৃষকদের মাপে (ওজনে) ঠকেন।
জামালগঞ্জের সাচনা বাজারে ভাটি অঞ্চলে ডিজেল বিক্রয়ের সরকারি অর্থাৎ পেট্রোবাংলার একটিমাত্র ডিপো যমুনা ওয়েল ‘বার্জ ডিপো’। সাচনাবাজার খেওয়া ঘাটের পাশে সারাবছরই এই ডিফোর বার্জ ভেড়ানো থাকে। ওখান থেকে ডিজেল কিনেন জামালগঞ্জের ১৯ জনসহ জেলার ৩০ জনের মতো ডিলার। তারাই সারা জেলায় ডিজেল সরবরাহ করেন।
সোমবার সকাল থেকে যমুনা ওয়েলের ডিজেল বিক্রয়ের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে নানা তথ্য জানালেন, স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।
সাচনা বাজারের কালী বাড়ির সামনের কোম্পানী রোডে ডিজেল কেরোসিন তেল বিক্রয় করেন চাঁনপুরের একজন ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়ী (নাম-পরিচয় না লেখার অনুরোধ জানান)। এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে বললেন, বিএসটিআইয়ের মাপ কিভাবে দেব। ২০০ লিটারের ডিজেলের ড্রাম কেনার সময়েই চার-পাঁচ লিটার কম পাই। আমরার তো মাপে কম দেওয়াই লাগবো। এই সি-িকেটেতো বড়রা (প্রভাবশালীরা) জড়িত। ইখানো (এখানে) চুরি করতে পারলেই ব্যবসা, নাইলে (না হয়) ফকির অইয়া (হয়ে) বাড়িত যাওন (যাওয়া) লাগবো, সত্যের ভাত নাই।’
স্থানীয় একজন গণমাধ্যম কর্মী বললেন, গেল আগস্ট মাসের ১১ তারিখে সাচনা বাজারের ডিজেল বিক্রয়কারীদের দোকানগুলোয় ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে ছিলেন। এসময় দোকানীদের কাছে বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত ওজন সামগ্রী কেন নেই জিজ্ঞেস করলে, ছোট ছোট দোকানীরা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা ওজন কমে কিনি এজন্য ঠিকভাবে ওজন করে বিক্রয় সম্ভব হয় না।’ পরে ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাররা অভিযান চালিয়ে স্থানীয় তেলের ডিলার আলমগীর ট্রেডার্সকে ওজনে কম দেওয়ায় ৫০ হাজার টাকা, আব্দুল মালেক ট্রেডার্সকে ১৫ হাজার টাকা এবং আজিজুর রহমান ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। আলমগীর ট্রেডার্সের আলমগীর কবির স্থানীয় ডিজেল ডিলার সমিতির কোষাধ্যক্ষ।
ওজনে কম দেবার জন্য জরিমানার বিষয়ে জানতে চাইলে আলমগীর কবির বললেন, জরিমানা দিয়েছি সত্য, কিন্তু ওজনে আমি কম দেই না, আমি যেভাবে ডিফো থেকে ড্রাম এনে বিক্রয় করি, সকল ডিলার একইভাবে এনে বিক্রয় করেন, ওজনের বিষয়টি সারা দেশের ডিলারই জানেন কিভাবে ডিজেল পাওয়া যায়, সিস্টেম সব জায়গাতে একই রকম, তাহলে কী যমুনা ওয়েল কম দিচ্ছে, উত্তরে ওই ব্যবসায়ী বললেন, সাংবাদিক হিসেবে নয়, স্থানীয় মানুষ হিসেবে ভাই বলছি, আমাকে বিপদে ফেলবেন না।
স্থানীয় আরেক গণমাধ্যম কর্মী জানালেন, ভাটি অঞ্চলে যমুনা ওয়েলের সাচনাবাজারের একমাত্র তেলের ডিপো থেকে নেত্রকোণা পর্যন্ত ডিজেল বিক্রয় হয়। এখানে ডিজেল বিক্রয় ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে ওঠেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে খবর আছে, ডিজেল সিন্ডিকেটে যমুনা ওয়েলের ডিপো কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় সরকারি ও বিরোধী দলের অনেক প্রভাবশালীরা জড়িত। এখানে ডিলারদের কাছ থেকে তেল কিনলে প্রত্যেক ড্রামেই (২০০ লিটারে এক ড্রাম) তিন-চার লিটার ডিজেল কম পাওয়া যায়। কম দেওয়া এই তেল পরে বিক্রয় করে টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয়। যমুনা ওয়েলের স্থানীয় অসৎ কর্মকর্তাসহ ডিজেল ব্যবসায় জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরাও এর ভাগ পান বলে স্থানীয়দের মধ্যে কথা আছে। এছাড়া, এখানে অনেক ডিজেল ডিলার আছেন, যাদের ব্যবসা নেই, দোকান নেই, কেবল ডিও কাগজ বিক্রয় করে হাজার হাজার টাকা ব্যবসা করেন।
স্থানীয় ক্রেতাদের দাবি নিয়মিত অভিযান না চালালে ডিজেল কিনতে ওজনে ঠকবেনই ক্রেতারা।
জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নবী হোসেন বললেন, আমি খুচরা ডিজেল বিক্রয় করি না। পাইকারী বিক্রয় করি। কেউ কম পেয়েছে, এমন অভিযোগ জানায় নি।
জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বললেন, এক লিটার ডিজেলের দাম ১০৯ টাকা। কম দিলে আমরা কি মানবো। আমরা কম পাই না। যারা বলছে, অন্য কাহিনী আছে।
সাচনা বাজার যমুনা ওয়েলের ডিপো ম্যানেজার আনিসুর রহমান বললেন, প্রতিমাসে গড়ে এই ডিপো থেকে আট থেকে ১৬ লাখ ডিলার ডিজেল বিক্রয় হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে আমাদের ডিপো শতভাগ জবাবদিহিতার মধ্যে থাকে। এখানে মাপে কম দেবার কোন সুযোগ নেই। তাহলে কি ডিলাররা মাপে কম দিচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ডিলাররা সরকারের জবাবদিহিতায় আছেন। অনিয়ম বা ভাগ বাটোয়ারায় তাদের কারো জড়িত থাকার কোন সুযোগ নেই বলে দাবি তার।
ভোক্তা অধিকারের সুনামগঞ্জের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলামিন গেল ১১ আগস্ট ওজনে কম দেওয়ায় সাচনা বাজারের ডিজেল ডিলার আলমগীর ট্রেডার্স, আব্দুল মালেক ট্রেডার্স ও আজিজুর রহমান ট্রেডার্সকে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করার সত্যতা নিশ্চত করে বললেন, তিনি নতুন এসেছেন, সুনামগঞ্জে এই বিষয়ে তিনি কাজ করবেন।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বললেন, যমুনা ওয়েল যেহেতু ভাটি অঞ্চলে একমাত্র সরকারি তেল ডিপো মাঝে মধ্যেই ওখানে পরিদর্শনে যান তিনি। ওখানকার ডিপো বা ডিজেল ডিলারদের কেউ ওজনে কম দেয় এমন অভিযোগ কেউ জানায় নি তাকে। যেহেতু বিষয়টি তিনি জেনেছেন, তিনি ওখানে এই বিষয়ে খোঁজ নেবেন। অনিয়ম পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
- সড়কের মাঝে বিদ্যুতের খুঁটি/ কাজে আসছেনা অর্ধকোটি টাকার সড়ক
- ডিজেলে ওজনে কারচুপি বন্ধ করতে হবে