ফকির মকরম আলী শাহ বাংলা ১৩২২ বাংলার বৈশাখ মাসের প্রথম সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন ভাদরপুরে। পিতার নাম পীর সফাত আলী শাহ ও মাতার নাম জয়গুণ বিবি। মকরম আলী শাহ’র পিতা পীর সফাত আলী শাহ উর্দু, ফার্সী ও আরবী ভাষা জানতেন। পড়তে পারতেন সিলেটের নাগরি লিপি। পিতার মতো নাগরি লিপি পড়তে ও এরকম নানা ভাষায় পারদর্শী ফকির মকরম আলী শাহ নিজেও। ভাদরপুরের ইসলামীয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেছেন। ফকির মকরম আলী শাহ’র ৩ ভাই ও ২ বোন। তাঁর এক ছেলে, নাম বাউল শাহজাহান। ১৯৭৮ সাল পবিত্র হজ্ব পালন করেছেন। প্রায় ছয় বছর ছিলেন সৌদি আরবে। হজ্ব পালন করেছেন বাবা, দাদা, দাদী, স্ত্রী এবং নিজের। সেই দেশে নিয়েও গানের চর্চা ছাড়েননি। আরবীতে গান করেছেন সেখানে। একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের সাথে ছিল তাঁর একান্ত সম্পর্ক। ২০১৬ সালের ৯ এপ্রিল সেই সম্পর্কের কথাই ‘দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর’ এ তুলে ধরা হয় তাঁর বয়ানিতে। অবধারিতভাবেই এখানে উঠে এসেছে সমকালীন লোকশিল্প ও শিল্পীর সাতকাহন। অনুলিখন করেছেন সজীব দে। ফকির মকরম আলী শাহ প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই লেখাটি ‘দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর’ এর পাঠকদের জন্য পুনরায় প্রকাশিত হলো।
ফকির মকরম আলী শাহ
করিম ও আমি ছিলাম সমবয়সী। বাউল শাহ আব্দুল করিমের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল ভৈষবেড়ে। এক মালজোরা গানের আসরে। আনুমানিক তখন আমাদের বয়স ১৪ বছর হবে। পাকিস্তান হয়নি তখন অর্থাৎ সে সময় ছিল ব্রিটিশ শাসনামল। সেখানে শাহ আব্দুল করিম, দূর্বিণ শাহ, আশকর আলী মাস্টার, সফর আলী এক আসরে গান করেছিলেন। করিমের হাতে সেসময় একটি একতারা আর চটি ছিল। তখনকার সময় বাউলরা তবলা, ঢোলক, চইট্টা ও ডুপি, পাতলা বাজাইয়া গান করতেন। করিমের ছিল ঘাড় পর্যন্ত চুল। ঘুরে ঘুরে যখন গান করতো সে সময় তাকে সুন্দর লাগতো। মাদ্রাসার ছাত্র হলেও সেই আসরে আমি গজল গেয়েছিলাম। করিমের মালজোরা গান আমার খুব ভালো লাগতো। এই ছিল প্রথম দেখা। তারপর থেকে তাঁর সাথে আমার বারবার দেখা হয়েছে। একসাথে গান করেছি বিভিন্ন আসরে।
করিম ছিলেন রসের নাগর আর জ্ঞানের সাগর ছিলেন দূর্বিণ শাহ। দূর্বিণ শাহ ও করিম একসাথে লন্ডনও গিয়েছে। দুর্বিণ শাহ তখন চিনতেন আমাকে। আমার পিতা পীর সফাত আলী শাহ’র সাথে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। সেই সময় দূর্বিণ শাহর একটি দেহতত্বের গান আমার মুখস্ত ছিল। গাইতামও আমি। গানটি হলো-
‘এই যে দেখ ইস্টিমার, নূরনবী প্যাসেঞ্জার
নিজে খোদা জাহাজের মাস্টার
শোন বলি জাহাজের সংখ্যা দুই
চৌদ্দভূবন অঙ্গমাখা, মুখে দূর্বিণ গান।’
আমার প্রথম গানের উস্তাদ ছিলেন মাওলানা আহসান উল্লাহ ও মুন্সি ইমতিয়াজ আলী। পরে ময়মনসিংহের সিংহেরগাঁও গ্রামের জালাল উদ্দিন খাঁর কাছে গান শিখতে গিয়েছেলাম। কিন্তু তিনি আমাকে তাঁর শিষ্য করেন নি। তাঁর গানের বই দিয়ে বলেছিলেন,‘আমি কাউকে গান শিখাই না। সাধনা করে যাও আমার দোয়া সব সময় থাকবে।’ উনার কাছে আব্দুল করিম ও দূর্বিণ শাহ গেছেন আমার পরে। গ্রামের রশিদ আলী শাহ নামে একজনের কাছে শিখেছি নাগরি লিপি। এছাড়াও সৈয়দ শাহনূর পীর, সৈয়দ আছদ আলী শাহ, শীতালং শাহ এদের কাছ থেকে নাগরি লিপির বই এনে পাঠ্যভ্যাস করেছি। বইগুলিতে নাগরি লিপির বাংলায় অনুবাদ করা ছিল। বুঝে নেয়া যেত সহজে। সেই সময় নাগরি লিপিতে গান লিখেছেন ও গেয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, দিনভবানন্দ, সৈয়দ শাহনূর, শীতালং, পাগল দইকুড়া প্রমুখ। নাগরি লিপির গান গাওয়া হতো দল বেঁধে। আসর বসতো সে সময়। দূর-দূরান্তের বহুলোকের সমাগম ঘটতো আসরে।
পাকিস্তান আমলে গান গাওয়ার জন্য একবার আমাকে পুলিশ জেলেও নিয়ে গিয়েছিল। জেলে নিয়ে বলেছিল এসব গান নাকি গাওয়া যাবে না। এ ধরনের গান গাইলে আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে শাস্তি হতে পারে। অন্য গান করার জন্য তারা আমাকে বলল। আমি তাদের বলেছিলাম,‘আমার অন্তর থেকে যে গান আসবে সেটাই আমি গাইব। গানটি ছিলÑ
‘ওদের ধ্বংস হলো সারা হলো অভাবে
মেলেটারী আসল এবার দেশেতে’
আব্দুল করিম আর আমি একতারা ও সরাজ দুইটি দিয়েই গান করেছি। একবার ভৈষবেড়ে সরাজ দিয়ে দূর্বিণ শাহ, করিম ও আমি একসাথে গানও করেছি। সেই সময় কামাল উদ্দিন, আশকর আলী মাস্টার সরাজ দিয়ে গান করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শাহ আব্দুল করিম আর কামাল উদ্দিন একসাথে একটি গানের বই বের করেছিল। আমারও একটা গানের বই ছিল। ৩০টি গান ছিল সে বইতে। বইটির দাম ছিল দুই আনা। সেটাই ছিল আমার প্রথম গানের বই।
আমাদের সময়ের মতো এখন কিন্তু মালজোরা গানে আর তেমন পারদর্শী কেউ নেই। আমি যাদের সাথে মালজোরা গান করেছি সিদ্দেক আলী, সফর আলী, বাউল শাহ আব্দুল করিম, দূর্বিণ শাহ, কামাল উদ্দিন, মফিজ আলী ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তাদের কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তাদের মতো এখন আর কাউকে দেখি না। একই কথা বলা যায় বাউলদের ক্ষেত্রে। অরজিনাল বা সত্যিকারের বাউল হওয়া সহজ নয়। শেষ পর্যন্ত ছালিম উল্লাহ, সিদ্দিক আলী ও দূর্বিণ শাহর ছাত্র আব্দুর রহিম ছিলেন।
করিমের মালজোরা গান আমার সব থেকে ভালো লাগতো। তাঁর গানে ও রাগিনীতে রস ছিল যা গানে অন্য মাত্রা যোগ করতো। কয়েকবার আমি তাঁর সাথে মালজোড়া গান গেেেয়ছি। একবার মালজোরা গানে করিম বলেছিলÑ
‘মনের মানুষ অতি দ্বারে
গয়া, কাশি, বৃন্দাবন নাই কোন প্রয়োজন
ভক্ত যে জন হইতে পারে’
করিমের গানের পর আমি (মকরম আলী) বলেছিলামÑ
‘মানুষ ছাড়া মানুষ ভবে হইতে না পারে
এক মানুষ জগতের তরে
হাসর পুল ছিরাতের পাড়ি
সেই মানুষকে চিহ্ন করি
ডাক উচ্চস্বরে’
আরেকবার শেরপুরে মালজোরা গানের আসরে করিম বলেছিলÑ
গাড়ি চলে না চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
সামনে বিষম অন্ধকার
করতেছে তাই ভাবনা।
করিমের এরকম গান আমি আর কোন জায়গায় শুনি নাই। কিছুক্ষণ বসে সরাজে টুনটুন করে তারপর বললাম,Ñ
‘করিম সাবের গাড়ি চলে না এতে আমার কিছু নয়,
আমার গাড়ি চলে
আমার দেহ গাড়ি চলিতেছে দুই চাকায়
দিনে তিনবার পেট্রোল দিয়া চলে গাড়ি সর্বদায়।’
ব্রাহ্মাণবাড়িয়ার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ একবার সাহেববাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে আমরা মাদ্রাসার ছাত্ররা সবাই মিলে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে দেখতে গিয়েছিলাম। তাঁকে সালাম করে আসরে করিমের মালজোরা গানও শুনেছিলাম। গানের আসরে করিমের হার নামানা মনোভাব দেখে করিমের খুবই প্রশংসা করেছিলেন। আমাদের তিনি (ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ) গুঞ্জন পাখি আর কাউয়া (কাক) এর গল্প বলেছিলেন। ‘গুঞ্জন পাখির কাছে কাউয়া (কাক) গেছে গান শিখতে। কিছুদিন পর গুঞ্জন পাখি কাউয়ারে (কাক) গান শিখিয়ে চলে গেল। তখন কাউয়া (কাক) যেমন ইচ্ছে তেমনিই নাচতে লাগলো।’ করিমের এখন সে অবস্থা।
বাউল করিম ছিলেন মাটির মানুষ। মানুষকে খুব মায়ার চোখে দেখতা। মানুষের দু:খে তাঁর প্রাণ কাঁদতো। সারা জীবনই মানুষের জয়গান গেয়েছেন। গান গেয়ে মানুষকে বুঝিয়েছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন। করিমের গানে গানে আছে মানুষের কথা। কোন প্রশংসা বা তারিফ করে করিমের মহিমা বুঝানো সম্ভব নয়।