কৃষিবিজ্ঞানী সাকিনা খানমরাই দেশের আসল নায়ক

১১ মে ২০২৩ তারিখের দৈনিক সমকালের শেষ পৃষ্ঠায় ‘মাঠে মাঠে অদম্য সাকিনার সাফল্যের ঝিলিক’ শিরোনামে যে আশা জাগানিয়া প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতপক্ষে আমরা এ ধরনের খবরই প্রতিনিয়ত শুনতে চাই। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নতুন ধানের জাত আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কৃষিবিজ্ঞানী সাকিনা খানম এক বড় ধরনের সফলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু এই সফলতার পথটি কৃষিবিজ্ঞানীর জন্য মসৃন ছিলো না। পদে পদে ছিলো বাঁধা। অবশেষে তিনি সেই বাঁধা ডিঙিয়ে মাঠে মাঠে ফলিয়েছেন সোনালী ধানের এক নতুন সম্ভাবনা। তাঁর উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধান বীজটির নাম রাখা হয়েছে বিনা ধান-২৫। বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ধারাবাহিকভাবে কৃষি গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে নতুন নতুন ধান বীজ কৃষকদের কাছে নিয়ে আসছে। কৃষিবিজ্ঞানীদের এই নিরন্তর প্রচেষ্টার কারণেই দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবাদী জমি কমার বাস্তবতায় মধ্যে বসবাস করেও আমরা এখনও তেমন করে খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি না। সাকিনা খানমের উদ্ভাবিত বিনা ধান-২৫ জাতটি মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার ভাতুয়াডাঙ্গা গ্রামে এবারই প্রথম আবাদ করা হয়। এই জাতের ধান ব্রি-২৯ ধানের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে পেকে যায় বলে জানিয়েছেন তিনি। এর অর্থ হলো আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকির সম্মুখে থাকা হাওরাঞ্চলের জন্য ধানের এই জাতটি খুব উপযোগী। এই ধান থেকে যে চাল হয় তা বেশ, লম্বা ও সরু যা বাণিজ্যিকভাবে আশাব্যঞ্জক। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্য অনুসারে, ‘বিনা ধান-২৫ এখন পর্যন্ত দেশের সেরা জাত।’ হেক্টর প্রতি এই ধানের গড় ফলন সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ টন। সর্বনি¤œ উৎপাদন সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিলেও কেয়ার প্রতি ফলনের পরিমাণ হয় কমপক্ষে ২৪ মণ। এটি প্রচলিত সকল জাতের মধ্যে সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে। সবচাইতে বড় কথা হলো এই জাতের ধান থেকে বীজ সংরক্ষণ করা যায়। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের বিদেশ ও কর্পোরেট নির্ভরতা যেভাবে অক্টোপাসের মতো ঘিরে রেখেছে তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের অবশ্যই বীজের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা দরকার। আলোচ্য উচ্চফলনশীল ধানের জাতটি সেই স্বাধীনতার সুযোগ এনে দিয়েছে। তাই আমরা মনে করি সারা দেশের কৃষকদের কাছে বিনা ধান-২৫ জাতটির ব্যাপক সম্প্রসারণ প্রয়োজন।
কৃষিক্ষেত্রে আমাদের বহুমুখী গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন সর্বাাধিক। টেকসই জাতীয় উন্নয়নের প্রাণভোমরা কৃষির ভিতরেই লুক্কায়িত। আমরা যতই পোশাক শিল্পের বড়াই করি না কেন কৃষিক্ষেত্রে বিপর্য়য় ঘটলে ওই বড়াই কোনো কাজে আসবে না। সরকার কৃষি সেক্টরের উন্নয়নে মনোযোগী আছে। গবেষণা এর অন্যতম। এর আগেও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা বলেছি, আমেরিকা, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম কিংবা ভারতের কৃষি জমিতে আমাদের চাইতে বেশি ফসল উৎপাদন করা হয়। অথচ প্রকৃতির আশীর্বাদে আমাদের জমি অধিকতর সুফলা। আধুনিক প্রযুক্তি ও নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা পরিচালনার মধ্য দিয়ে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টাটি তাই এখন অগ্রাধিকার-উপযুক্ত জাতীয় কর্মসূচি হওয়া উচিৎ। কৃষিবিজ্ঞানী সাকিনা খানমের নুতন জাতের ধান উদ্ভাবনের প্রক্রিয়াটি তারই অংশ বলে আমরা মনে করি।
অনেকেই সাকিনা বেগমকে দেশের আসল নায়ক হিসাবে মনে করছেন। আসলেই তাই। নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এমন সব বিজ্ঞানীদের কারণেই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অত্যধিক জনবহুল এই দেশটি ভবিষ্যতে কৃষিজমি থেকে আরও অনেক বেশি উৎপাদনশীলতা চাইবে। এক্ষেত্রে আমাদের ভরসা সাকিনা খানমের মতো কৃষিবিজ্ঞানী ও অদম্য কৃষক সমাজ। ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’ এই মূলমন্ত্রকেই আমাদের আঁকড়ে থাকতে হবে। যাহোক, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বিনা ধান-২৫ জাতের ব্যাপক আবাদের লক্ষে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুক এই আমাদের কামনা। কৃষিবিজ্ঞানী সাকিনা খানমকে আমাদের অভিবাদন।