‘ঘর ভেসে গেছে, পরনের কাপড় ছাড়া কিচ্ছু নাই’

বিশেষ প্রতিনিধি
ভয়াবহ বন্যায় জেলার লক্ষাধিক পরিবার বসতঘর হারিয়েছে। ঘরবাড়ি হারানো বন্যার্ত মানুষেরা উঁচু সড়কে, আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। সরকারি হিসাবে জেলায় দর্দুশাগ্রস্ত বানভাসি পরিবারের সংখ্যা ৪৫ হাজার নির্ধারণ করা হলেও বেসরকারি হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে ২৪০ পরিবারের বাস। সরেজমিনে গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বন্যায় এই গ্রামের ১৮০ টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৬০ টি বসতঘর একেবারে ল-ভ- হয়ে গেছে। এই ঘরগুলোর বাসিন্দারা আগামী অগ্রহায়ণ (নভেম্বর) মাসে নতুন করে গৃহ নির্মাণ ছাড়া বাড়ি ফিরতে পারবেন না।
গ্রামের বাসিন্দা ময়না বেগম বললেন, ‘ঘরও নিছে, কাপড়, লতা, শাড়ি, ডেকসি কিচ্ছু নাই, সামান্য জাগা আছিল, ইখানেরও দলিলপত্র ভাসাইয়া নিছে।’
তাজুল ইসলাম বললেন, ‘ঘরের লগে কেতা-বালিস সবই নিছে, ৩৫ বস্তা ধান আছিল ইগুনও ভাইস্সা গেছে’।
আহসান উল্লাহ বললেন, ‘কোন লাখান জান লইয়া বারইছি, ঘরের ভেড়া-গুড়া ভাইঙ্গা, ছাল-টাল উড়াইয়া নিছে, পায়ের জুতা পর্যন্ত ভাইস্সা গেছে, এখন সকলেই বিশ^রোডে ছাপরা বানাইয়া থাকরাম।’
গ্রামের সালাম উদ্দিন, জমির হোসেন, আব্দুল হামিদ, ফিরোজ আলী, মুকিত মিয়া, সাজাউর রহমান, কফিল উদ্দিন, রাবেয়া বেগম, ছালেহা বেগমসহ অনেকের পরিবারই এখনো মহাসড়কে ছাপড়ায়, না হয় কোন আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গ্রামবাসী জানালেন, ইসলামপুরের ৬০ পরিবারের বসতঘরের অস্তিতই নেই। এরমধ্যে আধাপাকা ঘরও আছে।
গ্রামের জব্বার মিয়া বললেন, ত্রাণেই বাইচ্ছা আছি আমরা, কেউ সাহায্য করলে খাইতাম, নাইলে উপাষ থাকতাম, নয়া কইরা বসতঘর করতে পারলে যাওন, নাইলে পথে পথে থাকন, কবে যে বাড়িত ফিরন যাইবো জানি না।
ইসলামপুর গ্রামের কেবল এমন অবস্থা নয়। জেলার ২ হাজার ৮৮৮ গ্রামের মধ্যে দুই হাজার গ্রামেই এমন মর্মস্পর্শি দৃশ্য।
সুনামগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনাম আহমদ বললেন, গ্রাম প্রতি ৫০ পরিবারের বসতঘর ভেসে গেলেও, জেলায় লক্ষাধিক পরিবার মানবেতর দিন কাটাচ্ছে, সরকারই তাদের বসতঘর নির্মাণ করে দিতে হবে, অন্যতায় এরা বাস্তুচ্ছুত হবে।
জগন্নাথপুর প্রতিনিধি তাজ উদিন আহমদ, জগন্নাথপুর পৌরসভা ও আট ইউনিয়নে চার হাজার ঘরবাড়ি সরকারি হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হলেও বেসরকারি হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।

জেলার লক্ষাধিক পরিবারের মানবেতর জীবন


ধর্মপাশা প্রতিনিধি এনামুল হক জানিয়েছেন, বেসরকারি হিসেবে ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার ১০ ইউনিয়নে এক হাজারেরও বেশি ঘর বন্যায় পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত তিন হাজারেরও অধিক ঘর। এই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির হাসান অবশ্য জানিয়েছেন, ২৮০ টি ঘর একেবারে ভেঙে গেছে। আর দুই হাজার ২৫০ ঘর মেরামত উপযোগী।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দফায় দফায় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জে ৪৫ হাজার ২৮৮ পরিবারের বসত ভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বানভাসি মানুষের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছেন। সোমবার সকাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেওয়া পাঁচ কোটি টাকা বিতরণের কাজ শুরু হবে। বসতঘর ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঁচ হাজার পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে তুলে দেওয়া হবে। এসময় সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা থাকবেন। পর্যায়ক্রমে বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদেরও নগদ সহায়তা দেওয়া হবে।
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে গেল ১৬ জুন সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা বন্যা কবলিত হয়। শুক্রবার ভোর তিনটায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যায় জেলার ৮০ ভাগেরও বেশি এলাকা। তালা দেওয়া অনেক দুতলা গুরুত্বপূর্ণ অফিস, হাসপাতাল ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের তালা ভেঙে জীবন বাঁচিয়েছেন লাখো মানুষ। ভয়াবহ বন্যার তা-বে বসতঘর, ঘরে থাকা ধান-চাল, গহপালিত পশু, জমিতে থাকা সবজি, পুকুরের মাছ সবই ভেসে গেছে। এখনো হাজারো মানুষের ঘরে খাবার নেই, বাইরে কাজ নেই, সিংহভাগ এলাকা বন্যা কবলিত।