জনপ্রিয় করতে হবে মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহ দান সংস্কৃতিকে

মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহ দান একটি মহত্তর মানবিক সংস্কৃতি। প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। এই অবধারিত অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অমরত্বের ধারণার মধ্যে ভিন্ন ধরনের এক ব্যঞ্জনা লুক্কায়িত। সেটি হলো সীমিত জীবনকালে এমন কিছু অর্জন করা যা মরার পরও তাকে দীর্ঘদিন স্মরণে রাখে। আমরা আজও পরম শ্রদ্ধায় বিভিন্ন মনিষীদের কথা স্মরণ করি। কারণ তারা মানুষ ও এই জগৎ এর কল্যাণের জন্য কিছু করে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর নিজের অস্তিত্বকে প্রবহমান রাখার নামই অমরত্ব। এ কোনো অলৌকিক ভাবনা নয়। আজকাল পৃথিবীর বহু লোক মরণোত্তর চক্ষু দান করেন। মৃত মানুষের কর্ণিয়া সংযোজনের মাধ্যমে বহু অন্ধ এখন চোখের দৃষ্টি ফিরে পান। এদের নতুন দৃ্িষ্টর মধ্যেই বেঁচে থাকেন কর্নিয়া দানকারী ব্যক্তিটি। কেউ দান করেন কিডনি বা অন্য কোনো অঙ্গ বিশেষ। অনেকেই গোটা দেহটাই দান করে যান মানুষ ও জগতের কল্যাণার্থে। এই দেহের ব্যবহারযোগ্য অঙ্গগুলো কাজে লাগানোর পর অবশিষ্ট দেহ চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণার কাজে লাগে। মানুষ জীবজগতের সবচাইতে অগ্রগামী অংশ, তাই মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। মানুষ এই অভিধার সার্থকতা যুগে যুগে প্রমাণ করে চলেছে। সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি মস্তিষ্কমৃত তরুণী সারাহ ইসলামের দুইটি কিডনি ও দুইটি কর্ণিয়া ৪ জন পীড়িত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে সমর্থ হয়েছে। মানব দেহের প্রায় ১২ ধরনের অঙ্গ মৃত্যুর পর অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায়। অর্থাৎ একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর আও ১২ ব্যক্তির জীবনকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিতে সামর্থ রাখেন। এই অপরিমেয় সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর দিকে অধিকতর নিয়োজিত হওয়াটাই তো তাই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের নিকট থেকে প্রত্যাশিত।
মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গ দান করার বিষয়ে এখনও প্রতিবন্ধকতা হলো সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার। যদিও ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুসারে এরূপ মহৎ কাজে কোনো নিষেধ নাই তবুও অনেকে এ নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন। এছাড়া এই বিষয়টিকে তেমন করে জনপ্রিয় করে তোলা যায়নি। এজন্য দরকার ব্যাপক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ ও জাগরণ। একসময় রক্ত দিতেও মানুষ ভয় পেত। এখন অবস্থা পাল্টেছে। রক্তের প্রয়োজনের কথা শুনলে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের বিশ্বাস মরণোত্তর অঙ্গ ও দেহ দানের বিষয় নিয়ে কাজ করা হলে রক্ত দানের মতোই বিষয়টি একসময় সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাবে। এজন্য দরকার দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ অভিযান। এ কাজে সমাজের অগ্রগণ্য ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্বভাবগতভাবে মানুষ উদার, দরদী ও পরোপকারী। মানবিক বিপর্যয়কালে মানুষের এই মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় সবচাইতে বেশি।
দেশে অঙ্গ দানের একটি আইন আছে। ২০১৮ সনে এই আইন সংশোধিত আকারে জারি হয়েছে। আইন জারির পর অঙ্গ ও দেহ দান যদিও অপ্রতুল তবে হতাশার কিছু নেই। এমন এক কঠিন কাজে সাড়া মিলতে সময় লাগবে। আশার কথা হলো এই, ‘মৃত্যুঞ্জয়’ নামের সংগঠন ২০১৪ সন থেকে এ পর্যন্ত ১০০ জনের নিকট থেকে মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার পেয়েছেন। তদনুরূপ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এনাটমি বিভাগ ২০০০ সন থেকে ১০০ জনের অঙ্গীকার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ সংগ্রহ করেছে ৬০ জনের অঙ্গীকার। আরও উৎসাহজনক সংবাদ এই, মৃত্যুঞ্জয়ী সারাহ ইসলামের অঙ্গ দানের পর গত দুই সপ্তাহে অন্তত ১০ ব্যক্তি মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার করেছেন। বিশিষ্ট ব্যক্তি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফের মত ব্যক্তিরা দেহ দান করে গেছেন। দেহ দান করেছেন সুনামগঞ্জের বাম রাজনীতিক শাল্লার কমরেড শ্রীকান্ত দাস ও তাঁর স্ত্রী।
আসুন নিজেকে বিলিয়ে দেই সকলের তরে।