জেলায় ১৮টি বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন/ আরও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের দাবি

স্টাফ রিপোর্টার
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে প্রতি বছরই জেলায় অনেকের মৃত্যু হয়। আহতও হন অনেকে, যাদের বেশিরভাগই কৃষক অথবা জেলে। বজ্রপাতে তাদের মৃত্যুতে নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার। বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়কে বজ্রপাতের মৌসুম বলা হয়। যদিও সেপ্টেম্বরেও বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক বছরে হাওরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় জেলায় ৬ উপজেলায় ১৮টি দণ্ড বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। তবে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি ও আহতের সংখ্যা কমাতে আরও বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন হাওরাঞ্চলের মানুষজন ও সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের এক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ একটি। ২০১৫ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার। এরপরই বজ্রপাত রোধে আধুনিক বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বজ্রপাতে ২০২২ সালে জেলায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের এবং আহত হয়েছেন ৫ জন। আহত ও নিহতদের সকলেই কৃষক ও জেলে। বজ্রপাতে বেশিরভাগ মৃত্যুর হয় গ্রামাঞ্চলে।
গত বছরের ১৩ মে বজ্রপাতে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের কাড়ারাই গ্রামে কৃষক আব্দুস সোবহানের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হন আরও ২ কৃষক। ১৮ মে ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের কৃষক মতিউর রহমানের মৃত্যু হয়। ৫ জুন শাল্লা উপজেলার চাকুয়া গ্রামের কৃষক রাধিকা চন্দ্র দাস, ৪ জুলাই ধর্মপাশার কাইঞ্জার হাওরে মানিক মিয়া ও নিয়াশা ওরফে নুরুজ্জামান নামের দুই জেলে, ২৮ জুলাই ছাতকে কৃষক জইন উদ্দিন, ৩১ জুলাই তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে শামীম জমাদ্দারের মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় আহত জন আরও ১ জন। ২৮ আগস্ট শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের সদরপুর পশ্চিম পাড় (গাঙেরহাটি) গ্রামের কৃষক বাবুল চন্দ্র দেব, ৩০ আগস্ট ধর্মপাশার শালদিঘা হাওরে মাছ ধরার সময় বজ্রপাতে পাইকুরাটি ইউনিয়নের বেকুইজুড়া গ্রামের মনু মিয়ার ছেলে খোকন মিয়া (৪৪) ও জিলন মিয়া (৩২) এবং ২ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের খরচার হাওরে গৌরারং ইউনিয়নের উজান শাফেলা গ্রামের ফজর আলীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হন আরও ২ জন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় ২০২১-২২ অর্থ বছরে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। ২০২২ সালের এপ্রিলে ক্রিয়েটিভ সোলার এন্ড টেকনোলজি নামের একটি কোম্পানি জেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের দায়িত্ব পায়। ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জেলার ৬ টি উপজেলায় ১৮টি দন্ড স্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের আকষ্মিক বন্যার কারণে বাকি ৮০ লক্ষ টাকা ফেরত গেছে। জেলার সুনামগঞ্জ সদর, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর এবং শাল্লায় দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
এরমধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার আহমদাবাদ দিলশাদ হাজেরা আরফানেজ এন্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টারে ১টি, মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের লালপুর গ্রামে ১টি, বল্লভপুর গ্রামের উত্তর পাশে কানলার হাওরে ১টি এবং সুরমা হাওরের মারাখলার পাশে ১টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
ধর্মপাশা উপজেলার বালিজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের ছাদে ১টি, দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের ছাদে ১টি এবং আব্দুর রশিদ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনের ছাদে ১টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে ধুতমা থেকে মষলঘাট সড়কের পাশে ১টি, মাটিয়ান হাওরে রতনশ্রী থেকে রাস্তার পাশে ১টি এবং টাঙ্গুয়ার হাওর সংলগ্ন ইকরদাইর জাঙ্গালে ১টি দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি বাজারে ১টি, সাচনা বাজারে ১টি এবং বেহেলি বাজারে ১টিদণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে ১টি, বাদাঘাট (দক্ষিণ) ইউনিয়নে ১টি এবং সলুকাবাদ ইউনিয়নে ১টি দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
শাল্লা উপজেলার হাবিবপুর ইউনিয়নের শাশকাই বাজারে ১টি, শাল্লা ইউনিয়নের মুজিবনগর গ্রামে ১টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের এলাকায় বৈশাখ মাসে মেঘ বৃষ্টি হয়, সেই সাথে হয় বজ্রপাত। বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করলে আমরা হাওরে গিয়ে কাজ করতে সাহস পাব। বেশি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করলে হাওরবাসী বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাবে।
একই গ্রামের এমদাদ মিয়া বলেন, বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন করা গেলে আমাদের আতংক নিয়ে হাওরে কাজ করতে হবে না।
ধর্মপাশা উপজেলার মৎস্যজীবী রহিছ মিয়া বলেন, জীবিকার তাগিদে বর্ষাকালে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দিন রাত আমরা হাওরে মাছ ধরি। মনে ভয় নিয়ে প্রতিদিন বের হই, কোন দিন যে বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটবে। অনেক সময় বজ্রপাতে পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এতে পরিবারের দুর্দশার অন্ত থাকে না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাদঘাট (দক্ষিণ) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছবাব মিয়া বলেন, আমার ইউনিয়নের ছাদে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপনের পর প্রাণহানি না হলে বোঝা যাবে সেটি কাজ করছে। আগামী বর্ষায়ই দণ্ডের কার্যকারিতা কতটুকু তা জানা যাবে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিউর রহিম জাদিদ বলেন, বিশ্বম্ভরপুর হচ্ছে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা। প্রতি বছরই বর্ষায় বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপজেলায় তিনটি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। উপজেলার অন্যান্য এলাকায়ও বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন করা গেলে প্রাণহানি কমবে বলে আশা করি।
ক্রিয়েটিভ সোলার এন্ড টেকনোলজি’র সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, সাড়ে তিনশ থেকে চারশ ফিট এলাকার মধ্যে যদি বজ্রপাত হয়, তাহলে সেটাকে টেনে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে বজ্রনিরোধক দণ্ড।
তিনি বলেন, আমাদের বজ্রনিরোধক দণ্ড পরীক্ষিত ও উন্নত। এগুলো ফ্রান্স, তুরস্ক, আমেরিকা থেকে আনা হয়েছে। আশা করি এই ডিভাইস বজ্রপাতে প্রাণহানি থেকে রক্ষা করবে। এসময় তিনি আরও বেশি করে বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপনের কথা বলেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় ১১টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের বরাদ্দ এসেছিল। এরমধ্যে ৬টি উপজেলায় ১৮ টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। বন্যার কারণে বাকি ৪টি উপজেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা সম্ভব যায়নি।
তিনি বলেন, জেলায় আরও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে। আগামী বর্ষার আগে স্থাপন করা গেলে খুবই ভালো হবে।
যেভাবে কাজ করে বজ্র নিরোধক দণ্ড :
বজ্রনিরোধক দণ্ড: তামা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুর বৈদ্যুতিক রোধের মাত্রা অনেক কম, তাই সাধারণত এ ধরনের ধাতু দিয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড তৈরি করা হয়। এটি উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ কে সহজে নিরাপদে মাটিতে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। ৩০-৪০ ফুট লম্বা দণ্ডে তিন-চার ইঞ্চি জিআইপি পাইপ এবং তামার তার থাকে।
লাইটনিং অ্যারেস্টার: লাইটিং অ্যারেস্টার একটি ডিভাইস, যা বসানো থাকবে বজ্রনিরোধক দণ্ডের ওপর। এর মূল কাজ নির্ধারিত ব্যাসের মধ্যে বজ্রপাত হলে তা টেনে মাটিতে নামিয়ে আনা। এতে মিটারের মতো কাউন্টার রয়েছে, কয়টি বজ্রপাত হল তার হিসাব সেখানে থাকবে। সারাক্ষণ সক্রিয় থাকবে এই যন্ত্র।