ঝরাপাতার পান্ডুলিপি শরণার্থী ৭১

সুখেন্দু সেন
শিলচর পর্ব
শিলংএ মাসীর বাসায় আমাকে ঘুমে রেখেই শিলচর থেকে ছুটে আসা আমাদের বড় ভগ্নিপতি খুব ভোরে জিপ নিয়ে বালাটের পথে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আজ সোমবার। হাটের দিন। দোকান ঘর ছেড়ে দেয়ার পূর্বশর্ত অনুযায়ী বাজারের টংঘরে আশ্রিত শ্বশুর পরিবারের লোকদের বৃক্ষতলে আশ্রয় নেওয়ার আগেই যাতে উদ্ধার করা যায় সে প্রচেষ্টায় এমন তড়িঘড়ি। বালাট জুড়ে ইতস্তত আশ্রয়গ্রহণকারীদের পরিবার পিছু একটি ঘর নবনির্মিত শরণার্থী শিবিরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাঁশের তরজার বেড়া, তেরপালের ছাউনি।  ১২ফুট বাই ৮ ফুট ঘরের অর্ধেকটায় আবার বাঁশের মাচা,Ñ শোবার ব্যবস্থা। আজ নতুন ঠিকানায় গৃহ প্রবেশ হতে পারে, এমনটিই শুনে এসেছিলাম। গৃহপ্রবেশ হলেই গৃহ থাকতে হবে এমন নিয়ম এখন অচল। সারি সারি ব্যারাকের এক একটি খুপরিতে একেকটি পরিবার। অবলম্বনহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত আগামীর অস্থায়ী ঠিকানায়  – এতটুকু আশ্রয়, মাথা গোঁজার ঠাঁই।
জ্যাঠা মশাইকে লালপানিতে রেখে বাবা আসতে রাজি হলেন না। বালাটের ক্যাম্পে আমাদের আরেক  কাকার পরিবারের সাথে থেকে  গেলেন। মা এবং দুই দিদিকে নিয়ে জামাইবাবু বিকেলেই ফিরে এলেন। দু’দিন শিলং বাস শেষে এবার আমাদের গন্তব্য শিলচর। শহর থেকে নয়-দশ মাইল দূরে উদারবন্দে এয়ারপোর্ট রোডের উপর ভগ্নিপতি পরেশ রঞ্জন দেবের অফিস কাম রেসিডেন্ট। সেন্ট্রাল এক্সাইজের কর্মকর্তা। একজন কনস্টেবল ও একজন আর্দালী নিয়ে অফিস। বাসায় দিদি এবং ভাগনে-ভাগনী তিনজন। রাস্তার অপর পাশে নয়ারাম উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের  শরণার্থী ক্যাম্পে গিজগিজ করছে মানুষ। কে কোন দিকে এসে কোথায় কিভাবে আশ্রয় নিয়েছে তার ঠিক নেই। অস্বাভাবিক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কোন নিয়মই কার্যকর থাকে না। গোলাগুলির মুখে জীবন বাঁচাতে ছুটে আসলেও সবাই যে বাঁচতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই। অনাহার, রোগ, শোক, মহামারী, মৃত্যু নিত্যসঙ্গী। আমরা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছি ঠিকই কিন্তু দুর্ভাবনা-দুঃশ্চিন্তা পিছু ছাড়েনি। বাবা-জ্যাঠারা এখন অনেক দূরের বালাট শরণার্থী শিবিরে। শ্বশুরবাড়ি  থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের সঙ্গে থাকা এক দিদির স্বামীর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।  
বাসার কাছাকাছি বইয়ের দোকান। বীনাপানি লাইব্রেরী। সংবাদপত্রেরও এজেন্ট। এখানে বসে সময় কাটাই বইপত্র, ম্যাগাজিন ঘেটে। আরো দু’চারজনও এসে জড়ো হয়। কলকাতার পত্রিকা বিমানে করে শিলচর আসে। কুম্ভিগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার গাড়ি শহরে যাবার পথে পত্রিকার বান্ডিল লাইব্রেরীর সামনে   ফেলে যায়। তার অপেক্ষায় থাকি। আকাশে ডাকোটা বা  ফকারফ্রেন্ডশীপ দেখা গেলেই বুঝতে পারি কখন পত্রিকা এসে পৌঁছবে। তড়িঘড়ি প্যাকেট খুলে একের পর এক পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে নেই। এখনকার সব গরম খবরÑ বাংলাদেশের যুদ্ধ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় পাকসেনাদের অত্যাচার নির্যাতন হত্যাকান্ড, শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান স্রোত, দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগ। কোলকাতার বাংলা কাগজগুলি এখন বাংলাদেশ নাম ব্যবহার করলেও ইংরাজি পত্রিকাগুলি ইস্টবেঙ্গল বা ইস্ট পাকিস্তান লিখে যাচ্ছে। জামাইবাবু ইংরাজী অমৃতবাজার পত্রিকার পাঠক । আমাদের জন্য যুগান্তর । দোকানে বসে আনন্দবাজার,গণশক্তি, আগরতলা শিলচরের দু’তিনটি সাপ্তাহিক দৈনিকও পড়ে নেই।
শরণার্থীদের চাপ সর্বত্রই। মহকুমা শহর করিমগঞ্জ সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় সেখানে শরণার্থীর ¯্রােত বেশী। সিলেট শহরের লোকজন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরও ভীড়। কর্তৃপক্ষের নজরও সেদিকে বেশি। জেলাসদর শিলচরের অধরচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক, কাছার জেলা স্কুলসহ আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শরণার্থীদের দখলে। শহর থেকে কিছুটা দূরে উদারবন্দ নয়ারাম হাইস্কুলে বিচ্ছিন্নভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় গড়ে উঠায় কর্তৃপক্ষের নজরও কম। এখানকার সবাই অজগাঁয়ের শিক্ষাহীন-স্বাস্থ্যহীন হতদরিদ্র লোক। স্কুল পড়–য়া কোন ছাত্রেরও দেখা মেলে না। খোঁজ খবর নেয়ার লোকজন যেমন কম, সুযোগ সুবিধাও তেমনি কম। এর মধ্যেই আমাশয়-কলেরার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে গেছে। প্রায় সময়ই কান্নার রোল কানে আসে। স্থানীয় লোকজন কলেরার ভয়ে মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলের ধারে কাছেও ঘেঁসে না। লাইব্রেরীর আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা মোটামুটি সচেতন ও মন মানসিকতায়ও কিছুটা অগ্রসর। চোখের সামনে অসহায় মানুষের এমন বিপর্যয় সকলের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। আমি নিজেও শরণার্থী। কাছাকাছি আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার আগ্রহ থেকেই আড্ডার চার পাঁচ জনকে সঙ্গে নিয়ে ভালো-মন্দ বিচার বিশে¬ষণ না করেই জড়িয়ে যাই এই হতভাগ্যদের সুখ-দুঃখে। শ’খানেক পরিবার গাদাগাদি করে আছে। নোংরা পরিবেশ রোগ ছড়ানোর উপযুক্ত ক্ষেত্র যেন তৈরী করেই রেখেছে। দুর্গন্ধে বাতাসও বিষাক্ত ঠেকে। বসবাসকারীদের অসচেতনতা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলেছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অসহায়। ডাক্তার বাবু নিরুপায়। হাজার খানেক লোকের এ যেন এক নরক বাস। বালাটে দশবারো দিন টংঘরে অবস্থানের দুর্ভোগ পোহালেও পরিস্থিতি এর চেেেয় অনেক ভালো ছিল। অবশ্য মইলাম বিভিষিকার হৃৎপিন্ড খামছে ধরার মত ঘটনা প্রবাহ ঘটেছিল আরো পরে । নিকট আত্মীয়রা উদ্ধার না করলে হয়তো এ অবস্থাতে আমাদেরও পড়তে হতো।  যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে সামনা সামনি লড়ে যাওয়া যায় কিন্তু রোগ জীবাণু কখন কিভাবে ছড়িয়ে যায় আর কাকে আক্রমণ করে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয় তা দেখা যায় না, বুঝা যায় না। আমাদের আর সাধ্য কি। নিজেদের বাসাবাড়ি থেকে সাগু-বার্লি অন্যান্য পথ্য তৈরী করে এনে রোগাক্রান্ত শিশুদের মুখে তুলে দিয়ে  সেবাব্রতের প্রাথমিক সূচনা। পরে স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহ করে বিতরণ। শেষে স্যালাইন, কলেরার প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যস্ততায় কয়েকটি দিন।
কলেরার ভয়ে সকলেই আতংকিত। বেশ ক’জন রোগী রয়েছে ক্যাম্পে। নিজেদেরও সাবধান থাকা উচিত। দিদির বাসায় থাকি। আশ্রিত বলা যাবে না, অতিথি বটে। বড় কুটুম হিসাবে সমাদরেরও কমতি নেই। কিছুটা বিব্রত বোধও করি। জামাইবাবুর তেমন ছুৎমার্গ নেই। তবে সতর্ক থাকার জন্য বলেন। সন্ধ্যায় কার্বলিক সাবান মেখে গরম জলে ¯œান করে ঘরে ঢুকি।  
সকাল থেকেই রাস্তার দু’পাশ ধরে লালটুপিওয়ালা হোমগার্ড দাঁড়িয়ে আছে। দু’তিনটি পুলিশের গাড়ির আনাগোনা, অন্যরকম তৎপরতা। এতদিন শরণার্থীরা নিজেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতো কিন্তু আজ বাইরের লোকজন এসে ঝাঁড় পোছ দিচ্ছে, যত্রতত্র বি¬চিং পাউডার ছড়াচ্ছে, ফিনাইল ঢালছে। শরণার্থী শিবিরের পরিচিত দুর্গন্ধ ছাপিয়ে সে এক অন্যরকম উগ্র গন্ধ বাতাস ভারি করে তুলেছে। এর মাঝেই জানাজানি হয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি আসবেন, শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে। এ শিবিরটি  খুব বড় নয় তবুও বিমান থেকে নেমে শহরের পথে প্রথম চোখে পড়া শিবিরটি দেখার  আগ্রহ যদি প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, তাই আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় এক কর্মকর্তা লাইব্রেরীতে এসে আমাদেরকেও সেখানে থাকার জন্য বললেন। আমাদের এই দলে আমি একাই শরণার্থী। তাই আমার দায়িত্ব নাকি আরো বেশি। দায়িত্ব কর্তব্য বিবেচনায় না এনে সর্বাগ্রে কৌতুহলের তাড়নাতেই তাৎক্ষণিক চলে গেলাম স্কুলে। ততক্ষণে সামনের মাঠে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। হাড় জিরজিরে দরিদ্র সব লোক, মলিন পোশাক পরিচ্ছদ। প্রধানমন্ত্রী কি জিনিষ তা তাদের বোধগম্য নয়। ইন্দিরা গান্ধী বললে, সেটি বুঝতে পারে। এমন  প্রান্তজনদের সামনেই আজ উপস্থিত হবেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী, একি বাস্তব না অন্য কিছু। ছোটখাটো মহড়া হয়ে গেলো। মহিলারা উলুধ্বনি দেবে। জয়বাংলা, ভারত- বাংলাদেশ মৈত্রী জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধি জিন্দাবাদ কয়েকবার আগাম বলে ঠিকঠাক করে নেয়া হলো। হীণ বল ক্ষীণ দেহে বেশ  জোরে শোরেই গলা থেকে আওয়াজ বেরুলো। একটি শঙ্খও জোগাড় করা হয়েছে। কেউ কিছু বলতে চায় কিনা তাও জিজ্ঞাসা করা হলো। যারা কোনদিন চেয়ারম্যান,মেম্বারের সাথে সাহস করে কিছু বলতে পেরেছে কি না সন্দেহ , তারা কথা বলবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে? না, তারা শুধু চোখ ভরে দেখতে চায়। গান্ধী নামের এই মানবীকে নয় স্বাক্ষাৎ দেবীকে।
এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে একটা পাইলট ভ্যান হুইশেল বাজাতে বাজাতে এসে থামলো। সেনাবাহিনীর একটি জিপ। তার পিছনেই ইন্দিরা গান্ধির গাড়ি। পুলিশের গাড়ি,এ্যামবুলেন্স। আরো দু’একটি জিপ,এমব্যাসেডার। বিশাল গাড়ি বহর নেই। নিরাপত্তারও তেমন কোন বাড়াবাড়ি নেই। নেই নেতাকর্মীর হুড়াহুড়ি কুনোকুনি। একেবারেই সাধারণ ভাবে গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে সদ্য নির্মিত ছোট্ট একটি ডায়াসে গিয়ে উঠলেন। সামনে কিছুটা ফারাক রেখে বাঁশের খুঁটিতে দড়ি বেঁধে শরণার্থীদের জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে স্থানীয় লোকজন। অনেকে ভিতরেও ঢুকে পড়েছে। উলুধ্বনি হলো, শঙ্খও বাজলো। শে¬াাগানও হচ্ছে। এই প্রথম চাক্ষুষ ইন্দিরা দর্শন। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক মহিয়সী নারী। তাও একেবারে হাতছোঁয়া নাগালের মধ্যে। মাঝারি আকারের গড়ন। গায়ের চামড়ায় কাশ্মিরী মসৃনতা। পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি, থ্রি কোয়ার্টার সাদা ব্লাউজ। কাঁধের উপর পর্যন্ত ছোট করে ছাঁটা চুল, সামনের দিকে ঢেউ খেলানো কিছু চুল সাদা। মনে হলো রূপা দিয়ে বাঁধানো। টিকালো নাক, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী । পরিচ্ছন্ন পরিশীলিত রুচিবোধ আর চোখেমুখে প্রখর ব্যক্তিত্বের প্রকট প্রকাশ। এতোবড় দেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এখন লড়ছেন অন্য এক যুদ্ধ। বাংলাদেশের জন্য। তিনি জানেন তাকে একাই লড়ে যেতে হবে। ঝড় ঝঞ্ঝাময় এক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইন্দিরার জন্ম। বিদ্রোহ আর আন্দোলনের মধ্যেই তাঁর বেড়ে উঠা। মতিলাল নেহেরুর নাতনি, জহরলাল নেহেরুর একমাত্র কন্যা। যে পরিবারের সদস্যরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত সেখানে লালিত হয়েও তৈরী হয়েছেন আগামীদিনের কঠোর বাস্তবতা মোকাবেলায়। পরাধীন ভারতে  পিতা জহরলাল নেহেরুকে জেল খাটতে দেখেছেন। নিজেও জেলখাটার প্রস্তুতি হিসাবে অনেক সময় নরম বিছানার বদলে ইটে মাথা রেখে শক্ত মেঝেতে শুয়ে কাটিয়েছেন। এখন স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাজার সমস্যার মুখোমুখি। দলেও ভাঙন। কিছুদিন আগে বাবার বয়সী কামরাজ, নিজালিং গাপ্পা, চ্যবন, সঞ্জিবরেড্ড্,ি মোরারজি দেশাইয়ের মতো নেতাদের বাদ দিয়ে গড়েছেন নতুন দল- নবকংগ্রেস। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত হু হু করে ঢুকছে শরণার্থী। অর্থনীতির উপর পড়ছে কঠিন চাপ। বৃহৎ শক্তি আমেরিকা- চীন পাকিস্তানের পক্ষে। পশ্চিমের ধনী দেশগুলি নীরব। রাশিয়া কেবল সমর্থন দিচ্ছে ভারতকে। সামনে আরো কঠিন দিন।
ছোট্ট অনুচ্চ ডায়াসে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে অভিনন্দন জানালেন। সামনের জনসমাগমে একটা ঢেউ খেলে গেল। কৈশোরে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থেকে শেখা বাংলায় প্রথম দু’এক লাইন বলে গেলেন। তারপর থেমে থেমে ধীরে ধীরে হিন্দিতে যা বললেন তাও প্রায় বাংলার মতোই্।Ñ “আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে সেটা আমরা জানি। আমাদের দেশও গরিব। আমাদের একা তা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আমাদের সাধ্য মতো সবকিছু করছি। বর্ডার খুলে দিয়েছি যাতে লোকজন প্রাণ বাঁচাতে পারে। আপনারা নিশ্চিত থাকুন আশ্রয় যখন দিয়েছি আপনাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে পাঠিয়ে দেব না। এ সমস্যাটি আমাদের একার নয়, কিন্তু বিশ্বের আর কোন দেশ এখনও এগিয়ে আসে নাই।” বক্তৃতার মাঝে মাঝে হাতের ছোট্ট রুমাল নাকের উপর আলতো করে বুলিয়ে নিচ্ছেন। বুঝা গেল বি¬চিং পাউডার আর ফিনাইলের তীব্র গন্ধের ঝাঁঝ গান্ধির টিকালো নাকেও পৌঁছে গেছে। কি আর করবেন । তিনি তো প্রকাশ্যে নাক সিটকাতে পারেন না। বক্তৃতা শেষে ডায়াস থেকে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে  শরণার্থীদের কাছে কিছু জানতে চাইলেন। কারো মুখে কোন কথা নেই, ভাষা নেই। কেউ কিছুই বলছে না। ওদের যদি মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা থাকতো, প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার মত মুখে ভাষা থাকত,তবে কি বলতো এরা ? বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও। আমার স্বামী-সন্তান, আমার ভিটে-বাড়ি ফিরিয়ে দাও। ভাল খাবার দাও। না, তা বলতো না। দারিদ্র, বঞ্চনা, অশিক্ষা, রোগ-শোকের দহন জ্বালায় পোড় খাওয়া অন্তরে কোন আবেগ থাকে কিনা জানি না। তবে এই পোড়া অন্তরের অন্তস্থল থেকে একটি কথাই হয়তো প্রাণের আকুতি হয়ে বেরিয়ে আসতোÑ বেঁচে থাকো মা।  দড়ির সীমারেখা আলগা হয়ে গেছে। কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, দু’হাত তুলে নমষ্কার জানাচ্ছে, কেউ লুটিয়ে পড়ছে, কেউ কাঁদছে হাউমাউ করে। কারো কান্না নীরবে । গান্ধির উজ্জ্বল মুখ ক্ষণিকের জন্য গম্ভীর হয়ে উঠলো, একটা কালো ছায়া যেন পড়লো। এই প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কোন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন। আজ আসামের আরো কয়েকটি শিবির পরিদর্শন করবেন । আগামীকাল ১৬মে ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির দেখে চলে যাবেন পশ্চিমবঙ্গের বনঁগা জেলার কয়েকটি শিবির পরিদর্শনে। ১৭মে দিল¬ীর উদ্দেশ্যে বিমান বন্দরে পৌছার আগে কোলকাতার সল্টলেক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন তিনি। সবচেয়ে বেশী শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে সল্টলেকে। মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত লক্ষ কোটি ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর  প্রতিনিধিত্বকারী উদারবন্দ নয়ারাম উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শরণার্থী শিবিরের মলিন দর্পনে প্রথমবারের মত ৭১এর শরণার্থী দর্শনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী  যা বোঝার তা বুঝে নিলেন, যা বলার সংক্ষেপে বলে গেলেন। শেষ বারের মতো আশ্বস্ত করলেন। Ñআপনারা ধৈর্য্য ধরুন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়িতে উঠলেন।
পরদিন ট্রাকে করে বাঁশ-টিন, কোদল খুন্তি এসে পৌঁছল। স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন তৈরী হবে। নূতন একটি টিউবওয়েল বসবে, এর সব সরঞ্জাম। রেডক্রসের দুটি গাড়ি ঔষধপত্র, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট নিয়ে গেটের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন থেকে নিয়মিত রেশনের সাথে শিশুদের দুধ বিস্কুট দেওয়া হবে। স্কুলের মাঠে ধবধবে সাদা তাঁবু পড়লো,- চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। দু’একটি বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠন কাপড়-চোপড় বাসনপত্র নিয়ে এলো। কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো শরণার্থী ক্যাম্পে। স্থানীয়দের মধ্যেও একটা স্বস্তির ভাব। ক’দিন সকালে  দুধ-বিস্কুট বিতরণ শেষে  বাসায় ঢোকতে গরম জলে ¯œান করার প্রয়োজন পড়লো না। শুধু সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুলেই চলে।
স্কুলের গেটে এখন হোমগার্ডের পাহারা। মাঠজুড়ে তিন ইটের সারিসারি চুলায় রান্নাবান্নার ব্যস্ততা দেখে বুঝা যায়, রেশন জুটছে নিয়মিত। চারপাশে উদোম গায়ে পুরুষ, স্বল্পবাসের নারী, উলঙ্গ শিশু চুলায় চাপানো হাড়িতে চোখ রেখে খাবারের অপেক্ষায় বসে থাকে। জ্বালানী কাঠের সংকট। দূরের টিলা, বন থেকে সংগ্রহ করে আনতে খেটে খাওয়া মানুষের তেমন অসুবিধা নেই। স্কুলের ভিতর থেকে একদিন ‘অ‘তে অজগর ‘আ‘তে আম আর নামতা পড়ার সুর ভেসে এলো। দেশে কারোরই পাঠশালায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। স্কুলও হয়তো দেখেনি কেউ। ভাগ্য বিপর্যয়ে একেবারে হাই স্কুলেই যখন ঠাই হয়েছে তখন আর বিদ্যা বঞ্চিত থাকা যায় না। চতুর্থমান পাশ দেয়া মধ্যবয়সী এক মহিলা বারজন ছাত্র নিয়ে নিয়ে বর্ণমালা আর নামতার পাঠ দিচ্ছেন। বইয়ের সংখ্যা অনুযায়ী ছাত্র। এক ঘণ্টা করে দুই শিফটে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে।্ শ্রেণী একটাই, প্রথম ভাগ। একই শ্রেণীর ছাত্র হলেও বয়স ৫থেকে ১৬। আরেকটু বেশী বয়সের দু’জন ছাত্রী আমাদের দেখে স্কুল ছেড়ে পালালো। বয়স্ক বেশ কয়েকজনেরও নাকি পড়ার আগ্রহ জেগেছে। আমাদের সেই লাইব্রেরী থেকে বারটি বর্ণমালার বই দেয়া হয়েছিল ক’দিন আগে। স্কুলবাসীর আচরণে বিদ্যানুরাগের কোন লক্ষণ পূর্বে দৃষ্ট হয় নাই। মনে হয়েছিল বইগুলি বুঝি জলেই গেল। মাঠের কাজ, ঘাঠের কাজ, ক্ষেতের কাজ না থাকায় এমন অলস অবসর কাটানোর জন্য বর্ণমালা আর নামতা শিক্ষা ছাড়া আপাতত আর কিছু সামনে নেই। আরো কয়েকটি বইয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।
অপর পক্ষে বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে আছে দু’মাস ধরে। শরণার্থীদের দখলে থাকায় অনেক স্কুল কলেজই বন্ধ। তবে এমন অবস্থা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য চলতে পারে না। যুদ্ধ কবে শেষ হবে আর জয়বাংলা মুক্ত হবে তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে। তাই বিভিন্ন স্থানে স্কুল কলেজ খালি করে শরণার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। করিমগঞ্জের বিরজা সুন্দরী স্কুল, বিপিনপাল স্কুল, ভিকমচান্দ স্কুলের শরণার্থীদের জায়গা দেয়া হয়েছে শহর থেকে দূরে নবনির্মিত সোনাখিরা, দাশগ্রাম, আলীপুর শিবিরে। কাছাড় জেলা জুড়ে আরো অনেক শিবির। কোনটি টিলার উপরে, কোনটি সমতলের উন্মুক্ত প্রান্তরে। বাঁশের খুটি তেরপালের ছাউনী দিয়ে সারিসারি ব্যারাক। চন্দ্রনাথপুর, চরগোলা, কাঠলীছড়া, লক্ষীনগর, শিলকুড়ি শরণার্থী ক্যাম্প। উদারবন্ধ নয়ারাম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শরণার্থীদের ঠাঁই হবে হয়তো এর কোন একটিতে। এক আশ্রয় ছেড়ে আবার ছূটবে নূতন আশ্রয়ের খুঁজে। আবার নূতন করে সংসার পাতবে নতুন কোন ঠিকানায়।
করিমগঞ্জ পর্ব
জ্যাঠামশাইরা বালাটের লালপানি থেকে চলে এসেছেন করিমগঞ্জে। বাবা আগের মতো একই কারণে এলেন না। সরল যুক্তি,
এদেরে ক্যাম্পে রেখে কি করে যাই ?
আমাদের এক কাকার পরিবার তখনও বালাট শরণার্থী শিবিরে। তাই তাদের সঙ্গেই বালাট ক্যাম্পে রয়ে গেছেন। খবর পেয়ে করিমগঞ্জ এলাম। শিলচর থেকে ট্রেনে করিমগঞ্জ। জয়বাংলার লোকদের টিকেট লাগে না। অনেক সময় শরণার্থী কার্ড, ক্যাম্পের কাগজপত্রও দেখাতে হয় না। ক্যারোলিন সার্ট, সুইস ঘড়ি, পারুমা জুতা ওপাড়ের লোকদের পরিচয় নিশ্চিত করে দেয় আগেভাগেই। এ মৌসুমে শহুরে লোকদের পায়ে রাবারের পাম্পসু পারুমা নেই, তবে গায়ে ক্যারোলিন শার্ট আছে। সুইস ঘড়ি বলতে নিদেন পক্ষে ‘কেমি’ তো বটেই। জাপানী সিটিজেন, রিকো, সিকোও রয়েছে। বুক পকেটে পাইলট, ইয়ূথ, উইংসাং ফাউন্টেন পেনও নজর কাড়ে। এসকল বিদেশী পণ্য ভারতীয়দের নাগালের বাইরে। আবার রুক্ষ, শুষ্ক চেহারার মলিনবেশী নারী-পুরষ, শিশু, বৃদ্ধের দল বেঁধে উ™£ান্তের মতো ছুটাছুটিতে বুঝা যায় সদ্য আগত শরণার্থী। সরাসরি পাঞ্জাবীর আক্রমণ থেকে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা লোকদের আচরণ দাবানলে আক্রান্ত প্রাণীর মতো ভীত সন্ত্রস্থ। আপ-ডাউন দুদিকের ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী জয়বাংলার। কেউ একাকী এদিক সেদিক ঘুরছে। কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে। কেউ দলবেঁধে জিনিসপত্র বুচকা বুচকি নিয়ে আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করছে।
মহকুমা শহর করিমগঞ্জ,অনেকটা সুনামগঞ্জের মতোই। কথাবার্তা, আচার-আচরণ, খাবার-দাবার, আপ্যায়ন, বাড়ি-ঘর সব কিছুই সিলেটি সংস্কৃতির অবিকল প্রতিরূপ। সুনামগঞ্জের মতো ঘরে ঘরে বাটা ভরা পান প্রাথমিক আপ্যায়নের অনিবার্য অনুসঙ্গ।  করিমগঞ্জের রিক্সায় বেল নেই, পেপ্ পেপ্ করে ভেঁপু বাজে। টেক্সির চলাচল আছে। আছে টেক্সি স্ট্যান্ড। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কুশিয়ারা সীমান্ত রেখা হয়ে পৃথক করে রেখেছে দু’দেশকে। স্বাভাবিক অবস্থায় দু’পাড়ের যাতায়াতে নদী তেমন বাধা নয়। সীমান্তের অচলায়তন টপকে জকিগঞ্জের রিক্সা চালক, দিন-মজুর এপাড়ের করিমগঞ্জ শহরে এসে রিক্সা চালায়, কাজ করে। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। জকিগঞ্জে পাকিস্তানী সেনাদের চলাচল চোখে পড়ে। লোকজন ধরে এনে নদীর পাড় ঘেঁসে তৈরী করছে বাংকার। চাঁদতারা পতাকা নিয়ে মিছিলও বের হয়। নারায়ে তকবির- আল্লাহু আকবার, পাকিস্তান জিন্দাবাদ শোনা যায় শহর থেকে। মাঝে মাঝে এপাড়েও এর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। বদরপুরে ভারতীয় ভূখন্ডে কারা যেন পাকিস্তানী পতাকা তুলে দিয়েছিল একদিন। একই ধরণের শ্লোগান দিয়ে মিছিলও হয়েছিল। এ নিয়ে দিনভর উত্তেজনা । পুলিশ এসে সামাল দেয়। দেশ ভাগাভাগি কালে পুরো কাছাড়ই নাকি পাকিস্তান ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। পুরো জেলা না হোক হাইলাকান্দি, বদরপুর ও করিমগঞ্জ তো বটেই। যদিও আসামের অনেক মুসলিম নেতা, কংগ্রেসের মঈনুল হোসেন, ফখরউদ্দিন আলী আহমদ এমনকি মুসলীম লীগ নেতা সাদ-উল্লাও পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন না। ভারত-পাকিস্তান সীমানা নির্ধারণ কালে কেন জানি রেডক্লিফের পেনসিল কুশিয়ারার বাঁকের সাথে   মিলে গিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই থানাগুলিকে ভারতে রেখে মৌলভীবাজারের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, কমলগঞ্জকে পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দাগ টেনে দেয়। সেই বঞ্চনার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে। সাতচল্লিশের পর কাছাড়ের অনেক মুসলিম পরিবার দেশত্যাগ করে  সিলেটে পাড়ি দিয়েছিলেন। উদ্বাস্তু হলেও সেখানকার রাজনীতি, আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রয়েছে তাদের। এদের অনেক আবার শরণার্থীর খাতায় নাম লিখিয়ে জন্মভূমে পরদেশী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। অনেকের অবশ্য নিজের বাড়িঘর রয়ে গেছে । কেউ কেউ ’মুক্তি’ হয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নেমে গেছে। কিন্তু এখানকার আদি কট্টরপন্থি অনেকেই পার্শ¦বর্তী পাকিস্তানকে ভরসার স্থল মনে করে সেদেশ ভেঙে যাক, তা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই জয়বাংলার সমর্থকদের প্রতিও কট্টরপন্থিদের চাপা অসন্তোষ।
করিমগঞ্জ শহরের প্রায় সকল স্কুল কলেজই শরণার্থীতে ঠাসা। বিরজাসুন্দরী হাইস্কুল, বিপিন পাল স্কুল, ভিকম চাঁন্দ হাইস্কুলে সিলেট শহরের অনেক হিন্দু মুসলিম পরিবারের আশ্রয়, মনিপুরী পরিবারও আছে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও আশ্রয় জুটেছে অনেকের। হিন্দি স্কুলে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আস্তানা। বরুণ রায়, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ইকবাল আহমদ চৌধুরী, গোলজার আহমদরা এখানে অবস্থান করছেন। পার্টির ছেলেদের তাদের লাইনে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছেন। ট্রেনিংয়ে পাঠানোর চেষ্টাও চলছে। আওয়ামীলীগ নেতা ফরিদ গাজী এমএনএ করিমগঞ্জে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে আছেন। তবে নিয়মিত ছোটাছুটি করছেন শিলচর, শিলং, ধর্মনগর। বৈঠক করছেন মাছিমপুর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে। সিলেট শহরের অনেক পরিবারই বাসা ভাড়া করে আছেন লন্ডনী স্বজনদের কল্যাণে। প্রবাসীরা মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে সার্বিক সহায়তা দিয়েছেন তেমনি শুধু নিকট আত্মীয়রাই নয় ছিটেফোটা আত্মীয়তায়ও পাউন্ডের সমর্থন মিলেছে। তাই অনেকেই আরাম আয়েশে থাকতে পেরেছেন। আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের আস্তানা গৌরী হোটেল। বেলা রেস্টুরেন্ট সরগরম সিলেটি আড্ডায়। বাঙালি মেজর সি.আর দত্ত  করিমগঞ্জে এসে শরণার্থী শিবির ঘুরে মুক্তিবাহিনীর জন্য লোক বাছাই করছেন। যে কোন দিন ডাক পড়বে, ট্রেনিংয়ে যেতে হবে আগরতলার কাছাকাছি কোন গোপন স্থানে। কারোর অধীর প্রতীক্ষা কখন ডাক আসবে। আবার কেউ সময় মতো নানা ছুতোয় কেটেও পড়েছে। তবে এগিয়ে চলছে সামরিক প্রস্তুতি। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা, এমএনএ এমপিএ’রা মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগাযোগ রেখে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে অস্ত্র, গোলাবারুদ, প্রশিক্ষণের জন্য আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশ্বাসও পাওয়া যাচ্ছে। বুঝা যায় এবার রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হবে। তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে উঠা বিক্ষিপ্ত, অসংগঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিছু হটতে হয়েছে বাঙালিদের। এখন যুদ্ধ কেবল প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নেই। এবার জয়ের জন্য লড়াই। এদিকে সীমান্তের কাছাকাছি শত্রু বাহিনীর উপস্থিতি থাকায় সামরিক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। রাতে কামানের গোলা, মর্টার শেলের দ্রিমদ্রিম আওয়াজ শোনা যায়। করিমগঞ্জবাসীও এ শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোন গোলাটি ‘মুক্তির’ আর কোনটি পাঞ্জাবীর সেটি আন্তাজ করে নিতে পারে।
মুক্তি ফৌজ বা মুক্তিবাহিনী এখানে শুধু ’মুক্তি’ নামেই পরিচিত। বেশ কিছু নতুন নতুন শব্দ এর মধ্যে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবী, বালুচ, পাখতুন, সিন্ধি এমনকি বাঙালি থাকলেও পাকিস্তান সেনাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাঞ্জাবী নামে অভিহিত করা হয়। মার্চের প্রথম প্রতিরোধ থেকেই পাঞ্জাবী শব্দের ব্যাপক প্রচলন এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত শরণার্থী এবং অবরুদ্ধ বাঙালি মাত্রেই আতংক, ভয় এবং ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করেছে এই শব্দটি। ভারতীয়রা কখনো পাঞ্জাবী বলতো না। এদেশেও পাঞ্জাব রাজ্য রয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট সামরিক কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিলেন ভারতীয় পাঞ্জাবের অধিবাসী। তাই এখানে পাকিস্তানী বাহিনী, পাকসেনা, খান সেনা আবার কখনো সংক্ষেপে শুধু পাকি। পাকিস্তান নামের পরিবর্তে তখনও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লোকমুখে জয়বাংলার প্রচলনই বেশি। সীমান্তে যেখানে পাকিস্তান বাজার সেটি জয়বাংলা বাজার। স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ সকল শব্দের অর্থ ব্যঞ্জনা এক শব্দে ধারণ করে রেখেছে ‘সংগ্রাম’। মহাকালের এক অবিনশ্বর স্মারক, অমলিন যুগচিহ্ন। সময়, স্মৃতি আর অনুভবকে ভাগ করে নিয়েছে এভাবেইÑসংগ্রামের আগে, সংগ্রামের পরে এবং সংগ্রামের বছর বা সংগ্রামের সময়।
করিমগঞ্জের শরণার্থী শিবিরে অনেক বিপর্যস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের দেখা মিলে। ২৬ শে মার্চ থেকেই সিলেটে পাঞ্জাবীদের আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। ২৭ মার্চ সকাল থেকে নির্ম্বাক আশ্রম, মীর্জ জাঙ্গাল এলাকায় ২৭টি মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল । অবস্থাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি তল্লাসী করে অনেককে ধরে নিয়ে যায় পাক সেনারা। ৪ এপ্রিল জিন্দাবাজার ন্যাশনাল ব্যাংক পাহারায় নিয়োজিত ৯জন বাঙালি পুলিশকে একই সঙ্গে হত্যা করে। মেডিকেল কলেজ আক্রমণ করে ডা. শামসুদ্দিনসহ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। শহরতলীর তারাপুর বাগান, খাদিমনগর, কালাগুলেও চলে নির্মম হত্যাকান্ড, ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে থানা সদরে। সড়ক যোগাযোগ থাকায় সহজেই পাঞ্জাবীরা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিকে। গোলাপগঞ্জ, ঢাকা দক্ষিণ, বিয়ানী বাজার, বালাগঞ্জ থানার রাস্তার পাশের গ্রামগুলি আক্রান্ত হয়। নিরাপদ ভেবে শহরের অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে। আক্রমণের ভয়ে পলায়নপর নিরীহ নারীপুরুষও রক্ষা পায়নি। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য আবার কোথাও নির্যাতনের শিকার হয়ে এপ্রিলের প্রথম থেকেই সিলেট অঞ্চলের লোকজন সীমান্ত পেরিয়ে আসতে শুরু করে। চারখাইএ সীমান্তমুখী শরণার্থী দলের উপর বিমান আক্রমণ চালানো হলে হতাহত হয় কয়েকজন। সীমান্তের কাছাকাছি হলেও দেশত্যাগের প্রস্তুতি নেয়ার আগেই বিয়ানীবাজারের সুপাতলা গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে মনোরঞ্জন ঘোষের এক পরিবারেরই ১৩ জনকে হত্যা করে পাঞ্জাবিরা।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বিরজাসুন্দরী হাইস্কুল ক্যাম্পে আশ্রিত এক পরিবারে মা-বাবার আহাজারিতে চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে আছে। সীমান্তের পথে গুলিবিদ্ধ একজন করিমগঞ্জ হাসপাতালে মারা গেলে সে পরিবারেও শোকের মাতম। গায়ে কাটা দেয়ার মতো অনুভব ছড়িয়ে যায় নবজাতক শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরা বিহ্বল এক মাকে দেখে। আসার পথে সন্তান প্রসব করেন তিনি। তাও জঙ্গলে। এ পরিস্থিতিতে অসহায় স্বামী সাহায্যের আশায় রাস্তায় উঠে এলে টহলরত পাঞ্জাবীর বুলেট ঝাঝরা করে দেয় সাহায্য প্রত্যাশী সদ্য পিতৃত্ব অর্জনকারী লোকটির দেহ। মৃত স্বামীকে রাস্তার পাশে রেখেই অন্য শরণার্থীদের সহায়তায় নবজাতককে নিয়ে এই ক্যাম্পে এসে ঠাই নেন এই হতভাগিনী মা।
এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরিতে সিলেটের অনেক পরিচিত জনের দেখা মিলে। কারো কাছ থেকে সুসংবাদ আশা করা নিরর্থক বরং অনেক নতুন দু:সংবাদ পাওয়া  গেল। প্রাণে বেঁচে থাকাটাই এখন ভাল খবর। জানা যায়, কি দুর্ভোগ দুর্গতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা এসেছেন। সেনা টহল এড়িয়ে, বনপথে ঝোঁপ-ঝাড়-জঙ্গল মাড়িয়ে কখনো নৌকা, কখনো রিক্সা, বেবীটেক্সি, পায়ে হেঁটে, অচেনা অপরিচিত গৃহে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটিয়ে কখনো রাতের অন্ধকারে এ পথ সে পথ ঘুরে তিন-চার দিনে চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। মানুষ  মানুষের জন্য এগিয়ে এসেছে। সাধ্যমত ঠাই দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, জাত-পাত ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। নিরাপদ পথ বাতলে দিয়েছে। তবুও কত দুর্ভোগ দুর্ভাবনা । দলের লোকজন এমনকি পরিবারের কেউ কেউ পথিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন পথে ভিন্ন দিকে এসে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। সে তুলনায় আমরা অনেক ভাগ্যবান। তখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জ হানাদার মুক্ত থাকায় শহর এবং আশেপাশের মানুষদের পক্ষে সীমান্ত অতিক্রম করা মোটামুটি নিরাপদ ছিল। প্রকৃতির কল্যাণে নৌচলাচলের সুবিধা এবং কাছাকাছি সীমান্ত আমাদেরকে অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করেছিল। মে মাসের ১০ তারিখ পাকসেনারা সুনামগঞ্জের দখল নিলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। সীমান্ত অতিক্রম করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরে শুরু হয় পাক বাহিনী ও সহযোগীদের তাণ্ডব। মানুষের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কেবল আতংক-ভয়-ভীতি আর দু:সহ দুর্ভোগ।
জ্যাঠতুতো দাদার বাড়ি করিমগঞ্জ শহরের কাছাকাছি নিলাম বাজারে। ট্রেন বাস দুটিতেই যাতায়াত চলে। স্বাধীনতা সংগ্রামী কাকা এবং এক পিসতুতো দাদা যারা দু’জনেই স্বদেশী করে জেল খেটেছিলেন, স্বাধীনতার পর জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয়ে দেশ ত্যাগ করে এখানে এসে সংসার পেতেছেন। একই জায়গায় আরো কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের বাস হওয়ায় নিজেদের নিয়েই এক নতুন সমাজ এখানে গড়ে উঠেছে। নিজ পুত্র ও স্বজনদের মাঝে জেঠামশাই, জ্যেষ্ঠমা’র কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পুকুর-ঘাট, উঠোন, গাছ পালা নারিকেল সুপারীর সারিতে একটা বাড়ি বাড়ি ভাব থাকলেও দেশের বাড়িতে গাথা পড়ে থাকা জেষ্ঠ্যমার মন, খারাপ থাকে সবসময়ই। আড়ালে চোখের জল মুছেন। আমার কাছে জানতে চান মঙ্গলি এড়ে বাছুর না বকনা বাছুর প্রসব করেছে। সন্ধ্যায় গোয়াল ঘরে ধুনা দেয়া হয় কি না। টুনুর মা, পাখির মা কি বালাটের ক্যাম্পে ঠিক মতো রেশন পাচ্ছে? ওখানে তো কলেরা দেখা দিয়েছে। ওদের কি অবস্থা হবে। কত দিনে যুদ্ধ শেষ হবে। এমন আরো কত প্রশ্ন।
আত্মীয়তা সূত্রে সিলেট সুনামগঞ্জের আরো কয়েকজন এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আসা যাওয়া করছেন কেউ কেউ। এখান ওখান থেকে নিয়ে আসেন সত্য মিথ্য খবরা খবর। রেডিও’র সংবাদ শোনা, পত্রিকার খবর আর যুদ্ধের আলাপ আলোচনায় এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতিও কিছুটা বদলে গেছে। আগে দশটা বাজার আগেই সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। এখন উঠোনে একত্রে জড়ো হয়ে রাত দশটার সংবাদ পরিক্রমা, দিল্লী, কলকাতা, আগরতলা কেন্দ্র ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনে সবাই। সংবাদের গুরুত্ব এবং প্রতিক্রিয়ায় কখনো ক্ষোভ কখনো উল্লাস আবার কখনো তর্ক বিতর্কে প্রচলিত রাতের নিরবতা এখন আর নিস্তরঙ্গ নয়। দূরে কোথাও ধুম করে গোলার শব্দে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় উঠোন সমাবেশে।
শিলচর ফেরার পথে আবার করিমগঞ্জ । খুঁজে বের করলাম আমার আরেক না দেখা পিসতুতো দাদাকে। এক সময় সুনামঞ্জে আমাদের বাসাতেই উনারা থাকতেন। পড়াশোনাও সেখানে। ভালো ফুটবল খেলতেন। আম্বিয়া ভাই (নুরুল হক আম্বিয়া) এর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। ফুটবলার কন্টর ভাই, সমশের ভাইয়ের সাথে দেখা হলে সবার আগে হিরা দা’র খবর জানতে চাইতেন। আমি নিজেই উনাকে চিনতাম না, দেখিনি কোনদিন। বছরে দু’একটি চিঠি আসতো তাও গুরুজনদের কাছে। তবুও বলে দিতাম- হ্যাঁ, ভালোই আছেন। একসময় নাকি হিরাদা, আম্বিয়া ভাই এবং সুনীল দা এই ত্রিরতেœর বন্ধুত্ব প্রবাদের মতো ছিল। একজন হিন্দু, একজন মুসলিম অপর জন খ্রিস্টান। তিন জনই সজ্জন, অমায়িক। দোষের মধ্যে একটাই, খেলা পাগল। অনেকদিন হয় ছাড়াছাড়ি। তবুও মনের গহনে একজন আরেকজনের কাছাকাছি। সুনামগঞ্জ টাউনক্লাবে খেলতেন । এখন সে ক্লাবটি আর নেই। সেই হিরা দাকে খুঁজে পেলাম করিমগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনে। এখনো বিয়ে থা করেননি। সমাজসেবা খেলাধুলা নিয়ে বেশ আছেন। বাসার বড়দের কাছে হিরাদার গল্প শুনেছি। খুব নাকি মজার মানুয আর কৌতুক প্রিয়। আমার নাম বললাম, -হারান, সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি। চিনতে পেরেছ? বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। ট্রাফিক পুলিশের মতো ডান হাত তোলে আমাকে থামিয়ে বললেনÑ আগে তোকে দেখে নেই। কোত্থেকে কি একটা এসেছিস। তারপর বলব চিনতে পারলাম কি না। অনেকক্ষণ আমার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে তীক্ষè পর্যবেক্ষণের পর তর্জনী নাড়াতে নাড়াতে বললেনÑতোর, তখন এক বৎসরও হয়নি, সে সময় আমি দেশ ছেড়ে এসেছিলাম। বাড়ির সকলের ছোট ছিলি তুই। আরো অনেক গোলগাল চেহারা ছিল । সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সব শেষে তোকে আদর করে ঘর থেকে যখন বেরিয়েছিলাম, তখন আমার খুব কান্না পেয়েছিল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম উনার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিয়ে বললেন, সেই যে কেঁদেছিলাম আর আজ চোখ মুছলাম। এই বলে হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর স্বভাব সুলভ রসিকতায় চেঁচামেচি করে আশেপাশের ক’জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,Ñ
এই দেখে যাও, আমাদের মিশনে এক রিফিউজি ঢুকে গেছে। দু’একজন ছুটেও এলো। আমাকে দেখিয়ে বললেন,-
আমার মামাতো ভাই। দু’হাত উপর-নিচ রেখে ছয় ইঞ্চির মতো জায়গা ফাঁক করে দেখিয়ে বললেন, এই এতটুকু দেখে এসেছিলাম।
নিজে নিজেই বলে যাচ্ছেন, আমরা তো উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলাম, ওরা এবার শরণার্থী। দেশ মুক্ত করে আবার নাকি চলে যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে।
যাবার সময় হলে তখন যাবি এখন খেতে চল। মিশনে খাবারের পাট শেষ হয়ে গেছে আগেই। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন হোটেলে। খেতে খেতে কত কথা। আত্মীয়-স্বজন কে কোন দিক দিয়ে এসেছে, কে কোথায় আছে। জিজ্ঞেস করলেন, রফিকুলবারী সাহেবের বাসার কথা, মামা সাহেব (ইউনূস আলী পীর) এর কথা, ভাই সাহেব (আব্দুজ জহুর এমপিএ) এর কথা। জানতে চাইলেন, আম্বিয়া ভাই, কন্টর ভাই ওরা এখনো খেলেন কি না। টাউন ক্লাব এখনও আছে কিনা। আরো কতো কিছু জানার- কি ব্যাকুলতা। বুঝলাম,এই মুহূর্তে তার  অন্তর জুড়ে কেবল সুনামগঞ্জের স্মৃতি টগবগ করছে।
বিকেলে জয়বাংলা একাদশ বনাম করিমগঞ্জ একাদশের ফুটবল খেলা। আমার শিলচর চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু যেতে দিলেন না। বললেন- খেলা শেষে তোকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরতে যাবো। আমারও খেলা দেখার আগ্রহ। না খেললেও সুনামগঞ্জের মানুষ মাত্রেই ফুটবলে অনুরক্ত। আমারও একই অবস্থা। আজাদী মোহামেডানের খেলা মিস করিনি কোনদিন। হিরা দা’র সাথে বেশ আগেই মাঠে উপস্থিত হয়েছি। সিলেটের ক’জন পুরনো সতীর্থের টানাটানি ও আমার আগ্রহে হিরা দা জয়বাংলা দলভুক্ত হলেন। এ নিয়ে করিমগঞ্জ সমর্থকেরা কিছুটা ক্ষুব্ধ। সুনামগঞ্জের এ-টিম ফিল্ডের মতোই করিমগঞ্জের মাঠ। চারদিক ঘিরে প্রচুর দর্শক, এরই  মাঝে দু দলে বিভক্ত হয়ে আছে। একদিকে জয় বাংলা অন্যদিকে করিমগঞ্জ করিমগঞ্জ বলে চিৎকার। জয়বাংলা ধ্বনির একটা আবেগ ও সতেজতা রয়েছে। অপরদিকে করিমগঞ্জ করিমগঞ্জ তেমন লাগসই হচ্ছে না। আর তাই জয়বাংলার সমর্থকই বেশি বলে মনে হয়। আসলে করিমগঞ্জ শহরে জয়বাংলার লোকের অভাব নেই। চারদিকে গিজগিজ করছে ওপার থেকে আসা লোকজন। আমার কাছাকাছি সবাই জয়বাংলার সমর্থক। হিরাদা’র সার্ট প্যান্ট ঘড়ি আমার কাছে গচ্ছিত। সজোড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছি। প্রথম গোলটি আমাদেরই হজম করতে হলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলেও গলার জোড় বেড়ে গেছে। দারুণ উত্তেজনা। হিরা দা’র পায়ে বল গেলে ক্ষুব্ধ করিমগঞ্জ সমর্থকেরা ’লাবড়া’ ’লাবড়া’ বলে দুয়োঁ ধ্বনি দেয়। একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম। খেলার মাঠে অনেকেরই অনেক নাম , হিরা দা’র ব্যাঙ্গাত্মক নাম এটি। আমরা গলা ফাটাচ্ছি জয়বাংলা বলে। আকাশ বাতাস তোলপাড় করে তোলছে জয়বাংলা। মাঠ ছাড়িয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে সারা শহরেই ছড়িয়ে পড়েছে, হয়তো নদীর ওপাড়ে পাঞ্জাবীর বাংকারেও। গগন বিদারী চিৎকার আর হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে একসময় গোল পরিশোধ হলো। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে হাতে রাখা বস্তুগুলি শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম। ভাগ্যিস মানিব্যাগটা পকেটে আর দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরে ছিলাম। ভারি প্যান্ট কোন রকম হাতে ফিরে এলেও হালকা হাওয়াই শার্ট হাওয়ায় ভাসতে গিয়ে উল্লসিত দর্শকদের উদ্বাহু নৃত্যের খপ্পরে পরে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে  শূন্যে ছুটাছুটি করে অবশেষে ভূমিতে পতিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে শতপদে দলিত হলো। অনেক কষ্টে পরে যেটি উদ্ধার করা গেল, সেটি আর শার্ট নয়, শার্টের ছিন্নভিন্ন লাশ। হাতে নেওয়ার মতো নয়।
খেলা ড্র। সম্মান বজায় রইল, তবে এমন কেলেঙ্কারী কাণ্ড ঘটিয়ে অপরাধীর মতো হিরা দ’ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উচ্ছসিত হিরা দা পিঠে সজোড় থাপ্পর বসিয়ে বললেন, সুনামগঞ্জের ছেলে তো, খেলার মাঠে ছাতা জুতো উড়িয়ে অভ্যস্ত। একটু ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম চোখে মুখে, দৃষ্টিটাও যেন কাছাকাছি নেই। দূরে, বহু দূরে কোথায়ও কিছু খোঁজে ফিরছে। মনে হলো এই মুহূর্তে তিনি বুঝি জন্মভূমির চিরচেনা সেই পুরনো মাঠে হারিয়ে গেছেন। বুকের গহন থেকে কয়েক বছরের দূরত্ব অতিক্রম করে  গভীর এক দীর্ঘশ্বাস   বেরিয়ে এলো। সকরুণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে  তাকিয়ে বললেন Ñ
সুনামগঞ্জের মাঠে এখনও এরকম হয় ?  
কলকাতা পর্ব-১
জেঠামশাইরা করিমগঞ্জে, এক কাকার পরিবার মেঘালয়ের সেলা বাজারে এবং আমরা শিলচরে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নিলেও বাবা তখন পর্যন্ত আমাদের আরেক কাকার পরিবারের সাথে বালাট ক্যাম্পে রয়ে গেছেন। সত্তরোর্ধ বয়সেও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় শরণার্থী শিবিরের দুর্ভোগ হয়তো কিছুটা সহনীয় হয়ে গিয়েছিল।  ছাত্র জীবনে স্কাউট, যৌবনে ডন বৈঠকে গড়া শরীর। স্কাউট জাম্বুরিতে বার্মার জঙ্গলে পথ হারিয়ে এক রাত্রি গাছে চড়ে কাটিয়েছিলেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ঘুরে বেড়ানোর অনেক গল্প শৈশবে বাবার কাছে শুনেছি। মাঝে মাঝে হার্নিয়ার ব্যথায় কষ্ট পেতেন। রান্নাবান্নার জ্বালানি সংকটে শিবিরের লোকজন যখন কাঠ সংগ্রহে পাহাড়ের টিলায় যেত তখন সকলের মানা সত্বেও বাবা তাদের সঙ্গি হয়ে কচুর লতা, কলার মোচা, কাঁঠালের ইচড় সংগ্রহ করে আনতেন। বাঙালি খাসিয়া বিরোধে বালাট শিবিরে কারফিউ চলাকালীন এক রাত্রিতে হার্নিয়ার ব্যথা প্রকট হয়ে উঠলে সবাই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বেশ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল সেবার। কলকাতা থেকে আমাদের দাদা যখন বালাট গেলেন তখন তার সাথে চলে আসতে এবার আর অসম্মতি জানালেন না। দা-মনি বাবাকে শিলচর নিয়ে এলেন চিকিৎসার জন্য।
অস্ত্রোপচারে রোগ নিরাময় হলো। শিলচরে অবস্থানকারী সবাই করিমগঞ্জের নিলাম বাজারের বাড়িতে চলে গেলেন। জেঠামশাই জেষ্ঠমা সহ সকলে আবার একত্রে বসবাস শুরু হলো। কেবল এক দিদি এবং আমি দা-মনির সঙ্গে কলকাতার পথে পাড়ি দিলাম।
শিলচর থেকে ট্রেনে দুই রাত্রি দুই দিনের পথ কলকাতা। গৌহাটি পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই পাহাড়ের উপর দিয়ে। নামটিও তাই সেরকম-পাহাড় লাইন। বদরপুর থেকে লামডিং পর্যন্ত উপরে উঠার পালা। সেখানে থেকে ক্রমে সমতল মুখী। সড়ক পথের মতো রেললাইন ইচ্ছে মতো আঁকা বাঁকা হতে পারে না। তাই অনেক পাহাড় এফোড় ওফোড় করে তৈরি হয়েছে সুরুঙ্গ। পাহাড় যথারীতি দাঁড়িয়ে আছে, সুরুঙ্গ পথে সেটি অতিক্রম করে যায় রেল গাড়ি। ছোট-বড় মোট সাতাশটির মতো সুরুঙ্গ রয়েছে এ লাইনে। সামনে পিছনে রেল ইঞ্জিন। একটি টানছে অপরটি ঠেলছে। ইঞ্জিনের কয়লার গুঁড়ো উড়ে এসে চোখে-মুখে পড়ে। জামা কাপড়েও কালো দাগ লেগে যায়।
বেশ আগে জেঠামশাইয়ের কাছে আসাম-বেঙ্গল রেল কোম্পানির কথা শুনেছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে আখাউড়া-কুলাউড়া-বদরপুর হয়ে লামডিং পর্যন্ত অনেক জায়গায় শাখা প্রশাখা খুলে দিয়েছিল এবিআর কোম্পানী। কেবল পাঁচ টাকার টিকেট কিনে সর্বত্র ভ্রমণ করা যেত। যাত্রীদের অধিকাংশই নাকি থাকতো চ্ট্টগ্রাম, নোয়াখালির। এখন আর কোম্পানির যুগ নেই। সরকারি সংস্থা, নর্থ ইস্টার্ণ রেলওয়ে। এখনো মনে হলো বেশিরভাগ যাত্রীই পূর্ববঙ্গের। টিকেট লাগলো না, তবে শরণার্থী হিসাবে নয়, দা-মনি ইস্টার্ণ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা। রেল ভ্রমণে রেলের চাকুরীয়ানদের অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। যদিও পূর্বাঞ্চলীয় রেলের সকল সুবিধা উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রযোজ্য নয়, তবুও আন্ত:ঞ্চল অলিখিত সমঝোতায় ম্যানেজ হয়ে যায় অনেক কিছু। রিজার্ভেশন বার্থও মিললো।
পাহাড়ের গা ঘেঁসে বাঁকানো লাইন ধরে, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় সংযুক্ত করা ব্রিজের উপর দিয়ে শূন্যে, ঘুটঘুটে অন্ধকার সুরুঙ্গের ভিতর দিয়ে গাড়ি ছুটছে। নিচে গভীর খাদ, দূর থেকে দূরে সারি সারি পাহাড়। বিরল জনপদ, দু’চারটি ছোটখাটো শহর। এগুলির কোনটি গড়ে উঠেছিল রেল লাইন নির্মাণকালীন সময়ে। দূরে পাহাড়ের ঢালে হঠাৎ এক পাল হাতিও দেখা গেল। বনমাঝে বন্যহাতি, এরকম দৃশ্যে
পুলকিত হবারই কথা। কিন্তু দৃশ্যমান সৌন্দর্যের আকর্ষণ ছাপিয়ে চলমান ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে মন ছুটে পিছন ফিরে। বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠি, প্রতিবেশী স্বজনদের স্মৃতি এসে ভিড় করে। শরণার্থী শিবিরের খুপরি ঘরে কেমন গাদাগাদি করে বসবাস করছে সবাই। বালাট বাজারের টং ঘরে রাত্রি যাপন, মহাদেব শীল টেইলারের ঘরে আড্ডা, কং এর চা স্টলে চা খেতে খেতে সময় কাটানো, উদারবন্দ নয়ারাম হাইস্কুলের শরণার্থী ক্যাম্প, বিনাপাণী লাইব্রেরির নতুন পরিচয়ের সঙ্গীরা, এসবই সাম্প্রতিক বিপর্যন্ত সময়ের বিচিত্র অভিজ্ঞতার স্মৃতি। জীবন্ত সজীব, মনের আয়নায় ঘুরে ফিরে ছায়া ফেলে।
শিলচরের ঠিকানায় দু’টি চিঠি পেয়েছিলাম। বালাটের পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। আগের মতো আড্ডায় অলস সময় কাটানো আর নেই। অনেক প্রতীক্ষা আর হতাশা কাটিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সুনীল শুক্লা, হিরন্ময় কর প্রথম ব্যাচেই চলে গেছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে। ফণী চন্দ, স্বপন রায়, বিজিত ভট্টাচার্য্য, অরুণ দে ওরা স্বেচ্চাসেবী হিসাবে যোগ দিয়েছে রেডক্রসে। আমার নতুন ঠিকানা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চিঠিপত্রে আর কোন খবরা-খবর জানা যাবে না। চলন্ত ট্রেনের কামরায় বসে এই প্রথম অনুভব করলাম কত দূরে সরে যাচ্ছি আমি। সবার কাছ থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি।
ট্রেন বদল করতে হলো দু’বার। এতক্ষণ মিটার গেজে চড়ে ছিলাম। গৌহাটি পেরিয়ে বঙ্গাইগাঁও হতে ব্রডগেজ রেলওয়ে। অনেক বড় কামরা, জায়গা অনেক। রেললাইনও অনেক চওড়া। এরই মাঝে দুই রাত্রি পেরিয়ে গেছে। সকাল বেলা গাড়ি ফারাক্কায় পৌঁছল। নব-নির্মিত বাঁধের উপর দিয়ে রেললাইন চালু হয়নি। গঙ্গা পেরুতে হয় ফেরী লঞ্চে। জ্যৈষ্ঠ শেষের বিশাল গঙ্গা। নদীর বুক জুড়ে শতশত জেলে নৌকা জাল ফেলে ইলিশ ধরছে। ইলিশ বলতে বরফে ডুবানো বাক্স বন্দী নরম সরম মাছই বুঝি। লাফানো ইলিশ এই প্রথম দেখলাম। ফেরীতে চায়ের স্টল, ভাতের হোটেল সবই আছে। ইলিশ ভাজির গন্ধে ম ম হয়ে আছে ভিড়ে ঠাসা ফেরী। খাবার সাধ জেগেছিল ঠিকই। ঝাঁকা ভর্তি হরেক রকমের, হরেক নামের আম নিয়ে ফেরিওয়ালা। বিচিত্র সুরে স্ব-স্ব পণ্যের রূপগুণের বর্ণনা দিচ্ছে। ডাব-নারিকেলও আছে। এক রুপিতে চারটে বড় আকারের আম। আমাদের এখানে যে গুলিকে মালদই আম বলা হয় এরকমই তবে নাম ভিন্ন, স্বাদ আর মিষ্টিও বেশি। আমের স্বাদে ইলিশ ভাজার বাসনা উবে গেল।
আসাম ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় ঢুকে গেছি ঘণ্টা কয়েক আগেই। সকল বিস্ময় অতিক্রম করে, অপার কৌতুহলে এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। ফেরীর বেঞ্চে বসে আছেন তিন-চারজন বীর পুঙ্গব। কুকুর বাঁধার শিকলের মতো চার-পাঁচ ফুট দীর্ঘ শিকল দিয়ে কোমরের সাথে রাইফেল বাঁধা। নকশালরা কখন ছিনিয়ে নেয় এই আতংকে রাইফেল পুলিশের এমন যুগল বন্দিত্ব। বিপ্লবের নামে পশ্চিমবাংলা জুড়ে চলছে খতমের রাজনীতি। রাজনীতি তো নয় খুনোখুনির মাতম। কে কোন দিকে কখন খুন হচ্ছে তার ঠিক নেই। জোতদার, মুনাফাখোর, বর্জুয়া, পেটিবর্জুয়া, রাজনীতিবিদ, পুলিশ টার্গেট এদের। মাঝে মাঝে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়, নিজেরাও মরে। প্রতিদিন গড়ে তিনজন পুলিশ খুন। খুন হোক, কিন্তু অস্ত্র যাতে সহজে নকশালদের হাতে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করতেই এই বন্ধন। ফেরী পেরিয়ে আবার ট্রেন। এবার ইস্টার্ন রেলওয়ে। রেল লাইনের দ’ুধারে সারি সারি আম গাছ। ধানক্ষেতের আল ধরেও আমগাছের সারি। ফলভারে বৃক্ষশাখা আভূমি নত হয়ে আছে। স্টেশনের প্লাটফর্মগুলিতে ভিড় করে আছে শরণার্থীর দল। কেউ গাড়িতে উঠবে আবার কেউ অস্থায়ী আবাস বানিয়ে তিন টুকরো ইটের চুলায় হাড়ি চাপিয়ে দিয়েছে। হিমালয় থেকে সুন্দরবন, পঞ্চগড় থেকে সাতক্ষিরা পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের সীমানা। যে যে দিকে পারছে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসছে। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, চব্বিশ পরগনা-সীমান্তের এই জেলাগুলির আশ্রয় শিবিরে আর ঠাঁই নেই। স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন, পরিত্যক্ত বাড়ি, খালি গোদাম ঘরে এসে জড়ো হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষের দল। ভিড়ের ফাঁকে স্টেশনের দেয়ালে বিশাল আকারের লেখা নজরে পড়েÑবর্ধমানে জোতদারদের গলাকাটা চলছে চলবে। দা-মনির বর্তমান কর্মস্থল বর্ধমান। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল বর্ধমানে নয়, আমরা কলকাতা থাকব। মফস্বলের দরিদ্র অনুন্নত এলাকা বিপ্লবের উর্বর ক্ষেত্র। কিন্তু আশ্চর্য্যজনক ভাবে নগর কলকাতায়ও বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে গেছে তীব্রভাবে। তবুও রাজধানী বলে কথা। পুলিশ, সিআরপি  (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ), মেট্রোপলিটন পুলিশের অভাব নেই। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভাবা যায়।
এতোদিন কলকাতা নামে যে রোমাঞ্চ জড়িয়েছিল প্রথম দর্শনে তেমন অনুভূত হলো না। পুরনো সব বাড়ি ঘর, লোনা ধরা দেয়াল, সেগুলি আবার সারা গায়ে বিপ্লবী স্লোগানের উল্কী পড়ে আছে। মার্কস, লেলিন, মাও সে তুং এর বাণীতে আকির্ণ। কোন কোন এলাকা একেবারে চেয়ারম্যান মাওয়ের খাস তালুক বলেই মনে হয়। গলির পর গলি, তস্য গলি। হেমন্ত মুখার্জীর গানের কলি শুধু যে মনে পড়ল তা নয়, ভিতর ঠেলে গলা ফুড়ে বেরিয়ে এলোÑ‘এখানে অন্ধ গলির নরকে মুক্তির আকুলতা।’ রাজপথে পিঁপড়ের সারির মতো মানুষ কিলবিল করছে। জন ভারাক্রান্ত শহরের রাস্তাঘাট এমনিতে নোংরা, এখানে সেখানে আবর্জনার স্তূপ। পাঁচ মিনিট অন্তর শিয়ালদা স্টেশনে একেকটি লোকাল এসে থামছে। এর ভেতর থেকে হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে ত্রস্তপদে নিমেষেই জনারণ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।
একসময় কলকাতা ছিল অবিভক্ত ভারতের রাজধানী। রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। ব্রিটিশেরা লন্ডনের আদলে গড়ে তুলেছিল এই নগরী। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, চাকচিক্য আর জাঁকজমকে তিলোত্তমা কলকাতা। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডে ব্যতিব্যস্ত ইংরেজ সরকার কলকাতা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তর করে নেয়। তখন থেকেই ভাগ্য বিড়ম্বনার সূত্রপাত। দেশভাগের পরে উদ্বাস্তুর চাপেও শ্রীহানি ঘটে এই শহরের, এমন অভিযোগ করে থাকেন স্থানীয়রা। শিয়ালদা জুড়ে যে বস্তির জঙ্গল তা ’৪৭ এর উদ্বাস্তু সৃষ্ট। নগরীর যত্রতত্র রিফিউজি কলোনি, উদ্বাস্তু পল্লী ছড়িয়ে আছে। এবারও ফের ধাক্কা খেল কলকাতা। পূর্ববঙ্গের শরণার্থীর চাপে নয়, বিপ্লবের আগুনে পুড়ে। অনেক কলকারখানা বন্ধ। শিল্পপতিরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কোম্পানির হেড অফিস স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লী। বাঙালি পুঁজিপতিরা নিজ শহর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। দারুণ অর্থনৈতিক মন্দা। প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা। রেশনের দোকানে লাইন ধরে মোটা চাল কেনা হয় আশি টাকা মণ দরে। প্রতি কামড়ে কাঁকর। দু’বেলা রুটি এক বেলা ভাত। খোলা বাজারে একশ টাকা মণ চাল। সেটি খাওয়া চলে। তবে রেশনের দোকানে লাইন ক্রমে দীর্ঘ হয়। সরিষার তেল, মসুরির ডাল ৫ টাকা কিলো। জীবন সংগ্রামে হিমসিম খেয়ে ওরা বেঁচে আছে অনেক কষ্টে। তবুও হেমন্তের সেই একই গানের কথার মতো কলকাতাকে একেবারে প্রাণহীন শহর মনে হলো না। মৃত্যুর বন্ধ দুয়ারেও জীবন এসে কড়া নাড়ে। প্রাণ আছে বলেই ভারতবর্ষের সব প্রান্তের মানুষ এসে ভিড় করে এখানে। পূর্ববাংলার শরণার্থীরাও আসছে জীবন বাঁচাতে। পুরনো উদ্বাস্তু সমস্যা মাথায় নিয়ে ঠাঁই দিচ্ছে নতুন শরণার্থীদের। সকাল হতেই ভাতের ফেনের জন্য অলিতে গলিতে ভিখারির মিছিল। আবার রাজপথে পূর্ববাংলার মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে গণসংগীত গেয়ে মিছিল, দুটিই আছে। আছে চিত্র প্রদর্শনী, শিল্পকলা, কবিতা, গান, কফি হাউজের আড্ডা, সিনেমা হলে ভিড়, রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠান, শতরজনী অতিক্রম করা থিয়েটার নাটক। স্কুলের ছোট্ট ছেলে মেয়েরা পথে পথে ঘুরে হাত পেতে টাকা পয়সা জিনিসপত্র সংগ্রহ করে তুলে দেয় ত্রাণ কমিটির হাতে। কোথাও রাস্তার মোড়ে একখন্ড কাপড় পাথর চাপা দিয়ে রাখা। পাশে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বস্ত্রখন্ডে জমা হতে থাকে দশ নয়া, পঁচিশ নয়া, এক রুপি, দু রুপি। দিন শেষে তুলে এনে জমা করা হয় শরণার্থী ফান্ডে। সন্ধ্যায় সুবোধ মল্লিক স্কয়ার, হাজরা পার্ক, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের অনুষ্ঠানে শিল্পীরা গায় মুক্তিযুদ্ধের গান। এখানে সেখানে মাইকে বেজে উঠেÑশোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি…..। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলন করে রক্ত দেয় মানুষ। শরণার্থীর চাপে অর্থনৈতিক সংকট সামালাতে ডাক মাসুল, সিনেমার টিকেট, রেলের টিকেট এমনকি সংবাদপত্রেও সারচার্জ বসানো হলে, এ নিয়ে প্রতিবাদ করেনি কেউ। পঁচিশে মার্চ হতে পূর্ববাংলায় গণহত্যা শুরু হলে এর প্রতিবাদে বন্ধ ডাকে কলকাতা। স্বতস্ফূর্ত বন্ধ। লাল ঝান্ডা আর তেরঙ্গা ঝান্ডার প্রভেদ থাকে না আর। বিচিত্র আর বহুরূপী এ শহর। এতোকিছুর পরও এক মোহনীয় মায়ার টান, অন্যরকম আকর্ষণ বোধ রয়ে যায় সাধারণের মনে।
কলকাতা পর্ব ২
একদিকে আমহার্স্ট স্ট্রিট অপরদিকে কলেজ স্ট্রিট। আরেক দিকে বউ বাজার স্ট্রেট, অন্যদিকে মির্জাপুর স্ট্রেট। মধ্যে কলকাতার এমন এক জায়গায় ঠাসাঠাসি করে আছে অসংখ্য অলিগলি। এর একটি গলি কানাই ধর লেনের ৫/১ বাড়িটি জেঠতুতো দিদির। আমাদের প্রজন্মের সবার বড়। ঠানদি বলে ডাকে সবাই। অন্যদিকে আমি কনিষ্ঠ বিধায় বয়সের ব্যবধান অনেক। দু’তিনটে ভাগনে ভাগনিও আমার বড়। মায়া মমতা সরলতায় জেষ্ঠমার দ্বিতীয় সংস্করণ। কলকাতার লোকজন সম্পর্কে অনেককের ধারণা, আত্মীয় বিমুখ করা। সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বড় অর্ন্তমূখী। এবারের এই দুর্যোগে শরণার্থী আত্মীয় স্বজনদের আত্মীয় বলে স্বীকারই করেনি কেউ কেউ। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, না চেনার ভান করেছে। অনেক ভগ্ন হৃদয় এমন বেদনাময় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। হতাশা আর অপমান সহ্য করে বাধ্য হয়েই দূরে সরে গেছে। এমন ঘটনা যে কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটেনি, তা নয়। কথা গুলিও হয়তো অনেকাংশে সত্য। তবে এই অর্ন্তমূখীতায় একতরফা দোষ দেওয়া যায়না তাদের। এরাও এক সময় ছিন্নমূল হয়ে এসেছিল। এখন হয়তো উদ্বাস্তু নাম ঘুচে গেছে। কিন্তু প্রথম দিককার সেই উদ্বাস্তু জীবনের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। সে ক্ষত রয়ে গেছে এখনো।
দেশের যাদের বাড়ি-ঘর, পুকুর, বাগান, ক্ষেত-জমি ছিল তাদের অনেকেই এখানে এসে ভাগ্য বিড়ম্বনায় শিয়ালদহের প্লাটফর্মে, ফুটপাতে ঠাঁই নিয়েছিল। আশ্রয় বলতে সেখানেই সীমা চিহ্নিত করে দেওয়া এক একটি জায়গা। পাউডার গোলা দুধের জন্য, বাড়তি একটু চালের জন্য, চিহ্নিত পরিসর আধহাত বাড়ানোর জন্য শিক্ষিত, মার্জিত, মধ্যবিত্তবিত্ত পরিবারের মানুষেরা কেমন হন্য হয়ে উঠেছিল তখন। রোগে মিলেনি চিকিৎসা, পায়নি সেবা, একনকি মমতা মাখা কোন সান্তনার কথা শোনাতেও এগিয়ে আসেনি কেউ। দেশ বিভাগের স্বাধীনতা মানুষকে রাতারাতি কেমন অসহায় করে তুলেছিল। অনেক ক্ষেত্রে অমানুষও। সামাজিকতা, আত্মীয়তা, আন্তরিকতা প্রদর্শনের জন্য কে কোথায় কখন আর সুযোগ পেল। নিধসঙ্গ সারথীর মতো কেবল জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার নিরন্তন সংগ্রাম। সময় আর পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছে আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর হতে।
আমাদের পরিবারের যারা পঞ্চাশের দশকে জন্মভূমি ছেড়ে, মা-বাবার ¯েœহ-মমতা বঞ্চিত হয়ে, পারিবারিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরের কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিলেন, তারা এসেছিলেন এই ঠানদিকে কেন্দ্র করেই। ভগ্নিপতি মহেন্দ্র লাল সেন এসেছিলেন আরো আগে। নোয়াখালির দাঙ্গা তাড়িত হয়ে। কিছু শিক্ষা-দীক্ষা থাকায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভাগ্যগুণে করণিকের একটি চাকুরী জুটে গিয়েছিল। আর তাতেই কানাই ধর লেনের ছোট্ট বাড়িটি আশ্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। উদ্বাস্তু হয়ে আসা দাদাদের প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তির পেছনে ঠানদির শুধু বড় বোনের দায়িত্ব পালন নয়, মায়ের মমতাও ক্রীয়াশীল ছিল। এর প্রমাণ পেলাম দুই ভাই বোন একাত্তরে শরণার্থী হয়ে এসে। আশ্রয় কেন্দ্রের সে দরজাটি খোলা কুড়ি বছর পরেও। ভগ্নিপতিও ছিলেন সহজ-সরল আর উদার মনের মানুষ। দীর্ঘদিন কলকাতা বাসের পরও কলকাতার ভাষা আয়ত্ব করতে পারেননি দু’জনের কেউই। আয় রোজগার ভালোই ছিল। ৭-৮ জনের পরিবারে আরো সচ্ছলতা-স্বচ্ছন্দ আসতো যদি বড় ভাগ্নেটি সময় মতো একটি চাকুরী-বাকুরী জুটিয়ে নিতে পারতো। কলকাতার চাকরীর বাজারে আক্রা। সারা রাজ্যের কর্মহীনেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কলকাতায় এসে। ঘরে ঘরে বোর। মহার্ঘ্য চাকুরীর নাগাল পাওয়া থেকে বিপ্লবী হওয়া অনেক সহজ। তাই ঘরে ঘরে নকশাল। পাইপগান, পেটো (বোমা), নিয়ে ছুটাছুটি না করলেও পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে বড় ভাগ্নে দ্বীপালের। কখন সিআরপি’র ঘেরাওয়ে বেঘোরে প্রাণ যায় সে ভয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আসামে। অর্থাৎ করিমগঞ্জের নিলাম বাজারে। যেখানে জড়ো হয়ে আছেন শরণার্থী হয়ে আসা আমাদের পরিবারের আরো কয়েকজন।
মাওসেতুং মার্কস বাজারে কি এক নতুন ব্যাখ্যা দিলেন আর তাতেই শুরু হয়ে গেল মারামারি খুনোখুনি। চারু মজুমদার, সৌরেন বসু, কানু স্যান্নাল, আজিজুল হক জঙ্গল সাঁওতাল, অসীম চ্যাটার্জীরা দল ছেড়ে খতমের লাইন ধরে নতুন পার্টি গড়লেন। নকশাল বাহিনী থেকে শ্রেণী শত্রু খতমের সূত্রপাত হলেও ছড়িয়ে পড়লো পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেললিস্ট থেকে শুরু করে পাড়ার রকবাজ, রাতারাতি বিপ্লবী বনে গেল। সারদিন রকে বসে আড্ডা দিত, মেয়েদের দেখে সিটি মারতো তারা এখন দেয়াল লেখেÑ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’ ছাপ মারে মাওসেতুং এর মুখাকৃতির। আরো সক্রিয় যারা যেখানে সেখানে ধুমধার পেটো ঝাড়ছে, পাইপগান নিয়ে ছোটাছুটি পুলিশের সাথে যুদ্ধ। আগুন খেকো বিপ্লবীদের প্রায় নেয়া আর প্রাণ দেয়ার এ এক মহোৎসব। কদিন আগে একই দলে ছিল আজ তাদেরও খুন করতে হবে। ওরা যে সোধনবাদী। কংগ্রেস তো বর্জুয়াদল। প্রতিদিন খুন হচ্ছে সিপিএম, কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতারা। নিজেরাও মরছে পুলিশের গুলিতে, জেল থেকে প্রিজন ভ্যান থেকে পালাতে গিয়ে, নিজের বোমায় নিজেই, আরা লাইন চ্যুত্তি বা পার্টির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতার অভিযোগে। চীনা সংযোগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ওরা বৈরী। অনেক জায়গায় নকশাল পন্থীরা শরণার্থীদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠে। কলকাতার দেয়ালে লেখা হয়Ñ‘দুই কুকুরের লড়াইয়ে পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা বিভ্রান্ত হবেন না, ইন্দিরা-ইয়াহিয়া শ্রেণীগত তফাত নাই, দুই বোতলে একই মদ’ ইত্যাদি। প্রায় একই সময়ে আমাদের দেশের অনেক স্থানে নকশালবাড়ির আগুনের আঁচ লেগেছিল। তবে বিপ্লবী আবেগের তাপ চাপা পড়ে গিয়েছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে, সত্তরের নির্বাচনে, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের ডামাডোলে। নির্বাচনের আগে সুনামগঞ্জ মাতৃমঙ্গলের দেয়ালে একটি লেখা চোখে পড়তোÑ‘বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎস।’ এইচএমপি স্কুল, বুলচান্দ স্কুলের দেয়ালেÑ‘নকশাল বাড়ির লাল আগুন পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দাও, চেয়ারম্যান মাও লাল সালাম’ এ ধরণের লেখা দেখা যেতো। চীনপন্থী ন্যাপ কিছুটা বিপ্লবী ভাবাদর্শের ভোটের আগে ভাত চাই বলে সত্তরের নির্বাচন থেকে সরে গিয়েছিল। দলীয় প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে শরণার্থী হয়ে ভারতে অবস্থান করলেও তার দলের সম্পাদক পাকিস্তানীদের পক্ষে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের অনেক গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসাবে আখ্যায়িত করে কখনো পাঞ্জাবীর বিরুদ্ধে আবার কখনো মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। কেউ কেউ পাকসেনাদের গণহত্যা, নারী নির্যাতন সমর্থন করে তাদের সহযোগি হয়ে উঠে। রাশেদ খান মেননেরা চীনপন্থী হিসাবে পরিচিত হলেও কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি নামে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এদের সহযোগিতা নেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনীহা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের প্রধান এবং প্রভাবশালী বিরোধী দল সিপিএম’র আশ্রয় প্রশয় পেয়েছে তারা।
বিশাল শহর কলকাতা। এপাড় বাংলা ওপাড় বাংলার মানুষে একাকার হয়ে আছে। কেউ করো দিকে তাকানোর সময় নেই। সবাই সবার মতো ছুটছে। এর মাঝে আমি এক অকিঞ্চিতকর, ইতস্তত ঘোরাঘুরি ছাড়া এখন কোন কাজ নেই। সকাল বেলা আলু মটরের ঘুঘনি দিয়ে আস্ত একটা ফিরপো পাওরুটি আর চা খেয়ে বেড়িয়ে পড়ি। সকালের খাবারে পাউরুটি আভিজাত্যের দিকে একধাপ উপরে। গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেল প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের নিজস্ব কনফেকশনারীতে প্রস্তুত সতেরো নয়া পয়সা দামের ফিরপো আরেকটু কুলীন। কিন্তু পাউরুটিতে তেমন অভ্যস্ত নই। আস্ত একটা খাওয়াও যায় না। ঠানদি জোর করে খাইয়ে দেন। ধমক দিয়ে বলেন,‘দুধ স্বর ঘি আর গন্ডা গন্ডা মাছ ভাজা এখানে পাইবি না। আমরা যা খাই পেট ভরে তা’ই খাইতে হইবো। ট ুটু কইরা তো ঘুরবি, ক্ষুধা লাগলে তখন কি করবি।’
কাটখোট্টা রুক্ষ-সূক্ষ কলকাতার কেন্দ্রস্থলে একেবারে গ্রামীণ সরলতা আর মমতা মাখানো এমন বকুনি শুধু পেট ভরিয়ে দেয় না, মনও ভরিয়ে দেয়। আশ্রিতের হীনমন্যতা তখন আর থাকে না।মরমী এক অধিকার আপনা থেকেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নেয়।
কথাবার্তায় বাঙাল টান আর উচ্চারণ মুখে মুখে বয়ে নিয়ে চলছে পূর্ববঙ্গাগত প্রায় সকলেই। সিলেটি টান আরো বেশি প্রবল। সহজে পিছু ছাড়ে না। জন্মমাটির দীর্ঘ বিচ্ছেদ জন্ম ভাষা অনেকটা ভুলিয়ে দিয়েছে। সিলেটি ভাষা এখন আর ঠিক মতো বলা যায় না। আবার কলকতার ভাষাও রপ্ত হয় না। দুয়ে মিলে জগাখিচুড়ি ভাষার সৃষ্টি। ঠানদি’র কথাবার্তা নিয়ে ভাগ্নে ভাগ্নিরা আগে থেকেই হাসাহাসি করতো। আমরা দু’জন এসে যোগ দেয়ায় তার আরো বিস্তৃতি ঘটলো। ঘটি বাঙাল সনাক্তকরণে ভাষাটাই প্রথম চিহ্ন। শরণার্থীর বেলাতেও তাই। কথাবার্তা শোনে ধরে নেয়া যায়, জয় বাংলার লোক।
সহায় সম্পদ হারিয়ে রিক্ত নি:স্ব হয়ে, রোগ, শোক, ক্ষুধা, মৃত্যুর সাথে মাখামাখি করে বসবাস হলেও মনের গহনে ধারণ করে রাখা স্বাধীনতার আখাংকা আর চোখে মুখে দেশপ্রেমের দীপ্ত প্রকাশ শরণার্থীদের শুধু আশ্রিতের করুণা নয়, অন্য এক মর্যাদায়ও অধিষ্ঠিত করেছে। নাক সিটকিয়ে এখন আর কেউ বাঙাল বলে না। বরং সহমর্মিতা জানিয়ে কৃতার্থভাবে কিছুটা সমীহ আর বিস্ময় ধরে তাকায়। দেখে, ইতিহাস সৃষ্টি এই বাঙাল শরণার্থীদের যারা লড়ছে জীবনের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। শরণার্থী শিবির থেকে যুব শিবির, প্রশিক্ষণ শিবির। লড়ছে কেবল রণাঙ্গণে নয়, সামাজিক সাংস্কৃতিক সেক্টরে, ক্রীড়াঙ্গণে, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে। বিশ্বরাজনীতিতে তুলেছে অভূতপূর্ব আলোড়ন।
দু’চারদিনের চর্চায় অলিগলির গোলক ধাঁধা পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট, বউ বাজার স্ট্রিট, মহাত্মা গান্ধী রোডে ঘোরাঘুরি করে আবার নিরাপদে ফিরে আসা রপ্ত করে নিয়েছি। গলির মুখ লাগোয়া আমহার্স্ট স্ট্রিট, শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। কলেজ স্ট্রিটের একপাশ জুড়ে মেডিকেল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশাল ক্যাম্পাস। আরেক পাশে কলেজ স্কয়ার, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট। কলেজ স্কয়ারের সুইমিং পুলের চারধারে বসার জন্য লোহার তৈরী হেলান বেঞ্চ পাতা। এর পাশাপাশি কয়েকজন মনীষীর মুন্ডুবিহীন প্রস্তুর মূর্তির উৎকট অবস্থান। রাজা রাম মোহন, বিদ্য্সাাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, আশুতোষ মুখার্জী এরা সব বর্জুয়া। খতমের তত্বে এদের গলা সর্বার্গে কর্তনযোগ্য। কিন্তু সবাই তো গত হয়েছেন অনেক আগেই। তাতে কি? মুন্ডুপাত হলো সকল স্ট্যচুর সরকারী ট্রাম বাসের গায়ে লিখি লিখে জানানো হচ্ছে আকুল আবেদনÑ‘নিজে বাঁচুন, অপরকে বাঁচতে দিন। হিং¯্রতা বর্জন করুন।’ বোমার শব্দ মিলিয়ে গেলে ভয়টা কেটে যায়। কিন্তু চারদিকে এমন খোলামেলা হিং¯্রতা বর্জনের আহবান, অপরকে বাঁচতে দেয়ার আবেদন, নিজেকে বাঁচিয়ে বরাখার পরামর্শ এসব দেখে একটা স্থায়ী আতংক মনে বাসা বেঁধে ফেলে। কে আর পাত্তা দেয় এই আবেদন নিবেদনে। দৈনিক সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে যেমন থাকছে, বাংলাদেশের পাক বাহিনীর নৃ:সংসতা, শরণার্থীর ঢল, আশ্রয় শিবিরের দুর্ভোগ, রণাঙ্গণে মৃক্তি বাহিনীর সাফল্যের খবর, পাশাপাশি তেমনি পশ্চিমবঙ্গের খুনোখুনি, নকশাল ধৃত, বন্দি ছিনতাই এমন খবরও আছে। বোমা ফাটানোর বিরাম নেই। আছে পাইপ গানের ঠুসঠাস আওয়াজ। মাঝেমাঝে পাড়া রেইড হলে সিআরপি’র কালো ভ্যান বোঝাই করে চালান হয়ে যায় ছাত্র-তরুণ-যুবক। কেউ ছাড়া পায়, কেউ জেলে পঁচে। কারো ভাগ্যে আরো খারাপ কিছু ঘটে যায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ বিপ্লবীদের শক্ত ঘাঁটি এমন কথা শোনা যায়। বড়বড় ডিগ্রিধারী জ্ঞানী-গুণি অধ্যাপক, ফার্স্ট ক্লাস মেধাবী ছাত্রছাত্রী বিপ্লবের তত্ত ঝাড়ছে, খতমের লাইন বাতলে দিচ্ছে, কলেজ ল্যাবরেটরীকে অস্ত্রাগার বানিয়ে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যাওয়া আসা করলেও এখনো সে মুখী হইনি। একটানা ঘোরাঘুরির পর ক্লান্তি নিরসনে কলেজ স্কয়ারে পাতানো বেঞ্চই উপযুক্ত স্থান। কিন্তু পাশের মস্তক বিহীন মূর্তিগুলি আমার কাছে কেমন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠে।
রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বসুর কীর্তিগাঁথা ধারণ করেই ’৪৭ পরবর্তী কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত বাঙালি মানস গর্ববোধ করেছে, তৃপ্ত থেকেছে। পাশ্ববর্তী পূর্ববাংলার মুক্তিসংগ্রামকে সময়োচিত সমর্থন করে এগিয়ে আসা, হাত বাড়িয়ে দেয়ার মতো উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে, কলকাতা সহ পুরো পশ্চিমবঙ্গবাসী। বাঙালির ইতিহাসের এমন ঝলসিত অধ্যায়ে ভিনদেশী হয়েও সরাসরি সম্পৃক্তির গৌরবময় এতো অর্জন কেমন যেনো ম্লান করে দেয়। ব্যার্থ বিপ্লবের এই তীব্র দহন। হতাগ্রস্ত মধ্যবিত্ত মানস কখনো ক্ষোভে আর কখনো আত্ম গ্লানিতে ভোগে অপকটে স্বীকার করে নেয়Ñ‘অপার বাংলার ছেলেরা মায়ের ইজ্জত, বোনের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। দেশকে মুক্ত করার জন্য বারবার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়বাংলা বলে ঝাপিয়ে পড়ে, বীরের মতো প্রাণ দিচ্ছে। আর এপাড় বাংলার ছেলেরা মাওয়ের তত্ত্বে মত্ত হয়ে বিপ্লব-বিপ্লøব বলে আত্মঘাতি হচ্ছে।  মহৎ উদ্দেশ্যে প্রাণ দিতে বাঙালি কখনো দ্বিধা করেনি। শুধু শুধু ব্যর্থ মৃত্যু এতো সব সুন্দর জীবন অকালে ঝড়ে পড়লো। এতে কি, রাজ্যে উদ্ধার হলো, না দেশ উদ্ধার পেল? বাঙালির কোন উপকারটা হলো।