পাভেল পার্থ
বন্যপ্রাণের প্রতি মানুষের সহিংসতা সকল ব্যাকরণ চুরমার করে দিচ্ছে। পিটিয়ে, গলাটিপে, খাঁচায় আটকে, পায়ে শেকল বেঁধে বন্দি দাস বানিয়ে কিংবা বন থেকে ধরে এনে বিলাসী বিনোদনকেন্দ্রে প্রর্দশন নানাভাবে প্রতিদিন বন্যপ্রাণীকে নির্দয়ভাবে খুন করছে মানুষ। কোনো জবাবদিহিতা নেই, কোনো দৃষ্টান্তমূলক ন্যায়বিচার নেই। এমনকি দেশের ‘সুশীল নাগরিক তৎপরতাও’ এসব প্রশ্নে বিস্ময়করভাবে মৌন ও শিথিল। বারবার এসব ঘটনা প্রশ্ন করছে আমাদের সকল ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতা সবকিছুই প্রবলভাবে মানুষকেন্দ্রিক। ভীষণ কায়দায় উপনিবেশিক ও অধিপতি। আমরা উপনিবেশের বিরুদ্ধে কথা বলি, কাঠামোগত বৈষম্যকে প্রশ্ন করি কিংবা দাস বাণিজ্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠি কিন্তু সে কেবল মানুষকে কেন্দ্রে রেখেই। যদি মানুষ আহত হয় বা আঘাত পায় তাহলেই। মানুষের বাইরে বৃক্ষ, প্রাণী বা অণুজীবকে নিয়ে নয়। আমরা প্রমাণ করে চলেছি এই দুনিয়া কেবলি মানুষের দুনিয়া। এমনকি আমাদের বিউপনিবেশ বিষয়ত যাবতীয় তত্ত্ব তালাশও বন্যপ্রাণ প্রশ্নে প্রবলভাবে উপনিবেশিক চেহারা নিয়েই প্রশ্নহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য মানুষ হিসেবে এতে আমাদের কোনো দায় বা আহাজারি নেই। ৮ মার্চ ২০২০ দেশে প্রথম করোনা সণাক্তের পর মধ্য জুন অবধি মাত্র ৪ মাসে ২৮৮টি বন্যপ্রাণী হত্যা করেছিল মানুষ। আইন ছিল, কাঠামো ছিল, প্রশাসন ছিল কিন্তু বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। এবার রেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন বনের ভেতর ট্রেন থামিয়ে মায়াহরিণ খুন করল।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট, ঢাকার আগারগাঁও বনভবন থেকে ২৩/২/২০২৩ তারিখে ‘প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী ২০২৩ এ দেশীয় বন্যপ্রাণী প্রদর্শন ও ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা প্রসঙ্গে’ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে আগামী ২৫/২/২০২৩ থেকে ১/৩/২০২৩ পর্যন্ত ‘প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীতে’ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর অধীন কোনো বন্যপ্রাণী প্রদর্শন করা যাবে না। কিন্তু এর আগেই গলাকাটা এক হরিণের নিদারুণভাবে লাশের ছবি দেখল বাংলাদেশ। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটি প্রচারিত হলো। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনে ট্রেন থামিয়ে হরিণ খুন করে সেই লাশ ট্রেনে তুলে আবার রওনা হয় ট্রেন। খুনের ঘটনা বুধবারে ঘটলেও বহুপরে শুক্রবার ছাপা কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়। খবরের শিরোনামগুলো একবার দেখা যাক। ‘মৃত হরিণ ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া যুবকদের একজন রেলের কর্মচারী (প্রথম আলো)’, ‘গলাকাটা হরিণের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল (বাংলাদেশ প্রতিদিন)’, ‘লাউয়াছড়া বনের ভেতর ট্রেন থামিয়ে হরিণ হত্যা (দেশ রূপান্তর)’, ‘লাউয়াছড়া বনে থামল ট্রেন, উঠল গলা কাটা হরিণ (কালেরকন্ঠ), ‘লাউয়াছড়ায় ট্রেন থামিয়ে হরিণ জবাই (প্রতিদিনের বাংলাদেশ)’। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছে চলতি আলাপ। কেবল বন্যপ্রাণী হত্যা নয়, পাশাপাশি বনের ভেতর এভাবেই ট্রেন থামানো যায় কীনা এ বিষয়টি দেখা জরুরি। রেল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এর দায় অস্বীকার করতে পারে না। বনবিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসকে এসব বিষয়ে আরো তৎপর হতে হবে।
উপনিবেশিক বাংলার নির্দয় শিকার কাহিনি নিয়ে কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৮৬ সনে ফ্রান্সিস অ্যান্ড টেলর থেকে ফ্রাংক বি সিমসনের ‘লেটার্স অন স্পোর্টস ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল’ বইটি প্রকাশিত হয়। ১৮৮৬ সনে লন্ডনের লেজার স্মিথ অ্যান্ড কোং প্রকাশ করে এডওয়ার্ড বি বাকেরের ‘স্পোর্টস ইন বেঙ্গল’। বইগুলিতে উপনিবেশিক বাংলায় ব্রিটিশ শাসকদের নির্দয় শিকার কাহিনি বিবৃত হয়েছে। এছাড়া মুক্তগাছার জমিদার ও সুসং রাজার শিকার কাহিনি আছে। কিন্তু ট্রেন থামিয়ে হরিণ খুনের কথা কোথাও জানা যায় না। এমনকি জুলভার্নের কাহিনি নিয়ে বানানো বিখ্যাত সিনেমা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ শ্যুটিংয়ের সময়েও এমন অপ্রাণবিক ঘটনা ঘটেনি। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সিলেটে থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন কক্ষ থেকে বস্তাবন্দি গলাকাটা মায়া হরিণের লাশ উদ্ধার করে বনবিভাগ। এ ঘটনায় শ্রীমঙ্গল থানায় লাউয়াছড়া বন বিটের ফরেস্টার বিট কর্মকর্তা ২৩/২/২৩ তারিখে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়রী করেন (ডায়রী নং-৬৭৭)। ডায়রীর ভাষ্যমতে, বস্তাবন্দি নিহত হরিণটির গায়ের রং ধূসর, এটি নারী হরিণ এবং বয়স আনুমানিক দুই বছর। এর উচ্চতা ২২ ইঞ্চি, দৈর্ঘ্য ৪৪ ইঞ্চি। হরিণটির উদ্ধারের পর বনবিভাগ এটি জব্দ করে প্রথমত রেঞ্জ অফিসে নিয়ে আসেন এবং পরবর্তীতে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে এর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় এবং বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে একে মাটিচাপা দেয়া হয়। ঘটনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, ৪-৫ জন লোক গলাকাটা হরিণটি ট্রেনে তুলছে এবং সামনে একজন লোক হাতে দা উচিয়ে আসছে। গণমাধ্যম এই ভিডিও বিশ্লেষণ করে অনেকের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। দা হাতে সামনের লোকটি রেলওয়ের কর্মচারী এনামুল হক সোহেল। হরিণের লাশ বহনকারী অপরব্যক্তি ট্রেনের সহকারী চালক এবং সাথে থাকা অন্যরাও রেলের কর্মচারী। এমনকি গণমাধ্যমে এনামুল হক স্বীকার করেছেন, তারা হরিণটি ট্রেনে তুলেছেন। ট্রেনে থাকা যাত্রীরা গণমাধ্যমকে জানান, ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ভেতর লাউয়াছড়া বনের ভেতর ট্রেনটি হঠাৎ থামানো হয় এবং কয়েকজন দা হাতে বাইরে ছুটে গিয়ে কিছুক্ষণ পর একটি হরিণ নিয়ে ট্রেনে ওঠার পর আবার ট্রেন ছাড়া হয়। ভানুগাছ রেলওয়ে রেকর্ডবুকের তথ্য দিয়ে গণমাধ্যম জানায় ঘটনার দিন সকাল ৮.২৮ মিনিটে কালনী এক্সপ্রেস ভানুগাছ অতিক্রম করে কিন্তু শ্রীমঙ্গল পৌঁছায় অন্যদিনের চেয়ে কয়েক মিনিট পর ৮.৫৪ মিনিটে। দূর্ঘটনা, অতি জরুরি প্রয়োজন বা যান্ত্রিক ত্রুটি ছাড়া হঠাৎ কোথাও ট্রেন থামানোর নিয়ম না থাকলেও কেন এভাবে বনের ভেতর ট্রেন থামানো হলো হরিণ হত্যার পরও রেলবিভাগ এ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। এমনকি এমন অভিযোগও ওঠেছে যে, রেলওয়ে পুলিশ ঘটনাটিকে প্রথম ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। যদিও বনবিভাগের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত একটি সাধারণ ডায়রি হয়েছে।
বন্যপ্রাণী আইনের ভাষায় উদ্ধারকৃত মৃত হরিণটির শরীর হলো ‘ট্রফি’। আর এই আইনে নিষিদ্ধ এই ট্রফি উদ্ধার হয়েছে ট্রেন থেকে, ঘটনায় জড়িতদের ভিডিও রেকর্ড আছে। অবশ্যই এ ঘটনায় জড়িতদের আইন অনুযায়ী বিচার ও শাস্তি হওয়া জরুরি। বন্যপ্রাণীর ট্রফি উদ্ধার করে এর আগে বনবিভাগ আইনি বিচার নিশ্চিত করেছে। সমসাময়িক কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। জংগল থেকে শ্রীমঙ্গলের ভূনবীর ইউনিয়নের পশ্চিম লইয়ারকুল গ্রামের এই কুমিল্লাপাড়ায় আসে একটি বানর। বানরটিকে ধরে গলায় লোহার তার পেঁচিয়ে ২০২০ সনের ৩১ মার্চ শাসরোধ করে হত্যা করে কুদ্দুস মিয়া, জামাল মিয়া ও সাহেব আলী। বনবিভাগ এ ঘটনায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের ৬ এবং ৩৯ ধারায় উল্লিখিতি তিন হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ৫ এপ্রিল। মাদারীপুর পৌরসভার মধ্যখাগদি এলাকায় কিছু অপরিচিত যুবক একই সনের ৫ মে বিষ মেশানো চিড়া, মুড়ি, কলা দিয়ে পনেরটি বানর হত্যা করে। এ ঘটনায় সামাজিক বনবিভাগ মামলা করে এবং পুলিশ শাহনাজ বেগম নামের এক অভিযুক্ত হত্যাকারীকে আটক করে। একই সনের ২১ মে নাটোরে ২০০ শামুকখোল পাখি হত্যা করে এর লাশ রান্না করে বেলাল হোসেনসহ কয়েকজন। আশা করবো ট্রেন থামিয়ে লাউয়াছড়া বনের মায়াহরিণ খুনের ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’ দ্বিতীয়ভাগে বন্যপ্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মায়াজাগানো এক কবিতা আছে। লাউয়াছড়া বনের ভেতর ট্রেন থামিয়ে রেলের লোকজনের হরিণ খুন করার ঘটনাটি জানার পর বারবার সহজপাঠের সেই কবিতার কথা মনে আসে। ‘ঐখানে মা পুকুর পাড়ে/জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে/হোথায় হব বনবাসী/আঁচলেতে খই নিয়ে তুই/যেই দাঁড়াবি দ্বারে/অমনি যত বনের হরিণ/আসবে সারে সারে/ওরা সবাই আমায় বোঝে/করবে না ভয় একটুও যে/হাত বুলিয়ে দেব গায়ে/বসবে কাছে ঘেঁেষে’। রেলবিভাগ সহজপাঠ পড়েছেন কীনা জানিনা। পড়লে হয়তো বনের ভেতর ট্রেন থামিয়ে হরিণকে খুন করতেন না। হয়তো লাউয়াছড়া বনের ভেতর বন্যপ্রাণী দেখে তাদের নিরাপদ চলাচলের জন্য চালক ট্রেন থামিয়ে দিতেন। হয়তো নির্ভয়ে হরিণ আসতো কাছে, কারণ হরিণ রেলের লোকজনকে বুঝতে পারতো। হয়তো ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে রেলের লোকজন হরিণের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন, গলায় লোভের চাকু মারতেন না। এই ঘটনাটি স্পষ্ট করেছে বনভূমির ভেতর দিয়ে পাবলিক যান চলাচলে আমাদের করণীয় বিষয়ে আমরা কতোটা উদাসীন ও অসংবেদনশীল। ২০২৩ সনের ২৯ জানুয়ারি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর ট্রেনের গতিসীমা ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২০ কি.মি. রাখার নির্দেশনা জারি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় (স্মারক নং-৫৪.০০.০০০০.০৪১.১৮.০১৬.২২.৪৫)। আন্ত:নগর কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি কী রেল মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা মেনেছিল? কারণ বহুদিন ধরে লাউয়াছড়ার বনের ভেতর রেললাইন ও সড়কপথ বন্যপ্রাণীর বহু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। একটি সংবেদনশীল অরণ্যের ভেতর যাতায়াত ও পাবলিক যানবাহন চলাচল বিষয়ে আমাদের আরো সংবেদনশীল, সতর্ক ও মনোযোগী হওয়া জরুরি।
লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com
- এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতল ইংল্যান্ড
- জামালগঞ্জে গুচ্ছ গ্রাম পরির্দশনে শামীমা শাহরিয়ার