বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
জামালগঞ্জে বোরো রোপণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কৃষক এখন রোপণকৃত জমিনে চেয়ে চেয়ে ফসল তোলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়বে। কৃষকের সেই স্বপ্ন বোনা হাওর কতটা নিরাপদ? সরকার হাওর ও কৃষকের নিরাপত্তায় কাবিটা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে খুবই মন্থর গতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু বাঁধের কাজ এগিয়েছে যৎসামান্য। ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারসহ অধিকাংশ বাঁধে এখনও পড়েনি মাটি। হাতেগোণা কয়েকটি বাঁধে মাটি ফেলা মোটামুটি পর্যায়ে পৌঁছলেও কিছু কিছু বাঁধের মাঝ বরাবর সামান্য মাটি ফেলে নামমাত্র কাজের জানান দেওয়া হয়েছে।
বাঁধের কোথাও সাটানো হয়নি নির্দেশিকা বোর্ড। এমনকি ওয়েব পোর্টালে অসম্পূর্ণ তালিকা দিয়ে তথ্য গোপনেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। অক্ষত বাঁধে বাড়তি বরাদ্দের পাশাপাশি নানা অনিয়মসহ সম্পূর্ণ খামখেয়ালিভাবে এগুচ্ছে বাঁধের কাজ। পিআইসি গঠনে নানা অসঙ্গতির অভিযোগ তুলে বর্ধিত সময়েও কাজ অসমাপ্ত থাকা এবং দুর্বল কাজে হাওর ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন কৃষকেরা। তবে এক্ষেত্রে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কাজ এগিয়েছে প্রায় ২৩ ভাগ। তবে বুধবার দিনব্যাপী হালি, শনি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে সংশ্লিষ্টদের দাবির সাথে তেমন মিল খোঁজে পাওয়া যায়নি।
হাওর ঘুরে দেখা যায়, হালি হাওরের ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন ক্লোজারে এখনও মাটি ফেলা শুরু হয়নি। পার্শ্ববর্তী বাঁধে সামান্য মাটি ফেলা হয়েছে। হাওড়িয়া আলীপুর অংশে মাটির কাজ চলছে। এর বিপরীত পার শনির হাওরের লালুরগোয়ালাখ্যাত বিপজ্জনক অংশের অক্ষত স্থানে কিছু মাটি ফেলে পিআইসিভুক্তির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। একই হাওরের ঘনিয়ার বিলের পার্শ্ববর্তী বাঁধেও ধীরস্থিরে মাটি ফেলা হচ্ছে। হালি হাওরের সবচেয়ে বড় ক্লোজার আছানপুরের ভাঙ্গায় মাটি ফেলার কোন আলামত চোখে পড়েনি। এছাড়া মদনাকান্দি থেকে আছানপুর হয়ে সুন্দরপুর-কালিবাড়ি এবং হরিপুর থেকে উলুকান্দি-যতীন্দ্রপুর পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি বাঁধে সামান্য মাটি ফেলা হয়েছে।
এদিকে, মামুদপুরের ভাঙ্গায় মাটি না পড়লেও ভাঙ্গার পর থেকে বাঁধে মাটি ফেলা হচ্ছে। যদিও এই পিআইসি নিয়ে ইউএনও বরাবরে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে ৩৩ নম্বর পিআইসি জুলহাস তালুকদারের বিরুদ্ধে বিগত বছরে বাঁধে কাজ করা শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করাসহ কয়েকটি মামলায় অভিযুক্ত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছে মামুদপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মমিন। অভিযোগকারী ওই পিআইসি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
অপরদিকে, মহালিয়া হাওরের ৬টি পিআইসির মধ্যে ১০ ও ১৩ নম্বর পিআইসিতে মাটির কাজ শুরু হয়েছে। ওই দুই পিআইসি সংশ্লিষ্টদের বাঁধে পাওয়া গেলেও বেহেলী ইউনিয়নের তিন হাওরের ৩৬টি পিআইসির মধ্যে প্রায় ৩০টি পিআইসির কাউকে বাঁধে পাওয়া যায়নি। যদিও মাঝে-মধ্যে মাটি ফেলা শুরু হয়েছে, তবে কার কোন বাঁধ কিংবা কোথায় কাজ হবে, কোথায় হবে না সেটি শনাক্ত করতে কোথাও কোন নির্দেশিকা বোর্ড সাটানো হয় নি। খোঁজ নিয়ে জামালগঞ্জের আরেক বৃহৎ পাগনা হাওরেও কাজের গতি প্রায় একই রকম বলে জানা গেছে।
বাঁধে পাওয়া দু’একজন পিআইসিকে প্রশ্ন করলে তারা জানিয়েছেন, বোর্ড প্রতি দুই হাজার টাকা চেয়েছে কর্তৃপক্ষ। টাকা দিলে হয়তো বোর্ড দেওয়া হবে। এছাড়া কাজের ধীরগতি সম্পর্কে জানানো হয় কাজ করতে এখনও কোন টাকা ছাড় দেওয়া হয় নি। পিআইসিদের এমন অভিযোগের বিপরীতে পিআইসিবঞ্চিত অনেকে পিআইসি বরাদ্দে নানা অসঙ্গতি-অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে হালি হাওর পারের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক কৃষক জানিয়েছেন, টাকা দিলেই পিআইসি হয়। যারা টাকা বেশি দিয়েছে তারাই পিআইসি পেয়েছে। পিআইসি দেওয়া হবে এমন প্রত্যাশায় এক জনপ্রতিনিধি কর্তৃপক্ষের কথা বলে তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু টাকা দিলেও তিনি পিআইসি পাননি। পরে অবশ্য তিনি টাকা ফেরৎ নিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, এমনও আছে যারা নামে-বেনামে একাধিক পিআইসি পায়। বাঁধ যখন ঝুঁকিতে পড়ে তখন তাদের মতো কৃষকদেরকেই বাঁধে দরকার হয়। প্রকৃত কৃষক হওয়া সত্বেও তারা পিআইসি পায় না। পিআইসি পায় তারাই যারা বেশি টাকা দিতে পারে। গত বছর হালি হাওরের বাঁধ ভাঙ্গার পর এসওকে নাকি হেনস্থা করেছেন তিনি, তাই তাকে পিআইসি করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এই ক্ষোভ প্রকাশকারী।
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, পাগনা হাওরের ১৮টি পিআইসির মধ্যে ১০টি পিআইসি আলীপুরের পূর্বদিকে পড়েছে। এর মধ্যে ৩টিতে কাজ শুরু হয়েছে বাকি ৭টির কাজ শুরুই হয়নি। সুরমা নদীর তীরবর্তী ৮টি পিআইসির মধ্যে ২টি পিআইসির মাটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজে বলা যায় একেবারে ধীরগতি। অতিসত্বর কাজে গতি আনা দরকার। এছাড়া প্রভাবশালীদের কারণে যাদের জমি নেই, কৃষক না এমন লোকদের পিআইসি দেওয়া হয়েছে তাদেরকে যাচাই-বাছাই করে বাতিল করা হোক।
জামালগঞ্জের বাঁধ থেকে ফিরে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এনামুল কবির ইমন বলেন, বাঁধে যাতে দুর্নীতি না হয়, সঠিকভাবে যাতে কাজ হয়, সেগুলো দেখতে নিজ দায়িত্বেই বাঁধে গিয়েছি। বাঁধের কাজের অসঙ্গতি ও জটিলতা এবং দ্রুত সময়ে বরাদ্দের টাকা ছাড়ের বিষয় নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে কথা বলব। আমরা বাঁধের কাজ সঠিক সময়ে শুরু এবং সঠিক সময়ে শেষ হওয়া চাই। এ জন্য সকলকেই তদারকি করতে হবে।
উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা (এসও) জাহিদুল ইসলাম জনি জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে ৬১টি। এর মধ্যে অনুমোদন হয়েছে ৫৭টি। আর ৫৯টির পিআইসি গঠন করা হয়েছে। বাকি ২টি এখনও পিআইসি হয়নি। সবকটিতে বরাদ্দ ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। যদি ২টি প্রকল্প বাদ যায় তাহলে ৪৮ লাখ টাকা কমে প্রকল্প ব্যয় হবে ১০ কোটি ৫ লাখ টাকা। অনুমোদিত ৫৯টি পিআইসির মধ্যে কাজ চলমান আছে ৫০টির। বুধবার পর্যন্ত পুরো উপজেলার কাজ হয়েছে প্রায় ২৩ ভাগ বলে জানিয়েছেন তিনি।
ওয়েব পোর্টালে পিআইসির পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং নির্দেশিকা বোর্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ওয়েব পোর্টালে যখন তালিকা পাবলিস্ট করা হয়েছে তখন সবগুলো প্রকল্প পাস হয়নি। এখন ইউএনও স্যারের সাথে কথা বলে তালিকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। আর নির্দেশিকা বোর্ড আগামী তিনদিনের মধ্যে পিআইসিদের দেওয়া হবে।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, ৩৩ নম্বর পিআইসির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাইনি। পিআইসি সংক্রান্ত যদি কোন মামলা না থাকে তাহলে কোন অসুবিধা নেই। অন্য মামলা থাকলে তার মামলা সে দেখবে। আর প্রথম কিস্তির টাকার কোন ঘাটতি নেই। পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেওয়া হচ্ছে।
- সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধন
- ডজন খানেক আ.লীগ নেতা নৌকা প্রত্যাশী