দোলযাত্রা উৎসব

সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ দাস ( সজল)
দোলযাত্রা গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় রীতির এক প্রাচীন উৎসবের নাম। বাংলায় বলা হয় দোলযাত্রা, আর পশ্চিম ও মধ্য ভারতে একে বলা হয় হোলি। অঞ্চলভেদে দোল বা হোলি উৎসবের যেমন ভিন্নতা রয়েছে তেমনি এর নামকরণের রয়েছে মাহাত্ম্যপূর্ণ ইতিহাস।পূর্ব ভারতের আর্যরা এ উৎসব পালন করতেন।সেই ধারা বর্তমান অবধি অব্যাহত রয়েছে হোলি উৎসব পালনে। ইতিহাস থেকে জানা যায় ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের এক শীলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলি উৎসব পালনের কথা। এছাড়া ও স্কন্দপুরাণ,নারদ পুরাণ এবং ভবিষৎপুরাণে এ উৎসব সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।
স্কন্দপুরাণের ফাল্গুনি মাহাত্ম্য নামক গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহল্লাদের কাহিনী বর্ণিত আছে। সেখানে বর্ণিত আছে যে, হোলিকা নামে কশ্যপ মুনি এবং তাঁর পত্নী দিতির এক কন্যা সন্তান ছিল। যিনি অসুর হিরণ্যকশিপুর বোন। অপরদিকে প্রহল্লাদ হলেন অসুর হিরণ্যকশিপুরের ছেলে। প্রহল্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। তার ছেলে বিষ্ণুভক্ত হওয়ায় হিরণ্যকশিপু তা মোটেই মেনে নিতে পারেননি। তখন তিনি সিদ্বান্ত নিলেন ছেলেকে অগ্নিকুন্ডে পতিত করে প্রাণে মেরে ফেলার। কারণ এর আগে হিরণ্যকশিপু বহু চেষ্টা করেছেন জলে কিংবা স্থলে প্রহল্লাদকে মেরে ফেলার। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হয়েছেেন ।এখন বাকি অগ্নিকুন্ড। এদিকে হোলিকা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছ থেকে বর প্রাপ্ত হয়েছিল যে, আগুন তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সে অনুযায়ী হিরণ্যকশিপু বোনকে দিয়ে সে কাজটি সম্পূর্ণ করার সিদ্বান্ত নিলেন। হোলিকা প্রহল্লাদকে কোলে করে নিয়ে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিল। কিন্তু হোলিকা বরপ্রাপ্ত হলে ও তিনি অন্যায়ভাবে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করায় তার বর নষ্ট হয়ে যায়। ফলে হোলিকা নিজেই অগ্নিকুন্ডে নিঃশ্বেষ হয়ে যায়। অপরদিকে প্রহল্লাদ বিষ্ণু ভক্ত হওয়ার কারণে বিষ্ণুই তাঁকে অগ্নিকুন্ড থেকে রক্ষা করেন। হোলিকার মৃত্যুতে ভক্তকুলে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। হোলিকা অসুরের মৃত্যুতে আনন্দ উৎসব করা হয় বলে এই হোলিকা থেকে হোলি উৎসবের উৎপত্তি। যাহা ছিল সত্য যুগের ঘটনা।
দ্বাপর যুগে অর্থাৎ আজ থেকে পাঁচহাজার বছর পূর্বে বসন্ত ফাল্গুনি পূর্ণিমার এই তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি ও অরিষ্টাসুর নামে অসুরদ্বয়কে নিধন করেছিলেন। যার ফলে ব্রজবাসীগণ অন্যায় ও অত্যাচারী শক্তির ধ্বংসের কারণে এক আনন্দে উৎসবে মেতে উঠে। যা হোলি উৎসব হিসেবে পরিচিত।
হোলি উৎসবের পরের দিন হয় রং খেলা। এই দিনে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি শ্রীমতি রাধারাণী ও অন্যান্য ব্রজগোপিকাদের সঙ্গে দোলপূর্ণিমায় আবির রং নিয়ে দোল খেলায় মেতেছিলেন যার নাম দোলযাত্রা। সেই দিন বৃন্দাবনে যে আনন্দ উৎসব হয় পরবর্তীতে বৃন্দাবনবাসী আর সেই দিনটাকে ভুলতে পারে নি। যা থেকে দোল উৎসবের সূচনা।


আবার এই দোল উৎসব গৌর পূর্ণিমা নামে ও পরিচিত। কারণ আজ থেকে পাঁচশত চৌত্রিশ বছর পূর্বে কলিযুগের পাবনাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এ ধরাধামে আর্বিভুত হয়েছিলেন কলির কুলুষ নাশিতে। সুতরাং দেখা যায় ফাল্গুনি পূর্ণিমার এই তিথিটি বিভিন্ন মাঙ্গলিক ঘটনার মিলন স্থল হওয়াতে সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্য্যের। কিন্তু দুংখের বিষয় বর্তমানে কতিপয় তরুণ প্রজন্ম এদিনটির বিশেষ তাৎপর্যের প্রতি খেয়াল না রেখে হোলি উৎসবের নাম করে রং নিয়ে বিভিন্ন অশ্লীল নৃত্য গীতে মেতে উঠে। যাহা হোলি উৎসবের পবিত্রতা নষ্ট করারই শামিল। আশা করছি আমরা এ বিষয়টার প্রতি সবাই সচেতন থাকব।
লেখক : সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ দাস ( সজল), কলাম লেখক, সিলেট
ই-মেইল- sajalchanda03@gmali. com