ধান কেনার বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি

সাইদুর রহমান আসাদ
জেলার হাওরে এবার বাম্পার ফলন পেয়েছেন কৃষক। দুই লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে এবার প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ মে.টন ধানের উৎপাদন হয়েছে। অধিক ফলন পেয়েও আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় স্বস্তিতে নেই কৃষকরা। জেলায় গত বছর সরকারিভাবে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় এবছর ১১ হাজার টন ধান কম কিনবে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদনের তুলনায় কম পরিমাণে ধান কেনায় বাজারে ধানের দাম ওঠছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় তিন মৌসুমে বছরে যে পরিমাণে ধান উৎপাদন হয় এর থেকে সাড়ে ১১ লাখ মে.টন চাল তৈরি হয়। এই চাল জেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষের খাবারের চাহিদা মিটিয়ে বছরে সাড়ে ৫ লাখ মে.টন ধান কেনাবেচা হয়। যা দেশের অন্যান্য এলাকায় মানুষদের চাহিদা পূরণ করে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে এবছর সরকারিভাবে মাত্র ১৭ হাজার মে.টন ধান কেনা হচ্ছে। এর বাইরে পুরোটাই বেসরকারিভাবে কেনাবেচা হচ্ছে।
জেলা খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীলরা জানান, গত বছর সরকারিভাবে জেলায় প্রায় ২৮ হাজার মে.টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮০ ভাগ ধান কিনতে সক্ষম হয় এই বিভাগ। এজন্য এ বছর তারা ১১ হাজার মে.টন ধান কম কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গতবছর সরকারের দেওয়া দাম থেকে খোলা বাজারে বেশি দাম পাওয়ায় কৃষকরা গোডাউনে ধান দেয় নি বলছে খাদ্য বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্য দাম পায়, সেজন্য প্রতিবছর সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে সরকার ধান কেনে। এবার প্রতিমণ ধান ১২শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরে প্রতিমণ ধান ফলাতে যেকোনো ভাবে হিসেব করলেও খরচ পড়ে সাড়ে নয়শ’ থেকে একহাজার টাকা। জমির ভাড়া এবং কৃষক ও তার পরিবারবর্গের পারিশ্রমিক হিসেবে ধরলে প্রতিমণ ধানের উৎপাদন ব্যয়ই পড়বে ১২শ’ টাকা। এই হিসেবে প্রতিবছর কৃষককে মণপ্রতি সাড়ে তিন থেকে চারশ’ টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রয় করতে হচ্ছে। এভাবে লোকসান দিতে দিতেই বড় কৃষক মাঝারি, মাঝারি কৃষক প্রান্তিক কৃষক হয়ে ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ক্রয়কেন্দ্রে মণপ্রতি ১২শ’ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিলেও সব কৃষক এই দামে ধান বিক্রি করার সুযোগ পায় নি। জেলায় তিন লাখ ছেষট্টি হাজার কৃষক থাকলেও লটারি করে মাত্র হাতে গুণা কিছু কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ এক টন ধান কেনা হচ্ছে। হাওরে লটারি দিয়ে ধান ফলন হয় নি। প্রকৃতি দিয়ে গেছে এবারে বাম্পার ফলন। আর এদিকে ফরিয়া, ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কম মূল্যে ধান কিনছে কৃষকদের কাছ থেকে। সরকার যদি অন্তত. ইউনিয়নে ইউনিয়নে ক্রয় কেন্দ্র খোলে সরাসরি ধান কিনতে পারতো, তাহলে অনন্ত লক্ষ্যমাত্রা পুরণ না হওয়ার কোনো সুযোগই থাকতো না। সবসময়ই হাওরে ধানের ফলন একটু ভালো হলেই, দাম কমে যায়, ফসলে একটু চোট খেলেই একটু দাম বাড়ে, যুগের পর যুগ চলে আসা এই দৃশ্যই হাওর এলাকার কৃষকের বিধিলিপি।
কৃষকরাও বলছেন, জেলায় ধান উৎপাদন হয়েছে লাখ লাখ মণ, আর সরকার কিনছে হাজার মণ। এতে ন্যায্য দাম না পেয়ে ফরিয়া ও মিলমালিকদের কাছেই কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের মনিপুরি হাটি গ্রামের বাসিন্দা মো. আবুল কালাম বলেন, ‘আমি ৬ খানি (প্রায় ৬ বিঘা) ক্ষেতও ৩০ মণ ধান পাইছি। ১০ মণ ধান বিক্রি করছি নয়শ’ ট্যাকা ধরে। যে পরিমাণে ক্ষেতে খরচা করছি, তা এই ধরে বেঁচলে কম হইয়া যায়গা। জেলায় ধান উৎপাদন হয় লাখ লাখ টন, সরকার কিনে কয়েক হাজার মণ। এতে আমরা নয়শ’ টাকার উপরে ধান বেঁচতে পারি না। খানি (এক বিঘা) প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার খরচ হইয়া যায়। সরকার যদি আরও বেশি ধান কিনতো, তাহলে ধানে বেঁচতে পারতাম।’
মধ্যনগর উপজেলার দক্ষিণ বংশিকুন্ডা ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের কৃষক রইস মিয়া। তিনি এবার ১৯ বিঘা জমিতে আবাদ করে ফলন পেয়েছেন প্রায় ২শ’ মণ ধান। তিনি বললেন, বৈশাখের শুরুর দিকে তিনি ৩৮ মণ ধান বিক্রি করেছেন সাড়ে নয়শ’ টাকা ধরে। এখন কিছুটা দাম বেড়েছে। তিন চারদিন আগে তিনি ১১শ’ টাকা ধরে আরও ১২ মণ ধান বিক্রি করেছেন। অবশ্য ১২ মণ ধান বিক্রি করে ১৩ হাজারের উপরে টাকা পেয়ে তিনি খুশী।
একই এলাকার ফরিয়া ব্যবসায়ী লাল মিয়া বললেন, আমরা বৈশাখের শুরু থেকেই ধান কেনা শুরু করেছি। নয়শ থেকে কেনা শুরু করে এখন ১১শ’ টাকা ধরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনছি।
জেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, তিন মৌসুমে সুনামগঞ্জে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মে.টন চাল উৎপাদন হয়। আমাদের চাহিদা রয়েছে ৬ লাখ মে.টন চাল। বাকী উদ্বৃত্ত সাড়ে ৫ লাখ মে.টন চাল দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ভূঞা অবশ্য বলছেন, এবার ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা পুরণ করতে পারলে সামনে সুনামগঞ্জে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। তখন কৃষকদের এমন অভিযোগ থাকবে না।
গত বছর সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, মৌসুম শুরুর দিকে কৃষকরা গোডাউনে ধান দিতে আগ্রহী থাকলেও পরে আর থাকে না। যদি বেসরকারিভাবে ধানের দাম বেশি থাকে তাহলে আমাদের কাছে তারা ধান দেয় না। গতবছর সরকারের দেওয়া দামের চেয়ে বেসরকারিভাবে বেশি ছিলো ধানের দাম। এজন্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় নি।