পরম আত্মীয়ের মতোই মাথা গোঁজেছেন

ইয়াকুব শাহরিয়ার, শান্তিগঞ্জ
কান্দিগাঁও কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ, কান্দিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ও শান্তিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হাজি আবদুল হেকিমের বাজারে থাকা পুরো তিনতলা মার্কেট, তাঁর দু’তলা বসতঘরের সবক’টি ইউনিট, নিজের সো-মিল সবকিছুই ছিলো মানুষে ঠাসা। অর্থাৎ বানভাসি মানুষেরা। শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা বাজারের দিক থেকে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের তিনতলা বাড়িই কান্দিগাঁও গ্রামের প্রথম বাড়ি। তাঁর পুরো বাড়ি, গ্রামের মাঝে তাঁর অপর একটি দু’তলা বাড়ি এগুলোও ছিলো লোকে লোকারণ্য। মোহাম্মদ হাসান জকির লস্কর আলী সুপার মার্কেটেরও ছিলো একই অবস্থা। প্রতিটি দোকানঘরে ছিলো একাধিক বানভাসি অপরিচিত পরিবার। মার্কেটের ফ্লোর তো বটেই নিজের থাকার ঘরও শেয়ার করেছেন অনেকের সাথে। কেউই পরিচিত নন, অথচ পরম পরিচিতের মতো সকলেই মাথাগোঁজেছেন এককাতারে। গ্রামের মাঝখানে ইতালি প্রবাসী তাজুদ আলীর তিনতলা বাড়ি- এমনকি তাঁর ধান রাখার গোদামঘর। সবখানে ছিলো বানভাসি মানুষের থাকার শেষ আশ্রয়স্থল। গ্রামের সব শেষ বাড়িটির ডাকনাম ইতালিবাড়ি। ইতালি প্রবাসী, ৯০ দশকের তুখোর আওয়ামী রাজনীতিক তারা মিয়ার দু’তলা বাড়ি। সবকিছুই ছিলো বন্যার্তদের দখলে। থেকেছেন নিজের বাড়ির মতো করে। অতি আন্তরিকতার সাথে মানুষকে যেনো বুকের উপরেই স্থান দিয়েছেন গ্রামের মানবিক এ মানুষগুলো।
রাজনীতিবিদ আবদুল হেকিম তার নিজেস্ব জেনারেটরের মাধ্যমে নিজ খরচে সংকটের ৭/৮দিন বিরামহীনভাবে বিদ্যুৎ সচল রেখেছেন। অগণিত মানুষ মোবাইল ফোন চার্জ করিয়ে নিতে পেরেছেন।
শান্তিগঞ্জ উপজেলায় বন্যাকালীন মহা বিপর্যয়ের সময় বুকের উপর জায়গা দেওয়া গ্রামগুলোর মধ্যে এটা শুধু একটা গ্রামের গল্প। উপজেলার সকল গ্রামের চেহারা এই গল্পের মতোই ছিল।
উপজেলার ৮টি ইউনিয়ের অপেক্ষাকৃত উঁচু গ্রামের মানবিক কিছু মানুষ নিজেদের অসুবিধার কথা চিন্তা না করে সবকিছু দিয়ে মানবিক সহযোগিতা করেছেন বানভাসি মানুষদের। তাঁদের এ মানবিক আচরণের কথা সারা জীবন মনে রাখবে উপকারভোগী মানুষজন ও এলাকাবাসী।
জয়কলস ইউনিয়নের শান্তিগঞ্জে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের ‘হিজলবাড়ি’ ছিলো লোকে লোকারণ্য৷ কয়েকশ মানুষের নিরাপদ আশ্রয় ছিলো হিজলবাড়ি । ডুংরিয়া গ্রামে মন্ত্রীর একান্ত রাজনৈতিক সচিব হাসনাত হোসেনের বাড়ি, মন্ত্রীর এপিএস জুয়েল আহমদের বাড়িতেও মানুষের আশ্রয় ছিলো। আলী হোসেন, মনিরুজ্জামান সুজন ও মঈনুল ইসলামের বাড়িতেও দুঃসময়ের এ দিনগুলো কাটিয়েছেন অসহায় মানুষজন। পরম যতেœ তাঁরাও আশ্রয় দিয়েছেন সবাইকে। জামলাবাজ গ্রামে ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল বাসিত সুজনের বাড়ি ও আছির মোহাম্মদের বাড়িতে অনেক মানুষের আশ্রয় ছিলো। এছাড়াও এ গ্রামের উত্তরহাটিতে আশিকুর রহমান আশিকের বাড়িতে ১৫ থেকে ২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলেন। একই গ্রামের নুরুজ্জামানে মার্কেটেও প্রায় ১৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলেন। নোয়াখালী বাজারে ইতালী প্রবাসী রায়হান উদ্দিনের মার্কেটে আশ্রিত ছিলেন শতাধিক মানুষ। আস্তমার আতাউর রহমান, শফিক আলী, ফজর আলী, হাসনাবাজের জহর মেম্বার, লিলু মিয়ার বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন অনেক বন্যার্ত মানুষ।
পূর্ব বীরগাঁও-এ অসংখ্য মানুষকে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন কিছু মানবিক মানুষ। বীরগাঁও গ্রামের ইউপি সদস্য জোবায়ের আহমদের পাড়া তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় এপাড়া বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রের মতোই ছিল। নিজেদের সব সুবিধা ত্যাগ করে মানুষকে সহযোগিতা করেছেন পাড়াবাসী। একই গ্রামের টুকু আহমদের বাড়িতে ছিলেন ৭/৮টি পরিবার। হাঁসকুড়ির মৌলা মিয়ার বাড়ি ও আজহারুল ইসলামের বাড়ি ছিলো অনেক মানুষের আশ্রয়স্থল। ইউনিয়নের ধরমপুরের হাজি শফিক মিয়ার বাড়ি, বীরগাঁও দক্ষিণ হাটির আবুল হাসানের বাড়ি, চৌধুরী বাড়িতেও বেশ কিছু মানুষ আশ্রিত ছিলেন। এছাড়াও খালপাড় গ্রামের আরজুমান মিয়ার বাড়িতে ১৫/২০টি পরিবার থেকেছিলেন। সলফ, নোয়াগাঁওসহ আরো অনেকেই নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন বন্যার্তদের।
পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম রাইজুল বললেন, আমি নিজেও একজনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলাম। দেখেছি মানবিকভাবে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনটাই তো হওয়ার কথা। আমার ইউনিয়নে যাঁরা মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের সবাইকে সালাম।
পাথারিয়া ইউনিয়নের গাজীনগর গ্রামের বড়বাড়ির ব্যবসায়ী তফজ্জুল হোসেনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন ৭-৮টি পরিবার। এছাড়াও ইউনিয়নের যেসব গ্রামের বাড়িগুলোতে পানি উঠেনি সেসব গ্রামের প্রতিটি মানুষ নিজেদের বুকের উপর স্থান দিয়েছেন বন্যার্ত মানুষকে। একই ভাবে শিমুলবাক, পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নেও মানুষকে আশ্রয় দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন মানুষ।
দরগাপাশা ইউনিয়নের এমরান হোসেন চৌধুরীও বিপর্যয়ের সময় বাড়িতে ২০টি বন্যার্ত পরিবারকে স্থান দিয়েছেন। দরগাপাশা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে ফখরুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়িতে ছিলেন ২৫/৩০টি জলেভাসা পরিবার।
আক্তাপাড়া গ্রামের আবদুর রশিদ তালুকদারের বাড়িতে গাদাগাদি করে থেকেছেন ১০/১৫ টি পরিবার। ইংল্যান্ড প্রবাসী রূপ মিয়ার বাড়িতে প্রায় ১৫টি পরিবার, হাজী আলতাবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে লন্ডন প্রবাসী দিলোয়ার হোসেনের বাড়িতে প্রায় ২০টি পরিবার থেকেছেন। এ ছাড়াও রসুলপুরের বাবুল মিয়ার বাড়িতে ২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন।
ফখরুল ইসলাম চৌধুরী ও আবদুর রশিদ তালুকদার বলেন, শুক্রবার রাতেই মানুষের ঘর-বাড়ি ডুবে যায়। আমার ঘরে পানি ওঠেনি। সকালে দলে দলে মানুষ আমার বাড়িতে আসতে থাকেন। যেহেতু মানুষের জন্যই মানুষ। মানুষের পাশেই দাঁড়াবে মানুষ। তাই সবাইকে বলেছি, যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়িতে জায়গা আছে থাকুন। ৩০টি পরিবার ১ সপ্তাহ আমার বাড়িতে থেকেছেন। তাদের গৃহপালিত পশুপাখি থেকেছে।
বাড়িতে ফেরার সময় প্রবাসী ছেলের সহযোগিতায় প্রত্যেক পরিবারকে ৩০০০ করে টাকাও দিয়েছেন ফখরুল ইসলাম চৌধুরী।
পূর্ব পাগলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুক মিয়ার বাড়িতে উঠেছিলেন ১৫/২০টি পরিবার। পানির তীব্রতা যখন বাড়ছিলো তখন তিনি নিজে গিয়ে ডেকে ডেকে তাঁর বাড়িতে তুলেছিলেন মানুষদের। আশ্রয় দিয়েছেন। করেছেন সহযোগিতাও। চিকারকান্দি গ্রামের আবুল কাশেম নাঈম, রুমান জামান, বেতকোনা গ্রামের আবদুল হান্নান, চুরখাইয়ের মাহমুদ আলীরা মিলে পৃথকভাবে আশ্রয় দিয়েছিলেন শতাধিক পরিবারকে। সময়টা যখন মানবিকতার তখন মানুষের পাশে মানুষই তো দাঁড়াবে। তাই হয়তো দামোধরতপী টাওয়ার মার্কেট সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল হক আশ্রয় দিয়েছিলেন দেড় শতাধিক মানুষকে। এছাড়াও দামোধরতপী এলাকার আনুর মিয়ার ভবনে ২৫/৩০ জন, সারোযার আহমদের ভবনে ২০ জন, ফয়জুল হকের বাড়িতে ২০ জন,
আকবর আলী ২৫ জন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বাদ যাননি মামদপুর গ্রামের মানবিক মানুষেরাও। এ গ্রামের ইরান উদ্দিনের দু’তলা বাড়ির নীচ তলা পানিতে তলিয়ে গেলেও দু’তলায় আশ্রিত ছিলেন অর্ধশতাধিক মানুষ। একই গ্রামের শিবলু উদ্দিনের বাড়িতে ২৫ জনের মতো বন্যার্ত মানুষ উঠেছিলেন।
সমাজকর্মী ইরান উদ্দিন বলেন, আমার বাড়িও প্লাবিত হয়েছিলো। দু’তলায় ৫০ জনের মতো মানুষ এক সপ্তাহ থেকেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময় এটি। তাই মানবিক দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে বন্যার্তদের থাকতে দিয়েছি। নিজের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করিনি।
এলাকার দায়িত্বশীলরা বলছেন, শান্তিগঞ্জ উপজেলার কিছু মানবিক মানুষ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। নিজের পরিবার নিয়ে কষ্ট করেছেন তবু মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন। নিজে খাট ভাগাভাগি করে থেকেছেন। খাদ্য ভাগাভাগি করেছেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ বাক্যটাকে সার্থকভাবে প্রয়োগ দেখিয়েছেন। বন্যা সব মানুষকে একটি কাতারে দাঁড় করিয়েছে। মানুষকে বাধ্য করেছে মানবিক হতে। যে মানবিকতার শুরু হয়েছে ২০২২ সালের বন্যায়, সে ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, মানবিকতার চাষ হতে হবে সব সময়, ধারাবাহিকভাবে। তাহলে সমাজ সুন্দর হবে। মানুষে মানুষে বাড়বে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি।
শাহজালাল মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এনামুল কবির বলেন, প্রত্যেকটা মানুষের ভাগ্যই অন্য মানুষের সাথে জড়িত। সমাজে একজন আরেকজনকে বাদ নিয়ে নয়, বরং প্রত্যেককে নিয়েই সমাজ। সমাজে মানুষ মানুষে পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। বন্যার সময় আমরা মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা অবশ্যই মনে রাখার মতো। আমাদের প্রত্যাশা, এই ধারা অব্যাহত থাকবে। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ বলেন, ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময় আমরা দেখেছি অসংখ্য মানুষ নির্দ্বিধায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের উপজেলায় যাঁদের সুযোগ ছিলো তারা প্রত্যেকেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানুষকে থাকতে দিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। আমরা একবুক দুঃখের মাঝেও মানুষের মানবিকতা দেখেছি। যারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা চাইবো এ মানবিকতার পাঠ অব্যাহত থাকুক। মানুষ মানুষ মানুষকে বিশেষ সময়ের জন্য নয় ,সব সময়ের জন্য ‘আপদকালীন সময়ের’ মতো ভালোবাসুক।