বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে
২০১৭ সালের হাওর বিপর্যয়ের পর হাওর দুর্নীতির সাথে পরিচয় হাওরাঞ্চলের মানুষের। ফসল রক্ষায় সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ কীভাবে জলে যায় তা ওই বছরের প্রলয়ঙ্করী হাওর বিপর্যয় কৃষকদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এর আগে হাওরপাড়ের কৃষকেরা এভাবে টের পায়নি হাওর দুর্নীতির কথা। পরে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজের নতুন নীতিমালা জারি করে সরকার।
কৃষকের স্বার্থে নীতিমালার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজ চক্রের হুমকি-ধমকিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ কৃষক ও হাওর সচেতন মানুষেরা। এ নিয়ে জামালগঞ্জের হাওরপাড়ে নীরব অসন্তোষ ও অস্বস্তি বিরাজ করছে।
কৃষকসহ হাওর সচেতন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাঁধের কাজে দেদারছে অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। বাঁধের ব্যবসা এখন মৌসুমি ব্যবসার মধ্যে বড় ব্যবসা হয়ে ওঠেছে। হাওরপাড়ে এ বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই নানাভাবে হয়রানি, হেনস্থা, হুমকি-ধমকিসহ জবাবদিহিতার আওতায়ও আসতে হচ্ছে প্রতিবাদী মানুষদের। কোন কৃষক বাঁধের কাজের বাস্তবতা তুলে ধরে কিছু বলতে গেলেই তাকে কটু কথার মারপ্যাঁচে ফেলা হচ্ছে। এমনকি পিআইসি নামধারী ব্যক্তির রোষানলে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এর নেতৃত্বে রয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধি, অসৎ রাজনীতিক, নামধারী সাংবাদিক, পাউবো ও প্রশাসনের কতিপয় লোকেরা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নীতিমালায় হাওরপাড়ের কৃষক ও উপকারভোগীদের বাঁধের কাজ পাওয়ার কথা। কিন্তু কাজ পাচ্ছে মূলত অকৃষিজীবী ও অযোগ্য লোকেরা। সরকার দলীয় কিছু নেতা, দুর্নীতিবা কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও তাদের মদদপুষ্ট ব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরোক্ষ মদদে এসব হচ্ছে। এতে আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি অবৈধ পন্থাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে কথা উঠছে। আর এসব কাজে যুক্ত থেকে পকেট ভারি করছে সিন্ডিকেট চক্র। এ বিষয়ে স্থানীয়দের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করছে। কিংবা কেউ প্রতিক্রিয়ায় সত্যটা বলে ফেললেও পরক্ষণে যোগাযোগ করে তা না দেওয়ার অনুরোধ করছেন। কারণ এসব অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কথা বলে অনর্থক হেনস্থার শিকার হতে চাইছে না কেউ, অনুসন্ধানে এমনটাই জানা গেছে।
কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ খোঁজে দেখা যায়, নীতিমালার ৪ দশমিক ০ অনুচ্ছেদের ৪ দশমিক ১ ধারা অনুযায়ী স্কীম প্রক্রিয়াকরণ ও বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পরিষদ প্রকাশ্য মতবিনিময় সভার মাধ্যমে কৃষকের মতামত চাইবে। একই অনুচ্ছেদের ৪ দশমিক ১০ মতে প্রতিটি স্কীমের কাজের বিবরণ, বরাদ্দকৃত অর্থ, পিআইসিসহ যাবতীয় তথ্য উপজেলা ও ইউনিয়ন ওয়েব পোর্টালে কাজ শুরুর পূর্বেই সন্নিবেশিত করার কথা বলা আছে। এছাড়া ৫ দশমিক ০ অনুচ্ছেদের ৫ দশমিক ১ ধারায় দরিদ্র জনগণ অর্থাৎ বাঁধের নিকটবর্তী জমির মালিক ও উপকারভোগীদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে (পিআইসি) যুক্ত করে কাজ বাস্তবায়ন এবং ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু ও ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সম্পন্নের নির্দেশনা রয়েছে।
ওই অনুচ্ছেদের ৫ দশমিক ২ অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় স্কীমের নাম, দৈর্ঘ্য, বরাদ্দের পরিমাণ, বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির নাম ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপন করতে হবে। বাঁধের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে এসব নির্দেশনা ছাড়াও নীতিমালায় নানা নিয়ম-নীতির কথা বলা হলেও কাজ চলছে সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে। সংশ্লিষ্টরা একের পর এক নীতিমালা লঙ্ঘন করে হাওরের বিপদ ডেকে আনলেও সাহস করে কেউ কিছু বলতে চাইছে না।
সম্প্রতি প্রশ্নের জবাবে হালি হাওর পারের এক কৃষক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, বন্যায় যতই ক্ষতি করুক বাঁধের তেমন ক্ষতি হইছে না। পানি যখন বেশি বাড়ে তখন বাড়িঘরের ক্ষতি করে, বাঁধ ডুবে গেলে পানির নীচের বাঁধের থেমন ক্ষতি হয় না। এই বছর বাঁধগুলা অনেকটাই ভালা আছে। তারপরেও বরাদ্দ বাড়ছে। কিন্তু কামকাজ এখনও অনেক বাকি। বাঁধ মজুদ করতে হইলে মাটি দেওয়ার সাথে সাথে বাকি কাজগুলাও আগাইয়া নিতে হইব। কিন্তু কাজ তো এ অনুযায়ী হইতাছে না। পরে দেখা যাইব সঠিক সময়ে কাজ হইছে না। সবশেষে আমরারই দৌড়ন লাগব। লড়াই আমরাঔ করা লাগবো।
একটু পরেই অপারগতা প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়াটি না দেওয়ার অনুরোধ করে ওই কৃষক বলেন, ‘আগে যে বক্তব্যটা নিছইন, এইডা দেইন না যেন। কারণ কয়দিন আগে হেরার সাথে আমার অনেক কথা কাটাকাটি হইছে। সময় হইলে সবকিছু কইমু। এখন আপাতত বাদ দেইন।’
সাবেক এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হাওরের বাঁধ সংক্রান্ত বক্তব্য দেওয়ার পর স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন আমি নাকি উনার বিরুদ্ধে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছি। তখন আমি বলি- কে বলেছে স্যার? তারপর উনি বলেন- আমার সোর্স আছে, তারা বলেছে। আমি বললাম- স্যার আপনি প্রমাণ করেন। পরে তিনি বলেন- আমার কাছে রেকর্ড আছে। এইভাবে যারা হাওরের বিষয়ে কথা বলে তাদেরকে ধমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।’
গণমাধ্যমকর্মী সাঈদুর রহমান আসাদ বললেন, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ দেখতে ইচ্ছে করলেই প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছা যায় না। যাতায়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা নিতে চাইলে, তারা যেদিকে বাঁধের কাজ ভালো হয়েছে ,সেদিকে নিয়ে দেখান। তাতে প্রকৃত দৃশ্য তুলে আনা যায় না।
গণমাধ্যম কর্মী শামস শামীম বলেন, কৃষকের জন্য সরকার কাজ করছে। কৃষকেরা তার কাজে তদারকি করবে, কথা বলবে। কিন্তু এ সুযোগ থেকে হাওরপাড়ের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। আর এগুলো করছে উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সুবিধাবাদী শ্রেণির লোকেরা। সিন্ডিকেট চক্রের লোক দ্বারা কৃষকের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। শাল্লায় কৃষকেরা প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দেওয়া হয়েছে। ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ সামাজিকভাবেও হয়রানির চেষ্টা চলছে। একারণে প্রতিবাদী মানুষেরা আত্মসম্মান ও লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে কথা বলতে চান না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জনি বললেন, আমরা পিআইসির সঙ্গে সম্পৃক্ত। পিআইসির অন্তরালে বা পিআইসির বাইরে কেউ কিছু বলে থাকলে, সেগুলো আমাদের জানা থাকে না। পিআইসির লোকজন স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছেন। গণমাধ্যম কর্মীরা কোথাও বাঁধ দেখতে চাইলে সাধ্যমত সহায়তা করি আমরা। হুমকি ধমকির বিষয়ে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ নেই।
- পিলখানা শাহাদৎ বার্ষিকী আজ
- কর্মই তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে