বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক

স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বিশ্বশান্তি ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন বিশ্ব পরিস্থিতি, শান্তি, প্রগতি, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর এবং গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অনুকূলে পরিবর্তিত হয়েছিল। এ সময় উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ভেতর সৎ প্রতিবেশীমূলক সম্পর্ক স্থাপন ও উপমহাদেশে শান্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২, বাংলাদেশের মৈত্রী-সম্পর্কে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান করেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিপরীতে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের নীতির ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় একটি ন্যায়ানুগ দেশের মর্যাদা লাভ করে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’
সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্বশান্তি পরিষদের শান্তি পদক জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ। এটি ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আর এই পদক ছিলো বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।
জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ এ সম্মান পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’
মারি কুরি ও পিয়েরে কুরি ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। রেডিওলজির ওপর উইলিয়াম রঞ্জনের আবিষ্কারের পথ ধরে কুরি দম্পতি তাদের গবেষণা চালিয়ে যান এবং পলোনিয়াম ও রেডিয়ামের মৌল উদ্ভাবন করেন। তাদের উদ্ভাবন পদার্থবিদ্যায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে এই বিজ্ঞানী দম্পতির মহান অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে শান্তির স্বপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে।
বঙ্গবন্ধুর আগে যারা ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং, নিওনিদ ব্লেজনভ প্রমুখ। অতীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মতো বঙ্গবন্ধুও ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী, নিপীড়িত, মেহনতি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তার অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা, রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, মানবিক মূল্যবোধ, ঐন্দ্রজালিক ব্যক্তিত্ব বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে পররাষ্ট্রনীতির নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু- ‘বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’। পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়’। ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতি উত্তরণে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক জুলিও কুরি পদকে ভূষিত স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ ও বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ আমাদের মাঝে নেই, সা¤্রাজ্যবাদের নীলনকশা অনুযায়ী এক ঘৃণ্য ঘাতকচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধু আজ উপস্থিত না থাকলেও তার মহান আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন, চিরকাল বেঁচে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদকপ্রাপ্তির এই দিন স্মরণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল আদর্শের শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অবদানকে সামনে আনলে যে কোনো সংকট মোকাবিলায় ভবিষ্যতেও আমরা সক্ষম হবো।