বিশেষ প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের ‘নজরখালি বাঁধ হবে কি না’ এই নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। বাঁধ হওয়া এবং না হওয়া নিয়ে দুইপক্ষেরই আলাদা আলাদা মতামত রয়েছে। বুধবার রাত আটটায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীমের সামনেই এ নিয়ে দুইপক্ষ ভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এসময় কিছুটা উত্তেজনাও তৈরি হয়। মন্ত্রী সভা শেষে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে জানিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
বুধবার রাত আটায় সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটি, জনপ্রতিনিধি, কৃষক নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম। এসময় হাওররক্ষা বাঁধের কাজের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার সময় টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি বাঁধের প্রসঙ্গ ওঠে আসে। বৈঠকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার তার উপস্থাপনায় বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ রামসার সাইট। ওই হাওরটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজেরও অন্তর্ভুক্ত নয়, এজন্য এবার ওখানে বাঁধের কাজ করা হবে না।
তাঁর বক্তব্যের পর কেন্দ্রীয় হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে ফসলি জমি একেবারে কম। তাছাড়া ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ টাঙ্গুয়ার হাওরে এক্সভেটর মেশিন ঢুকিয়ে কাজ করায় গত বছর পরিবেশ কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। নজরখালিতে বাঁধ না হলে আশপাশের বড় বড় হাওরগুলোও নিরাপদ থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য জেলা কমিটির সভায় ওখানে বাঁধ না করার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছিল।
এসময় উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীরা মন্ত্রীকে জানান, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের তাহিরপুর উপজেলার বৌলাই নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে তাহিরপুরের সবচেয়ে বড় ফসলি হাওর শনি ও মাটিয়ানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। নজরখালি খালের মুখ খোলা থাকলে, ঢলের পানি নজরখালি খাল দিয়ে বিশাল টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢুকে। টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি ঢুকলে অন্য হাওরগুলোতে পানির চাপ কমে যায়। যেহেতু নজরখালি বাঁধ দিতে আইনি বাধাও আছে, সুতরাং ওখানে বাঁধ না হলেই ভালো হয়। গণমাধ্যমকর্মীরা এসময় অপ্রয়োজনীয় বাঁধ দিয়ে একটি পক্ষ বাঁধের ব্যবসা করার ধান্দায় থাকে বলেও মন্তব্য করেন।
গণমাধ্যম কর্মীদের এই বক্তব্যের পাল্টা জবাব দেন, মধ্যনগর উপজেলার দক্ষিণ বংশিকুন্ডার ইউনিয়নের রনশির বাসিন্দা জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুস সালাম। তিনি নজরখালিতে বাঁধ না হলে নয় হাজার হেক্টর জমির ফসল ডুববে বলে দাবি করেন, ওখানে জরুরি বরাদ্দ দিয়ে বাঁধের কাজ করার দাবি জানান তিনি। এসময় দুইপক্ষে মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনাও তৈরি হয়।
বৃহস্পতিবার সকালে নজরখালি বাঁধ প্রসঙ্গে তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরপাড়ের রতনশ্রী গ্রামের বড় কৃষক হোসেন মিয়া বললেন, পাহাড়ি ঢলের পানি টাঙ্গুয়ার হাওর দিয়েই বেশি যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালিতে বাঁধ না হলে পানি ভাটির দিকে চলে যাবে। বিশাল হাওরে পানি প্রবেশ করলে শনি ও মাটিয়ান হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে চাপ পড়ে না।
একই গ্রামের উজ্জ্বল মিয়া বললেন, নজরখালি দিয়ে পানি ঢুকে বিশাল টাঙ্গুয়ার হাওর ডুবিয়ে পশ্চিমের মধ্যনগর উপজেলার উত্তর-দক্ষিণ বংশিকুন্ডা যেতে যেতে ছয়-সাত দিন লাগে। ততক্ষণে ফসল ঘরে ওঠাতে পারেন কৃষকরা।
রামসিংহপুরের কৃষক তারা মিয়া বললেন, নজরখালিতে বাঁধ দেওয়া প্রয়োজন, গুরামা এক্সটেনশনের বাঁধের কাজও করতে হবে। না হয় গুরমা এক্সটেনশনের প্রায় দুই হাজার হেক্টর এবং টাঙ্গুয়ার হাওরের মধ্যনগর এলাকার কিছু ফসলও অকাল বন্যায় ডুবে যেতে পারে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বললেন, তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরে ফসলি জমি আছে দুই হাজার ছয়শ হেক্টর। তাহিরপুর জামালগঞ্জ ও বিশ^ম্ভরপুর উপজেলাসহ শনির হাওরে জমি আছে আট হাজার হেক্টর। জামালগঞ্জের হালির হাওরে জমি আছে চার হাজার ৫২০ হেক্টর। অন্যদিকে, টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালিতে জমি আছে ২৫ হেক্টর , মধ্যনগরের উত্তর দক্ষিণ বংশিকুন্ডা ও গুরমার এক্সটেনশন মিলিয়ে জমি আছে পাঁচ হাজার পাঁচশ হেক্টর। তিনি জানালেন, নজরখালি দিয়ে একনাগারে প্রবল বেগে পানি ঢুকলে মধ্যনগরের উত্তর-দাক্ষিণ বংশিকুন্ডার ফসল ডুবতে চার পাঁচ দিন সময় লাগবে। হাওরের ফসল কীভাবে রক্ষা করা যাবে, এটি পানি উন্নয়ন বোর্ড বুঝবে ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী বললেন, নজরখালি ও গুরমার এক্সটেনশনের বাঁধ অনেক চেষ্টা করেও গেল বছর রক্ষা করা যায় নি। তিনি জানালেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালি, নাওটানা ও গনিয়াকুড়ি হাওরের বাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় নেই। এলাকার কৃষকদের দাবির মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড গেল বছর আট লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই টাকা কোন কাজে লাগেনি। ঢলে বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকেছে। বাঁধ ভাঙার পর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সকলের মনোযোগ ওখানে দিতে হয়েছে। এ কারণে অন্য কয়েকটি হাওরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বললেন, নজরখালি বাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাভুক্ত নয়। তাছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরে বাঁধ করার বিষয়ে কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, এজন্য ওখানে বাঁধ করার বিষয়টি চূড়ান্ত করা যায় নি। পানি সম্পদ উপমন্ত্রী ও পাউবোর ডিজি আগমী ২৬ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জে এসে ওখানে বাঁধ করা হবে কী না, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানালেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালিতে বাঁধ দেবার বিষয়ে মাননীয় পানি সম্পদ উপমন্ত্রী বুধবার কোন সিদ্ধান্ত জানান নি।
- অসহায়দের মাঝে বস্ত্র বিতরণ
- ত্যাগীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ