বিশ্বজিত রায়, হাওর থেকে ফিরে
ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের নির্ধারিত সময়ের আর মাত্র কয়দিন বাকি। শেষপর্যায়ে এসেও বাঁধের অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। দূর্বা-দুরমুশ দূরের কথা এখনও মাটি ফেলার কাজই শেষ হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারও রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। কর্তাব্যক্তি আসার খবরে কিছু কিছু বাঁধে কাজের গতিপ্রকৃতি বেশ তড়িঘড়িতে রূপ নেয়। তবে এগুলো যে সাময়িক দায় এড়ানো বাস্তবতা বাঁধের সার্বিক পরিস্থিতি তারই ইঙ্গিত বহন করেছে। এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ যতটুকু এগিয়েছে তাতে গড় হিসাবে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ হবে। শেষ সময়ে এসে বাঁধের কাজের অগ্রগতি বেশ অসন্তোষ্টির জানান দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যদি হাওর অতিবৃষ্টির কবলে পড়ে তাহলে কৃষকের ভাগ্য শেষমেষ অনিশ্চয়তায় গড়াবে। গত সোমবার হালি, শনি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে পরিস্থিতি এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে।
হাওর ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাঁধে এখনও মাটি ফেলার কাজ চলমান আছে। হাতেগোণা কয়েকটি বাঁধে দূর্বা-দুরমুশের কাজ করছে শ্রমিকেরা। হালি হাওরের ৩৫ নম্বর পিআইসিভূক্ত ঘনিয়ার বিলসংলগ্ন বৌলাই নদীর টার্নিং পয়েন্টে বিশাল ধসের সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত দূরবর্তী স্থানে মাটি ফেলতে দেখা গেছে। গত বছর ঘনিয়ার বিলের এ অংশটি চরম ঝুঁকিতে পড়েছিল। এ বছরও ঝুঁকিমুক্ত নয় বিপজ্জনক এ পয়েন্টটি।
এছাড়া হালি হাওরের আছানপুর গ্রামসংলগ্ন ক্লোজারটি আছে উচ্চ ঝুঁকিতে। ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারটি কোনরকম মাটিতে ভরাট হলেও হাওর অভ্যন্তরে বাঁধ লাগোয়া বিশাল গর্তটি ভরাট করা হয়নি। নীচের গর্ত থেকে বাঁধের উপর পর্যন্ত স্লোব যেভাবে টানা হয়েছে তাতে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে না। ক্লোজারটি শক্তিশালী করতে বাঁশের আড় ও বস্তা দেওয়ার কোন আলামত চোখে পড়েনি। হালি হাওরের বাদবাকি বাঁধের কোন কোনটিতে মাটির কাজ শেষ হলেও বাঁধ টেকসইয়ে দূর্বা-দুরমুশের কাজ অবশিষ্ট আছে প্রায় সব বাঁধে। কোন কোন বাঁধে এখনও মাটি পড়ছে ঢিমেতালে।
এদিকে, শনি হাওরের লালুরগোয়ালা অংশের বেশ জায়গাজুড়ে এখনও মাটি পড়েনি। ঘনিয়ার বিলের বিপরীত তীরের নান্টুখালি বাঁধে বাকি আছে মাটির কাজ। এ হাওরের জামালগঞ্জ অংশে গত বছরের ৪ টি পিআইসির স্থলে এ বছর ৮টি পিআইসি অনুমোদন হয়েছে। শনির হাওরে বড় কোন ক্লোজার না থাকলেও বরাদ্দ দ্বিগুণ হয়েছে। তবে কাজ চলছে ধীরগতিতে।
অপরদিকে, মহালিয়া হাওরেও বেড়েছে পিআইসি। এখানকার ৬টি পিআইসির মধ্যে ৩টিতে মাটি ফেলার কাজ কোনরকম শেষ হয়েছে। বাকি ৩টিতে মাটি ফেলার কাজ সন্তোষজনক নয়। নির্ধারিত সময়ের শেষলগ্নে এসে এখনও যদি মাটি ফেলার কাজ শেষই না হয়, তাহলে হাওরের নিরাপত্তায় টেকসই বাঁধ কবে নির্মিত হবে সে প্রশ্ন হাওরপাড়ের মানুষের।
বাঁধে মাটি ফেলে শক্ত হাতের দুরমুশ ও ঘাস লাগানো বাকি থাকলে বাঁধের ভেতর নিশ্চিতভাবেই দুর্বল হয়ে পড়বে। সেই দুর্বল জায়গা ছুয়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হবে। শেষমেষ গত বছরের মতো হালি হাওরের আছানপুর অংশের বাঁধ ভেঙে সোনালী ফলন তলিয়ে যাওয়ার পরিণতি বরণ করতে হবে হাওরবাসীকে।
মহালিয়া হাওরের ৯ নম্বর পিআইসির সভাপতি দেবাশীষ তালুকদার বললেন, আমাদের মাটির কাজে আরও তিন চারদিন সময় লাগবে। বাঁধের কাছে মাটি নেই। অনেক দূর থেকে মাটি আনতে হয়। যে কারণে বিলম্ব হচ্ছে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার আশা। যদিও শেষ না হয়, তবে মার্চের দুই-তিনদিনের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে।
পাগনাপাড়ের গজারিয়া গ্রামের কৃষক প্রবাল মিয়া বললেন, ‘গভমেন্টের যে নির্দেশনা আছে সে অনুযায়ী তো কাজ হয় না, হচ্ছেও না। যে ডেইটের মধ্যে কাজ হওয়ার কথা, সেই ডেইটে হবে না, অনেক কাজ এখনও বাকি আছে, অসময়ে বা বিলম্বে নির্মিত বাঁধ অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়।’
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, উপজেলার ৬টি হাওরের বাঁধের কাজে গড়ে এখনও প্রায় ৩০ ভাগ মাটির কাজ বাকি আছে। কোন কোন বাঁধে মাটির কাজ অর্ধেকও হয় নি। ৬১ টি পিআইসির মধ্যে এখনও ১৯টি পিআইসির কাজ অসমাপ্ত আছে। এছাড়া বাঁধের কমপেকশন, স্লোব, ঘাস লাগানো, বাঁশ পোঁতা ও বস্তাসহ আনুষাঙ্গিক সব কাজে প্রায় ৮০ ভাগই রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞেস করলে ২৮ তারিখের মধ্যেই সবকিছু শেষ করার মুখভর্তি বুলি শুনায়। কিন্তু হাওরের বাস্তবতা বলছে সম্পূর্ণ ভিন্নকথা। সবকিছু মিলে পরিস্থিতি ভালো নয়।
তিনি আরও জানিয়েছেন, নীতিমালা লঙ্ঘন করে পরিশেষে যে সময়টা বাড়ানো হয় তাতে পিআইসিদেরকে চরম গাফিলতি ও খামখেয়ালির সুযোগ করে দেওয়া হয়। এতে পিআইসিরা প্রশ্রয় পায় এবং হাওরবাসীর ভাগ্য গভীর সঙ্কটে পতিত হয়।
হাওর সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচিত ফেনারবাঁক ইউপি সচিব অজিত রায় বলেন, বাঁধের কাজে কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট প্রেসার আছে। সে অনুযায়ী নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রাক্কলনের সিস্টেম মতে বাঁধের কাজে যা যা ধরা আছে সেগুলো যদি পিআইসিরা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে নিঃসন্দেহে ঝুঁকি থাকবে। ভৌগোলিক কারণে হাওরের কিছু কিছু অংশ এমনিতেই বিপজ্জনক। এর মধ্যে শনির হাওরের লালুরগোয়ালা, নান্টুখালি ও আছানপুরের ভাঙ্গা অন্যতম। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে হাওর হান্ড্রেট পার্সেন্ট ঝুঁকিতে থাকবে।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ^জিত দেব বললেন, হালির হাওরের আহছানপুরের পাশের গর্তটি ভরাট করার জন্য মাটি প্রাক্কলনে ধরা আছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই এই গর্ত ভরাট করা হবে। ২৮ তারিখের মধ্যে ড্রেসিং দুরমুশের কাজ ভালোভাবে শেষ হবে আশাকরছি। এরপর দ্রুত সকল বাঁধেই ঘাষ দুর্বা লাগানো হবে। যে বাঁধে জিও টেক্সটাইল দেওয়া কেবল ওই বাঁধগুলোর কাজ অতিরিক্ত সময়ের দুই তিন তারিখ অর্থাৎ বর্ধিত সময়ে তিন চার মার্চের মধ্যে শেষ হবে।
জামালগঞ্জ উপজেলার চেয়ে তাহিরপুর, মধ্যনগর, জামালগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, দিরাই, ছাতক, দোয়ারা, শাল্লা, ধর্মপাশা ও জগন্নাথপুর উপজেলায় কম কাজ হয়েছে দাবি করে হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বললেন, যেখানে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহজে যেতে পারছেন, সেখানে কাজ এক ধরণের হচ্ছে, যেখানে যেতে পারছেন না সেখানে হচ্ছে আরেক রকমের। এছাড়া প্রভাবশালী পিআইসিকে দিয়ে কাজই ওঠাতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা। তাহিরপুরের মাটিয়ান এবং মধ্যনগরে প্রায় সবকয়টি হাওর এখনো অরক্ষিত বলে দাবি তাঁর।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বললেন, জেলার ১০৭৮ টি অংশে এবার ৭৪৬ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হচ্ছে। বরাদ্দ হয়েছে ২০৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বাঁধের কাজ বুধবার পর্যন্ত গড়ে পুরো জেলায় ৭০.০১ শতাংশ হয়েছে। এরমধ্যে সুনামগঞ্জ সদরে ৮০ শতাংশ, বিশ^ম্ভরপুরে ৮০.৯০, ধর্মপাশায় ৬৯, তাহিরপুরে ৬৪, জামালগঞ্জে ৭৭, মধ্যনগরে ৬২, শান্তিগঞ্জে ৬৫, দিরাইয়ে ৬৮.০৬, শাল্লায় ৭২.০১, জগন্নাথপুরে ৬৭, দোয়ারাবাজারে ৭২.৮৮ এবং ছাতকে ৬৭.৮০ শতাংশ কাজ শেষ। তিনি জানালেন, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মহোদয় সরেজমিনে হাওর পরিদর্শন করে সাত মার্চ পর্যন্ত কাজের সময়সীমা বাড়িয়ে গেছেন। এরমধ্যে অবশ্যই সকলকে কমপেকশন, ঘাষ-দুর্বা, বাশ-বস্তা সবই লাগানোর কাজ শেষ করতে হবে।