বিপন্ন টাঙ্গুয়া/ আর কথা নয় এবার কাজ দেখানোর সময়

টাঙ্গুয়ার হাওর তথা হাওরাঞ্চলে অপরিকল্পিত পর্যটনকে নাকি নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদকে গুরুত্ব দেয়া হবে এটি একটি বড় প্রশ্ন, একইসাথে রহস্যময় ধাঁধাও বটে। এ নিয়ে পরিকল্পিত বা সুচিন্তিত কোনো সরকারি নীতিমালা নেই। একদিকে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে অন্যদিকে তথাকথিত পর্যটনের কারণে এই হাওরে অবাধে চলাচল করতে পারছে অসংখ্য যন্ত্রচালিত ছোট-বড় জলযান। এই জলযানের কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক বর্জ্য, শব্দ, কম্পন ক্ষতি করে চলেছে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি। বিশাল টাঙ্গুয়ার হাওরসহ পুরো হাওরাঞ্চল মিঠা পানির প্রধান উৎস। একইসাথে মাছের প্রজননস্থলও বটে। হাওরগুলোর প্রাকৃতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে অধিক পরিমাণে মাছের বিচরণ হয়। যখন হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে তখন সঙ্গত কারণেই মাছের বিচরণও কমতে বাধ্য। এখন যে হাওরে মাছ নেই এর পিছনে আমাদের নিজেদের পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাই প্রধানত দায়ী। গত কয়েক দশক ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করা নিয়ে যথেষ্ট কথাবার্তা, পরিকল্পনা-প্রকল্প গ্রহণ ও সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে ঠিক কিন্তু এসব তৎপরতার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘটছে টাঙ্গুয়ার সর্বনাশ। সেই প্রক্রিয়া এখনও চলমান। এখনও কী করতে হবে, কী করা উচিৎ ধরনের আলোচনা যথেষ্ট পরিমাণে চলমান বলে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু হাওর-জলাশয় রক্ষায় বেরিয়ে আসে না কার্যকর কৌশল-পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে ঠিক করতে হবে আমরা মিঠাপানির ঐতিহ্যময় মৎস্যসম্ভারকে বিলুপ্ত করে দিয়ে খামারে চাষ করা মাছের উপরই নির্ভরশীল হব নাকি মিঠাপানির মাছের উৎপাদন বাড়ানোর অমিত সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাব। যদি আমরা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই তাহলে অবশ্যই প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে।
গতকাল দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরে ‘৪০০ জলযানে বিপন্ন টাঙ্গুয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রধান সংবাদে উপর্যুক্ত আশঙ্কাগুলোই উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে টাঙ্গুয়ার হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের কারণে দৈনিক প্রায় ৪০০ ছোট-বড় জলযান টাঙ্গুয়া ও সংলগ্ন হাওরগুলোতে অবাধে চলাচল করে থাকে। এই জলযানগুলোর চলাচলের জন্য নিদিষ্ট কোনো পথ নির্ধারণ করে দেয়া নেই। ফলে যেখানে-সেখানে চলতে পারে এসব যন্ত্রচালিত জলযান। যন্ত্রযানের তা-বে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্টের হাহাকারের কথাও এখানে উঠে এসেছে। আমাদের দেশে ইকো-ট্যুরিজম নামের একটি কথার প্রচলন আছে। এর অর্থ হলো ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি না ঘটিয়ে পর্যটনের বিকাশ সাধন করা। এ নিয়ে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকারকর্মীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু টাঙ্গুয়ার মতো মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের ভা-ারকে পর্যটন এলাকায় পরিণত করতে এই ইকো-ট্যুরিজমের ধারণাও মানা হচ্ছে না। অর্থাৎ কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বেকুবের মতো এখানে পর্যটনের বিকাশ চাওয়া হচ্ছে। এই আত্মঘাতি প্রবণতা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসা উচিৎ।
বিশিষ্টজনরা দাবি করেছেন যন্ত্রচালিত নৌযানের চলাচলের সীমানা নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। কোনো অবস্থাতেই টাঙ্গুয়ার হাওরে কোনো যন্ত্রচালিত নৌযান ঢুকতে পারবে না। নির্ধারিত রুটে পর্যটকরা এসে হস্তচালিত নৌকায় করে হাওর ভ্রমণ করতে পারবেন বলে তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরের ওই সংবাদে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আরশাদুল হককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘পাখি কিংবা মাছের অভয়াশ্রম যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেভাবে পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা ঠিক করে দিতে হবে।’ ওই সংবাদেই খোদ জেলা প্রশাসক বলেছেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব বৈচিত্রের ক্ষতি হয় এমন পথ দিয়ে নৌযান চলতে পারবে না। আমরা সেই নীতিমালা তৈরির কাজ করছি।’ এ ধরনের কথা বিভিন্ন পক্ষ থেকে বহুবার বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি আর কথা নয় এবার কাজ দেখানোর সময় এসেছে। মৃতপ্রায় টাঙ্গুয়াকে বাঁচাতে শক্ত পদক্ষেপ দরকার।