বেহাল টাউন হল

বিশেষ প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অপরিচ্ছন্ন টাউন হল মার্কেটটির সামনে আসলেই যে কারো মনে হবে শহরটি অপরিচ্ছন্ন, জৌলুসহীন। মার্কেটটিকে দৃষ্টিনন্দন করে সৌন্দর্যবর্ধনের দাবি বহুদিনের। কিন্তু এটি হচ্ছে না। গত প্রায় ২০ বছর ধরেই এই মার্কেট বহুতল ভবন হবে, দৃষ্টিনন্দন হবে মার্কেটের দোকানদাররা শুনে আসলেও জোরেশোরে এই উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। একারণে শহরে আগন্তুকরা এখানে এসেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
জানা যায়, বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত সাবেক টাউন হলে একসময় বিনোদনের নানা আয়োজন হতো। এরপর পাকিস্তান শাসনামলে এই হল রূপ নিয়েছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সুনামগঞ্জ কলেজ। সুনামগঞ্জ কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি অধিগ্রহণের পর কলেজটি স্থানান্তরিত হয় হাছননগরের বর্তমান ক্যাম্পাসে। টাউন হল মার্কেট পরিত্যাক্ত ছিল বহুদিন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে সুনামগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী ও তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের সমন্বিত উদ্যোগে এখানে দৃষ্টিনন্দন অডিটরিয়াম ও পৌর মার্কেট তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শহরের আলফাত উদ্দিন স্কয়ারের বর্তমান টাউন হল মার্কেটটি এই ইতিহাসের জানান দিলেও বর্তমানে এর করুণ অবস্থা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার এই ভবনের উন্নয়নের কোন উদ্যোগ আছে কী-না এমন প্রশ্নের জবাবে সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখ্ত অবশ্য বলেছেন, জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভার উদ্যোগে এই মার্কেটের আধুনিকায়নের কাজ শীঘ্রই শুরু করার চিন্তা করা হচ্ছে।
প্রাচীন শহর সুনামগঞ্জে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে কয়েক বছর আগেই। মমিনুল মউজদীন সড়ক, হোসেন বখ্ত চত্বর, মনোয়ার বখ্ত স্মরণি, কাজীর পয়েন্ট সড়ক মোড়, রিভারভিউয়ে শহরের নান্দনিকতা চোখে পড়ে। শহরে নতুন নতুন বিপণি বিতানও হচ্ছে। তবে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রের টাউন হল মার্কেট ভবনটির হতশ্রী অবস্থা দৈনতা জানান দেয়। কেউ এর ভেতরেও ঢুকতে চায় না। ঢুকলেও অবস্থান করার মতো পরিবেশ নেই।
রবিবার দুপুরে ডিএস রোডের গেট দিয়ে মার্কেটে ঢুকতে ডানে মোড় নিতেই দেখা গেল, প্র¯্রাব গড়াচ্ছে গলির ভেতর, দুর্গন্ধে টেকা দায়। বেশিরভাগ দোকানকোঠা বন্ধ। একটু এগুতেই চোখে পড়লো ছোটদের গেইম খোলার দোকান। এর পরের একটি দোকানকোঠায় চায়ের দোকান। দুর্গন্ধের মধ্যেই কয়েকজন বসে চা খাচ্ছিলেন। একজন বললেন, গেইমের দোকানগুলো মার্কেটের বাথরুম দখল করে করা হয়েছে।
উল্টোদিকে তাজরিয়া টুপি হাউজের মালিক রুমেন মিয়া বললেন, মার্কেটের ভেতরে ক্রেতা প্রবেশের পরিবেশ নেই। ভালো কোন দোকানও নেই। এজন্য বেশিরভাগ দোকানকোঠাই গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন মালিকেরা।
দোকানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মার্কেটের দোকানকোঠার মালিকদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। কয়েকজন মালিকের চেষ্টায় সম্প্রতি এখানে ‘সুনামগঞ্জ টাউন হল মার্কেট দোকান মালিক সমবায় সমিতি লি.’ নামের সংগঠন হয়েছে। এই সংগঠনে ২৫ জন সদস্য রয়েছেন। পাঁচজন দোকান কোঠার মালিককে সংগঠনের সদস্য করা হয় নি। এরা সিড়িকোঠা, অফিস কোঠা, বাথরুম দখল করে দোকান ভাড়া দিয়েছেন।
সিঁড়িকোঠা, বাথরুম ও অফিস কক্ষ তারেক রহমান, আব্দুল কাদির, সোলেমান মিয়া, মোশারফ মিয়া ও শ্রমিক নেতা সোহেল আহমেদের দখলে রয়েছে জানালেন এক দোকান মালিক।
শ্রমিক নেতা সোহেল আহমদ অবশ্য বলেছেন, অফিস কক্ষ বা সিঁড়িকোঠা তার দখলে নয়। আব্দুল কাদির ও তারেক রহমানের দখলে সিঁড়িকোঠা ও অফিস কক্ষ, সোলেমান মিয়া ও মোশারফ মিয়ার দখলে বাথরুম রয়েছে। তাকে (সোহেল আহমদকে) অফিস কক্ষের পেছনের একটি কক্ষ মার্কেট কমিটির সাবেক সভাপতি কামাল রাজা চৌধুরী ও আমিরুল ইসলাম চৌধুরী দিয়েছিলেন। এখানে ছাদও ছিল না। তিনি ছাদ দিয়ে ঘরের অবয়ব তৈরি করে এর সামনে একটি পান দোকান বসিয়েছেন। বর্তমান কমিটি তার ঘরকে রেজুলেসনে মার্কেটের অফিস হিসেবে দেখিয়েছেন।
টাউনহল মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে মহকুমা প্রশাসককে সভাপতি ও পৌরসভার চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘টাউনহল ডেভেলপমেন্ট কাম এক্সিকিউটিভ কমিটি’ গঠন হয়। ওই সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা পুরাতন টিনশেড ভবন ভেঙ্গে নতুন করে অডিটরিয়াম ও মার্কেট তৈরি করা হবে।
পৌরসভার তত্বাবধানে তখন টেন্ডার আহবান হয়, এই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন ৩ হাজারেরও বেশী ব্যবসায়ী। পরে লটারীতে ২৮ দোকান কোঠার বরাদ্দ পান ২৮ ব্যবসায়ী।
কিন্তু ১৯৮৪ সালে পৌর চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী খাদ্যমন্ত্রী হবার পর এর কার্যক্রম আর এগোয় নি। ১৫ শতাংশ জমির উপর নির্মিত এই ভবনটি নিয়ে তখন থেকেই জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ঐ সময় থেকে একাধিকবার পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের কাছে দোকান কোঠার লীজ গ্রহিতারা ধরণা দিলেও এর কোন সুরাহা হয়নি।
টাউনহল দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেওয়ান জালাল রাজা চৌধুরী বললেন, পৌরসভার চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী যখন ১৯৮৪ সালে মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন থেকেই প্রশাসন ও পৌরসভার মধ্যে এই মার্কেটের সমন্বয়হীনতা শুরু হয়েছিলো, দোকান মালিকদের বলা হয়েছিলো প্রত্যেক দোকান ৯৯ বছরের জন্য ব্যবসায়ীরা বরাদ্দ পাবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি হয় নি। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা এই মার্কেটকে আধুনিক বিপণি বিতান হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে, ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা করবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাউন হল মার্কেটের ১৫ শতাংশ জমি জেলা প্রশাসকের এক নম্বর খতিয়ানের ৪৩৩ নম্বর দাগে অবস্থিত। ২০০২ সালে দেওয়ান কামাল রাজা চৌধুরীসহ ৫ জন বাদী হয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে এই জায়গার স্বত্ত্ব দাবি করে দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য আদালতে স্বত্ব মামলা (৮৯/২০০২) দায়ের করেন। মামলায় বিবাদী করা হয়, নির্বাহী প্রকৌশলী- সড়ক ও জনপথ, চেয়ারম্যান, সুনামগঞ্জ পৌরসভা অর্থাৎ সম্পাদক টাউন হল কমিটি এবং জেলা প্রশাসক অর্থাৎ টাউন হল কমিটির সভাপতিকে। এই মামলায় এক পর্যায়ে তারা হেরে যান। পরে ২০০৭ সালে জেলা জজ আদালতে স্বত্ব আপিল মামলা (১১২/২০০৭) দায়ের করেন বাদীগণ। এই মামলায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন তারা। এই মামলাও নামঞ্জুর হয়।
স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা নূর আলী জানালেন, টাউন হল মার্কেট জেলা প্রশাসকের এক নম্বর খতিয়ানের ভূমিতে আছে। এ নিয়ে কোন মামলা মোকদ্দমাও এখন নেই। এটি বহু মূল্যবান ভূমি। এভাবে এই ভূমি পড়ে থাকতে পারে না। সরকারি এই সম্পদকে কাজে লাগানো জরুরি।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখ্ত বললেন, টাউন হল মার্কেটটি সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এর পাশের আলফাত উদ্দিন স্কয়ার শহরের প্রধান চত্বর। এই চত্বর বড় করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই মার্কেটটিও গোটা শহরকে উপস্থাপন করে। এটি দৃষ্টিনন্দন করা জরুরি। এজন্য আলোচনা শুরু হয়েছে। জেলা প্রশসন ও পৌরসভার উদ্যোগে আমরা এমনভাবে এর উন্নয়ন করতে চাই, যাতে শহরকে ব্রা-িং করে এই মার্কেট। নীচে পার্কিং থাকবে উপরে হবে বহুতল ভবন। আধুনিক সুনামগঞ্জের জানান দেবে এই বিপণি বিতান। এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বললেন, এই বিপণি বিতানকে আধুনিক ও সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে চাই। এ নিয়ে কথা বার্তা শুরু হয়েছে। আধুনিক মার্কেট কেবল নয়। এখানে সিনেফ্লেক্সও করা হবে। এটি দেখলেই যে কেউ যাতে বলতে পারে। এটি পরিচ্ছন্ন শহর। এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।