বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে সংরক্ষণ করুন

তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসন কর্তৃক নির্মিত পুরাতন সার্কিট হাউসটি নির্মাণের শত বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভ লিখার সময় এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য হাতের কাছে না থাকলেও এক তথ্য থেকে জানা যায় বিখ্যাত ব্রিটিশবিরোধীনেত্রী-স্বাধীনতাসংগ্রামী, বাগ্মী ও কবি সরোজিনী নাইডু ১৯২৪ সনে এই সার্কিট হাউসে এক দিন অবস্থান করেছিলেন। এ থেকেও স্থাপনাটির প্রাচীনত্ব বেশ বুঝা যায়। ভবনটি পুরনো এবং সমসাময়িক চাহিদা পূরণের জন্য যথোপযুক্ত না হওয়ায় ১৯৯৩ সনে শহরের হাজীপাড়ায় অবস্থিত সুপরিসর বহুতলবিশিষ্ট নতুন সার্কিট হাউস প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে পুরাতন সার্কিট হাউসটি কার্যকারিতা হারায়। নষ্ট হতে থাকে প্রাচীন এই স্থাপনার নানা অংশ। তখন থেকেই দাবি উঠতে থাকে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি সংরক্ষণের। অবশেষে ২০২১ সনে সার্কিট হাউসটি সংরক্ষণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রকল্পে পুরনো সার্কিট হাউসের আদল ঠিক রেখে সংস্কার ও নতুন কিছু অনুষঙ্গ স্থাপনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এজন্য ৯৮ লাখ ৬০ হাজার ২৭০ টাকা অর্থ বরাদ্দ করা হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদার কাজও শুরু করেন। সংস্কার কাজের মেয়াদ ২০২২ সনের জুলাই মাসে উত্তীর্ণ হলেও অদ্যবধি ঠিকাদার পুরো কাজ শেষ করতে পারেননি। প্রাক্কলনে বর্ণিত বহু কাজই বাকি রয়েছে। এমনকি পুরাতন সার্কিট হাউসের আদল পরিবর্তন করে ফেলার অভিযোগও উঠেছে। সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ দেখে যেকোনো ব্যক্তির বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় এই পরিমাণ অর্থ নির্দিষ্ট কাজটির জন্য যথেষ্ট। তার পরও কাজ নিয়ে অভিযোগ উঠা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের। বিশেষ করে কাজটি যদি হয় কোনো ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক যোগসূত্র রক্ষা ও সংরক্ষণের।
এই সার্কিট হাউস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা যুদ্ধে সুনামগঞ্জ পর্বের প্রতিরোধপর্ব সূচনা হয়েছিলো এই সার্কিট হাউসকে ঘিরেই। পাক বাহিনীর একটি দল এখানে অবস্থান নিলে সুনামগঞ্জের মুক্তিপাগল জনতা সার্কিট হাউস আক্রমণ করেন। পাকবাহিনীর ছুঁড়া গুলিতে শহিদ হন প্রতিরোধকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন আনসার সদস্য আবুল হোসেন ও রিকসাচালক গনেশ দাস। এরাই স্বাধীনতার বেদীমূলে প্রাণোৎসর্গকারী সুনামগঞ্জের প্রথম শহিদ। এরকম ঐতিহাসিক পরম্পরার সাথে সম্পর্কিত শতবর্ষ অতিক্রমকারী একটি স্থাপনা দেশের প্রচলিত আইনেই সংরক্ষণযোগ্য একটি স্থান। এরকম স্থাপনা সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক ধারাক্রমের সাথে বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতের যোগসূত্র রচিত হয়।
পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্থাপনা ও অপরাপর নিদর্শন সম্মানের সাথে সংরক্ষণ করা হয়। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় জার সা¤্রাজ্যের কোনো স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলা হয়নি। বরং এগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে দেয়া হয়েছিলো ওই সময়ের ইতিহাসকে ধরে রাখতে। এর মধ্য দিয়ে একটি অঞ্চলের ঐতিহাসিক সফলতা-ব্যর্থতা-শৌর্য-বীর্য-ঐতিহ্য-কীর্তি-সংস্কৃতি; সবকিছুকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেয়া যায়। সুনামগঞ্জের সার্কিট হাউসটি এ কারণেই যথাযথভাবে প্রাচীন আকৃতি ও বৈশিষ্ট অক্ষুণœ রেখে সংরক্ষণের তাগিদ সকলের। এই কাজটিকে আর দশটি নির্মাণ কাজের সাথে মিলিয়ে প্রচলিত সরকারি কাজের মতো ভাবা অনুচিত হবে।
শুধু সংরক্ষণ নয় আমরা এখানে ইতিহাসের পাঠ নিতে চাই। সে ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত এসব স্থানে এনে তাদের ইতিহাস জানাতে হবে। সে ধরনের কাঠামোর উপস্থিতি দেখতে চাই আমরা। নতুবা এই সংরক্ষণের কোনো অর্থবোধকতা তৈরি হবে না। কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের আবেদন থাকবে জাতীয় কৃষ্টি ও ইতিহাসের প্রতি আন্তরিক হয়ে এর কাজ সমাপ্ত করতে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখুন। আমরা বিজয়ী জাতি। যারা বিজয় করতে পারে তারা সংরক্ষণও করতে পারে। এই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ দেখতে চাই জেলার পুরাতন সার্কিট হাউসের ক্ষেত্রে।