ভ্রমণ- বেড়াতে ভারত-উত্তর থেকে উত্তরাখ-২১

স্বপন কুমার দেব
কনখল-মা আনন্দময়ীর আশ্রমে
ইতিপূর্বে কনখলে গিয়ে দেখে এসেছিলাম দক্ষ যজ্ঞের স্থান ও মন্দির। তখন আনন্দময়ী মা এর আশ্রমে যাওয়া হয়নি। ঐ পর্বে লিখেছিলাম স্বল্প সময় নিয়ে মা’র আশ্রমে যাওয়া বোধ হয় আনন্দময়ী মায়ের ইচ্ছে ছিল না। আসলে এটিই সত্যি কথা। সেদিন যাওয়া হলে দেখা হতো বুড়ি ছোঁয়ার মতো। অনেক কিছু জানা হতো না আর খাওয়া হতো না অতি সুস্বাদু পায়েস ও অন্ন প্রসাদ। শ্রীশ্রী মা আনন্দময়ী ছিলেন ঈশ্বরে নিবেদিত প্রাণ এক মহতী সাধিকা। এ দেশে অনেকেই উনার নাম শুনে না থাকলেও উনার জন্মস্থান বাংলাদেশের বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খেওড়া নামক এক গ্রামে। আনন্দময়ী মা বাংলা ১৩০৩ সালের ১৯ শে বৈশাখ মোতাবেক ৩০ শে এপ্রিল ১৮৯৬ সালে খেওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিপীন বিহারী ভট্টাচার্য্য এবং মাতা মোক্ষদা সুন্দরী দেবী। শ্রীশ্রী মায়ের গায়ের রং ছিল অসাধারণ ফর্সা। পিতা মাতা তাদের ফুটফুটে সন্তানের নাম রাখেন নির্মলা। গায়ের লোকেরা আদর করে ডাকতো বিমলা, কমলা, গজগঙ্গা ইত্যাদি বলে। এছাড়া আত্মীয় স্বজন সবাই আদর করে বিভিন্ন নামে ডাকতেন। পরবর্তী সময় সাধু, সন্ত, ভক্তরাও বিভিন্ন নামে সম্বোধন করতেন। আনন্দময়ী মায়ের পিতৃকূলের ও মাতৃকূলের পরিবার ছিল অত্যন্ত সজ্জন ও ধার্মিক। যত দিন যায় নির্মলা বড় হন আর মায়ের গুণাগুণ ক্রমশ: প্রকাশ হতে থাকে। শিশু নির্মলা সবার কাছে নয়নের মনি হয়ে উঠেন। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা শুরু করলেও পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর এগুয়নি। কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বহি:প্রকাশ ঘটতে থাকে। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী বারো বছর বয়সে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রামের রমনীমোহন চক্রবর্তীর  (ভোলানাথ)  সঙ্গে নির্মলার বিবাহ সম্পন্ন হয়। ভোলানাথ পুলিশ বিভাগে চাকুরী করতেন। পরে ঢাকার নবাব এষ্টেটে সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকুরীতে ঢুকেন। ভোলানাথবাবুর কর্মস্থল ছিল অষ্টগ্রাম। নির্মলা অর্থাৎ পরবর্তীকালের আনন্দময়ী মা অষ্টগ্রামে স্বামীর সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করতে থাকেন। উনি অত্যন্ত ভালো রান্না করতেন। রান্না করা তরকারী ছিল সুস্বাদু। এরই ঐতিহ্যর ধারাবাহিকতায় বর্তমান মা’র আশ্রমের রান্না খেতে অতিশয় চমৎকার, সুস্বাদু ও বৈচিত্রময়। ১৯২৪ সালে ভোলানাথ বাবু ঢাকার শাহবাগে নবাবের বাগানের তত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। বাগানটি ছিল প্রকান্ড। একাংশে একটি ঘরে ভোলানাথের থাকার ব্যবস্থা হয়। ঘরের লাগোয়া একটি মন্দির ও বড় নাট মন্দির ছিল। ভোলানাথ বাবু যখন শ্রীশ্রী মাকে নিয়ে শাহবাগে আসেন তখন মা মৌনব্রত পালন করছিলেন। সামান্য ফলমূল ও জল খেতেন। এই সময়ে আনন্দময়ী মায়ের শরীরে বিশেষ যৌগিক ক্রিয়াদির বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে। সারাদিন নামগান কীর্ত্তন চলতে থাকে। বিশাল এক ভক্ত মন্ডলী গড়ে উঠে উনাকে ঘিরে। শ্রীশ্রী মা সমগ্র বিশ্বের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মা ছিলেন। তিনি কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত নন। তিনি বিশ্বজননী। শাহবাগের একটি ঘটনা থেকে তা সবার দৃষ্টিগোচরে আসে। একজন মুসলমান ফকিরের কবরস্থান ছিল শাহবাগের বাগানে। অষ্টগ্রামে থাকা অবস্থায়ই এই ফকিরের সঙ্গে আনন্দময়ী মা’র সূক্ষ আত্মীক যোগাযোগ হয়েছিল। তখন শ্রীশ্রী মা’র মনে হয়েছিল তিনি আরব দেশ থেকে এসেছেন। শাহবাগে আসার পর মা আনন্দময়ী জানতে পারেন বাগানের ভেতর কোথাও একজন ফকিরের কবরস্থান আছে। নবাব পরিবারের এক সদস্যের সহযোগিতায় আনন্দময়ী মা একটি দালানের ভিতরে কবরস্থানের সন্ধান পান। নবাব পরিবারের লোকজন আনন্দময়ী মাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। ঐ ভদ্রলোকের চেষ্টায় দালান ঘরের এক কোঠার বহু পুরাতন তালা খোলে দেখা গেল সেখানে সত্যিই একটি কবর স্থান আছে। শ্রী আনন্দময়ী মা পরম শ্রদ্ধায় বিভোর হয়ে আনত মস্তকে সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অত:পর অনুসন্ধানে জানা যায় আরব দেশ থেকে একজর ধর্মপ্রাণ ফকির শাহবাগে এসে অবস্থান করেছিলেন। এখানেই তার মৃত্যু হলে উনাকে এই স্থানে কবর দেয়া হয়। আনন্দময়ী মা শাহবাগে থাকাকালীন প্রায়ই এই কবরস্থানে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। উল্লেখ্য যে, শাহবাগে আনন্দময়ী মায়ের এক বিরাট ভক্ত মন্ডলী গড়ে উঠে। বর্তমানে যেখানে রমনা পার্ক তৎকালীন সেই উদ্যানেই রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ী মায়ের একটি আশ্রম স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সনে পাকবাহিনী মন্দির এবং আশ্রম ধ্বংস করে দেয়। শ্রীশ্রী আনন্দময়ী মা’র ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি যে আদর্শ তা হলো সার্বজনীন। এই আঙ্গিকে যে, যে অবস্থান থেকে ঈশ্বরে নিবেদিত হন তাই সঠিক পথ। কোনো গুরুবাদ নয়, ঈশ্বরে আত্মসমর্পনই মূল জিনিস। সব ধর্ম পথ ও মতকেই তিনি বিশ্বাস করতেন। তবে এত ধর্ম মত ও পথ কেন? এর উত্তর মা’ই দিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেন জানা অজানা সব মত ও পথ মহান সৃষ্টিকর্তার লীলা বা খেলা’র রূপ। সৃষ্টিকর্তা সব সৃষ্টি করেন আবার ইচ্ছে করলেই সব বন্ধ করে দিতে পারেন। এটিই শাশ্বত সত্য। ভাবতে ভাবতে আমাদের অটোরিক্সা সোজা এসে থামলো আনন্দময়ী মা’র আশ্রমের গেটের সামনে। এই এলাকাটির নাম ব্রহ্মবিহার কলোনী, মায়াপুর, কনখল। সত্যিই সারা এলাকায় যেন মায়ার আবেশ জড়িয়ে আছে। আর মধ্যমনি স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতশ্রভ্র রং এর শান্তি ও সমতার নিদর্শন আনন্দময়ী মা’র আশ্রম। শীতের সকালে লোক সমাগম কম। ধীরে ধীরে বাড়বে। গেট দিয়ে প্রবেশ করে জুতা বাইরে রেখে ভেতরে চলে যাই। আশ্রম জুড়ে নিরবতা। মা’র অনুগত সন্যাসী ও  সন্যাসিনীরা যার যার কাজ আপন মনে করে যাচ্ছেন। একদিকে লাইব্রেরী। আরেকদিকে ভিতরে অতিথিশালা, রান্নাঘর, খাবারঘর, অফিস ইত্যাদি। শ্বেতপাথরে তৈরী মূল মন্দিরে প্রবেশ করার পর মনে হলো মনে প্রাণে প্রশান্তির সু-বাতাস ধীরলয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একটি বেদীর উপর আনন্দময়ী মা’র আবক্ষ মূর্তি। পিন পতন নিরবতা। আর আনন্দময়ী মা যেন জীবন্ত হয়ে সবাইকে ভক্তির আলো বিতরণ করছেন। বাইরে এসে দেখি দর্শনার্থীদের সমাগম বাড়ছে। এখানে বাঙালি ভক্তদের সমাগমই অধিক। মায়ের আশ্রমের অন্ন ব্যঞ্জন প্রসাদ অতি সুস্বাদু। আমাদের মনের ইচ্ছে মা’ই শেষ পর্যন্ত পূরণ করে দিলেন। আমরা অফিসে গিয়ে দুপুরে প্রসাদ খাওয়ার ইচ্ছের কথা জানালে কর্তৃপক্ষ বললেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নাম লিখাতে হয়, কিন্তু সেই সময়টি পেরিয়ে গেছে। তবে আমরা অনেক দূর থেকে বিশেষ করে আনন্দময়ী মা’র জন্মস্থান বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে বিশেষ বিবেচনায় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদেরকে দুপুরে প্রসাদ খাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। আসলে সবই সৃষ্টিকর্তার লীলা খেলা। আশ্রমে সব কাজকর্ম চলে নির্দিষ্ট সময়ে ঘড়ির কাঁটা ধরে। যথাসময়ে আমাদের ডেকে নেওয়া হলো খাবার ঘরে। লম্বা টেবিল। বসার লম্বা বেঞ্চ। নিচে আসন পেতেও বসার জায়গা আছে। পরিবেশন শুরু হলো। ঝকঝকে থালায় ধবধবে সাদা চিকন চালের ঝরঝরে গরম ভাত। সঙ্গে কয়েক পিস করে গরম পুরী, ডাল, সবজী, তরকারী। একটি থেকে আরেকটি চমৎকার। কোনটা রেখে কোনটা খাব। মনে হয় একটি পদ দিয়ে সব খেয়ে নেই। সাধারণ পুরী নয়। এই পুরী খেতে অসাধারণ। এত সুস্বাদু খাবার আগে খাইনি। সবশেষে এলো পায়েস। পায়েস যে এতো ভালো হয় তা জানতাম না। যেন অমৃত। পরিবেশনকারীরা অতি যতœশীল। বারবার আরো নিতে বলছেন। কিন্তু সম্ভব নয়। পেটে আর জায়গা খালি নেই। এত তৃপ্তি সহকারে পেট পুরে খাওয়া যেন মায়েরই আশীর্বাদ। জীবনে এরকম সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। এবার ফিরতে হবে। অতিথি ভবনের কয়েকজন অতি বৃদ্ধা মহিলাকে বারান্দায় রোদের মধ্যে চেয়ার পেতে বসানো হয়েছে। এক জনের সঙ্গে আলাপ হয়। বাঙালি। এদের পরম যতœ সহকারে সেবা শুশ্রুষা ও মমতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সামান্যতম নিরাপত্তাহীনতা কিংবা একাকীত্ব তাদের স্পর্শ করতে পারে না। আনন্দময়ী মা’র আশ্রম থেকে বেড়িয়ে এসে গঙ্গা ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করি। আশেপাশে বিভিন্ন মন্দির। আধা সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের যথেষ্ট টহল আছে মন্দিরে মন্দিরে। তীর্থস্থানগুলিতে নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ তৎপরতা চোখে পড়েছে। গঙ্গা ঘাট থেকে পৌরাণিক মিউজিয়াম গেইটে গিয়ে দেখি সেটি বন্ধ। সে দিন ছিল ২৫ শে ডিসেম্বর, বড়দিন। আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম পরিদর্শনে বহুদিনের আশা পূর্ণ হয়েছে। আনন্দময়ী মা দীর্ঘদিন  বেঁচেছিলেন। ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত মা ঘুরে বেড়িয়েছেন। বহু জায়গায় উনার আশ্রম ও ভক্তমন্ডলী আছে। মানবসেবার ব্রত নিয়েই আশ্রমগুলি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত নেহেরু পরিবার আনন্দময়ী মা’র গুণমুগ্ধ। ইন্দিরা গান্ধী অনেকবারই কনখল এসে মা’র সাথে দেখা করেছেন। ১৯৮২ সালের ২৭ আগস্ট তারিখে ৮৬ বৎসর বয়সে শ্রীশ্রী আনন্দময়ী মা দেহত্যাগ করেন। এই মহিয়সী সাধিকা সশরীরে না থাকলেও উনার আদর্শ চিরদিন মানবজীবনে শান্তি বারি’র ফল্গুধারার মতো নিরবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। শেষ বিকালে হরিদ্বারে ফিরেই আগে ভাগে চলে এলাম গঙ্গাঘাটে আরতি দেখতে। আগামীকাল রাতের ট্রেনে ছাড়ছি হরিদ্বার। কিন্তু সেই যাত্রায় যে লুকিয়ে আছে আরেক অধ্যায় তা জানতাম না। সেটি আগামী পর্বে। (চলবে)
লেখক: সিনিয়র আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক